১ নভেম্বর ২০২৩, বুধবার, ১১:০৭

পিতাকে না পেয়ে পুত্রকে গ্রেফতার পুলিশের বাড়াবাড়ি

সাদা পোশাকে গ্রেফতারে উপেক্ষিত সুপ্রিম কোর্টের রায়

গণগ্রেফতার চলছে সাদা পোশাকে। দেখানো হচ্ছে না কোনো ওয়ারেন্ট। কেন? কী কারণে ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে-পরিবারের সদস্যরা সেটিও জানতে পারছেন না। বাবাকে না পেলে আটক করা হচ্ছে ছেলেকে। এক ছেলেকে না পেলে অন্য ছেলেকে। বাড়িতে কাউকে না পেলে স্ত্রী বা গৃহবধূদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি পুলিশের তল্লাশি চলাকালে নারীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পুত্রকে গ্রেফতার অভিযানকালে মৃত্যু হচ্ছে পিতার। সরকারবিরোধী আন্দোলনরত নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার, বাড়ি বাড়ি তল্লাশিতে থোড়াই তোয়াক্কা করা হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের রায়। আইনজ্ঞরা বলছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ হচ্ছে আইন।

এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষ-সবাই প্রতিপালন করতে বাধ্য। পুলিশ এখন যেভাবে গ্রেফতার চালাচ্ছে এটি বাড়াবাড়ি। সরকার বদল হচ্ছে। কিন্তু বাড়াবাড়ি-চর্চার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানায়, সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না-এই মর্মে সুপ্রিম কোর্টের সুস্পষ্ট আদেশ রয়েছে। ২০১৬ সালের ২৪ মে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগীয় পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ আদেশ দেন। বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারা নিয়ে হাইকোর্ট প্রদত্ত রায় বহাল রেখে সুপ্রিম কোর্ট এ রায়টি দিয়েছিলেন।

রায়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিলেন, এখন থেকে সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। আটকের ৩ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে।

১৯৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতারের পর মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে তার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল তৎকালীন সরকার। তদন্ত শেষে কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করেন। সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে রিট করে। শুনানি শেষে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল বেশকিছু নির্দেশনা সম্বলিত এ রায়টি দেন।

রায় অনুযায়ী ৬ মাসের মধ্যে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে প্রচলিত বিধি সংশোধন করার পাশাপাশি ওই ধারা সংশোধনের আগে কয়েক দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা হয়। সরকারপক্ষ তখন ওই রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করলে ২০০৪ সালে সেটি মঞ্জুর হয়। তবে হাইকোর্টের নির্দেশনা সে সময় স্থগিত করা হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ২২ মার্চ আপিল বিভাগে সরকারপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানি হয়। সরকারপক্ষে শুনানি করেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। রিটকারীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম এবং ব্যারিস্টার সারা হোসেন।

সাত বছর আগে দেয়া সুপ্রিম কোর্টের রায় যেন এখন বিস্মৃত প্রায়। বিশেষত পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ন্যূনতম শ্রদ্ধা দেখা যায় না রায়টির প্রতি। এই ৭ বছরে বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে শত শত গায়েবি মামলা। ঘটনাই ঘটেনি-এমন বিষয়ের বিবরণ তুলে ধরে এজাহার দায়ের করা হয়েছে। কথিত সেই এজাহারে আসামি করা হয়েছে হাজার হাজার বিরোধী নেতা-কর্মীকে। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের কারণে মামলা হয়েছে। ময়লায় গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগ, নাশকতার চেষ্টাসহ হরকিসিমের অভিযোগ আনা হয়েছে এসব মামলায়। এভাবে মামলার পর মামলা দিয়ে আসামি করা হয়েছে অন্তত ৪০ লাখ বিরোধী নেতাকর্মীকে। সরকার পতনের একদফা আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণার পর মামলা দায়ের এবং গ্রেফতারের হার রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ২৭ অক্টোবর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিএনপির ৩ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওইদিন ছিল শুক্রবার। সাপ্তাহিক এ ছুটির দিন রাজধানীর ৫১টি থানা থেকে ১৪টি প্রিজন ভ্যানে করে গ্রেফতারকৃত ২১৯ জনকে আনা হয় ঢাকার সিএমএম আদালতে। তাদের কেউই জামিন পাননি। পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে কারাগারে। আগের দিন বৃহস্পতিবারও ঢাকায় গণগ্রেফতার চলে। ওইদিন কারাগারে পাঠানো হয় ১২৯ জনকে। ২৮ অক্টোবর পুলিশ ও ছাত্রলীগ পণ্ড করে দেয় বিএনপির পল্টন মহাসমাবেশ। ওইদিন যুবদল নেতা, সাংবাদিক ও পুলিশ সদস্য নিহত হন। এ ঘটনায় মোট ৩৬টি মামলা দেয়া হয়। এসব মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, শীর্ষ নেতা মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ ১৫শ’ ৪৪ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ২৯ অক্টোবর সকালে বিনা ওয়ারেন্টে গুলশানের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। তুলে নেয়ার ৯ ঘণ্টা পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে-মর্মে জানানো হয় গোয়েন্দা পুলিশ বিভাগ (ডিবি)। মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ইশরাক হোসেনের বাসায় গোয়েন্দা পুলিশ তাদের গ্রেফতারে তল্লাশি অভিযান চালায়। আব্দুল আউয়াল মিন্টুকে বাসায় না পেয়ে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন তার ছোট ছেলে তাজোয়ার এম আউয়ালকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। বিএনপি নেতা বড় ভাই প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনকে না পেয়ে ছোট ভাই ইশফাককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ছাড়া ওইদিন বিএনপির প্রায় সব কেন্দ্রীয় নেতার বাড়ি বাড়ি অভিযান চালানো হয় গ্রেফতারের লক্ষ্যে। এ মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এখন আত্মগোপনে রয়েছেন। চলমান ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে সারাদেশে বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের বাড়ি বাড়িও চলছে তল্লাশি, গ্রেফতার অভিযান। এর আগে ৩০ অক্টোবর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রূহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, ২৮ জুলাই ২০২৩ থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৪৪২টি মামলা দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে চলমান ৭২ ঘণ্টার অবরোধের প্রথম দিন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ৬ হাজার ৬৯০ জনকে। মামলা হয়েছে ৪৬৪টি। আসামি করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৮৭০ জনকে। সাংবাদিকসহ হত্যা করা হয়েছে ৭ জনকে। এখনও গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে। গত জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৩১ হাজার ৯৮০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর বাইরে ১৫টি মিথ্যা মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড ও অন্তত ৯০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। গত ১৫ বছরে ৪০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়টিতো আছেই।

গ্রেফতার হওয়া এসব ব্যক্তির অধিকাংশই জানেন না তারা কোন মামলায় কেন গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের গ্রেফতার কালে উপেক্ষা করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত বিধান। সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, বিনা ওয়ারেন্টে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারে না। কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা থাকলে তাকে গ্রেফতারে আদালত ইস্যুকৃত ওয়ারেন্ট লাগবে। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ই হচ্ছে আইন। এ আইন পুলিশসহ প্রত্যেক নাগরিক মানতে বাধ্য।

তাহলে কীভাবে গ্রেফতার করছে পুলিশ : সাম্প্রতিক গ্রেফতার ও কিছু গণগ্রেফতার পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুলিশ মানুষকে গ্রেফতার করছে ফৌজদারি কার্যবিধির বহুল বিতর্কিত ৫৪ ধারা বলে। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা অনুযায়ী ৯টি ক্ষেত্রে পুলিশকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এসব গ্রেফতারে কোনো ওয়ারেন্ট কিংবা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ প্রয়োজন হয় না। এগুলো হচ্ছে (ক) আমলযোগ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি অথবা যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত অভিযোগ রয়েছে কিংবা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া গেছে, বা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রয়েছে। (খ) আইনসঙ্গত কারণ ছাড়া যার কাছে ঘর ভাঙার কোনো সরঞ্জাম রয়েছে এমন ব্যক্তি। (গ) এই কার্যবিধি কিংবা সরকারের আদেশ দ্বারা যাকে অপরাধী ঘোষণা করা হয়েছে-এমন ব্যক্তিকে। (ঘ) চোরাইমাল যার কাছে পাওয়া যায়। (ঙ) পুলিশ কর্মকর্তার কাজে বাধাদানকারী; হেফাজত হতে পলায়নকারী বা পলায়নের চেষ্টাকারী ব্যক্তি। (চ) সশস্ত্র বাহিনী হতে পলায়নকারী। (ছ) দেশের ভেতর যে সব কাজ শাস্তিযোগ্য দেশের বাহিরে করা হয়েছে তেমন কাজ। (জ) কোনো মুক্তিপ্রাপ্ত আসামি যিনি অত্র কার্যবিধির ৫৬৫(৩) উপধারা লঙ্ঘন করেছেন। (ঝ) গ্রেফতারের জন্য পুলিশের কাছ থেকে অনুরোধপত্র আছে। এই ৯টি ক্ষেত্রে পুলিশকে বিপুল ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আর এসব ক্ষমতা প্রয়োগেই পুলিশ চালাচ্ছে গণগ্রেফতার।

তবে ৫৪ ধারায়ও পুলিশ এভাবে গ্রেফতার করতে পারে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম। গতকাল মঙ্গলবার ইনকিলাবকে তিনি বলেন, ৫৪ ধারায় স্পষ্ট করে বলা নেই যে, এখন যেভাবে গ্রেফতার করা হচ্ছে এভাবেই গ্রেফতার করা যাবে। কীভাবে ৫৪ ধারার প্রয়োগ হবে সেটি ২০১৬ সালে আপিল বিভাগ দিয়েছেন। এটি পুলিশের গ্রেফতার এবং ম্যাজিস্ট্রেটের রিমান্ডে প্রেরণ বিষয়ক একটি গাইড লাইন। নিরপরাধ মানুষের নিগ্রহের শিকার রোধে আপিল বিভাগ নির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন। কিন্তু এই নির্দেশনা যারা প্রতিপালন করবেন তাদের প্রতি সরকারের তরফ থেকে প্রতিপালনের আবশ্যকতা নিয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়েছে কি না আমি জানি না। জানা মতে দেয়া হয়নি। তাহলে যাদের উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশনা দিলেন তারাই যদি বাড়াবাড়িটা করেন তাহলে তো ব্যবস্থা নেয়ার কেউ থাকল না। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো এই যে, সরকার বদল হয়। কিন্তু পুলিশি বাড়াবাড়িটার কোনো পরিবর্তন হয় না।

https://dailyinqilab.com/national/article/613858