৩১ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৬:০৪

অনিশ্চয়তায় রাজস্ব আহরণ

 

জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আইনমন্ত্রণালয়ে নিবন্ধন ফি অর্ধেকে নামিয়ে আনলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর আরোপ করেছে দ্বিগুণ। ফলে জমির প্রকৃত মূল্য এবং রেজিস্ট্রেশন খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় সমান। এ কারণে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশের কয়েকটি এলাকায় জমি ও ফ্ল্যাটের সাফকবলা রেজিস্ট্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া যতটুকুন না রেজিস্ট্রেশন সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের মাঝে পড়েছে তার চেয়ে বেশি পড়েছে রাজস্ব খাতে। নিবন্ধন খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় কমে গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এর ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ খাত থেকে অতিরিক্ত যে ৯ হাজার কোটি টাকা আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সেটি ব্যর্থ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কারণ লক্ষ্যমাত্রার ৩ ভাগের এক ভাগ (৩ হাজার কোটি টাকা) আদায়ের কথা ভূমি বা আবাসন খাতের নিবন্ধন থেকে। ভূমি নিবন্ধন খরচ দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে নিবন্ধন। যা রাজস্ব আহরণে অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এনবিআর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ১৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা আয় করে। চলতি অর্থবছরে ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে আরো ১৫ হাজার ৪০০ কোটি বেশি আয় করা সম্ভব হবে। তা সত্ত্বেও লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে অতিরিক্ত আরো ৯ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করতে হবে এনবিআরকে। আইএমএফ’র ৪৭০ ডলার ঋণ সহায়তার দ্বিতীয কিস্তির অর্থ ছাড়ের শর্ত স্বরূপ আইএমএফ প্রতিনিধির কাছে রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা তুলে ধরে এনবিআর। সেখানে ভ্যাট, আয়কর ও শুল্কনীতির সদস্যগণ রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা তুলে ধরেন। লক্ষ্য ঘাটতির ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ আয়ে ৬টি খাত নিয়ে পরিকল্পনার কথা জানানো হয়। এসব খাতের মধ্যে ভূমি নিবন্ধন খাতকে রাখা হয়েছে এক নম্বরে। ভ্রমণ, তামাকজাত পণ্য, পরিবেশ সারচার্জ ও সর্বনিম্ন কর, কর আওতা বৃদ্ধি এবং বকেয়া আহরণ রয়েছে পরবর্তী খাতগুলোর মধ্যে। অর্থাৎ ভূমি নিবন্ধনই যে ঘাটতি পূরণের প্রধান খাত এ কথা এখানে বলাই বাহুল্য। এ খাত থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা আহরণের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করেছে এনবিআর। তবে জুলাই মাসে নুতন আয়কর আইন চালুর দুই মাসের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর তীব্র আপত্তির মুখে রেজিস্ট্রেশন কর কমাতে বাধ্য হয় সংস্থাটি। গত ৪ অক্টোবর এনবিআর’র কর নীতির সদস্য ড. সামস উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ কথা জানানো হয়। প্রজ্ঞাপন মতে, জমি রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন কর থেকে সরে এসে মৌজাভিত্তিক জমি কর নির্ধারণ করা হয়েছে। মৌজা অনুযায়ী বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকার জমি নিবন্ধন কর পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে উৎসে কর বিধিমালায় জমি নিবন্ধনের সর্বোচ্চ কর হার ছিল ২০ লাখ টাকা বা দলিল মূল্যের ৮ শতাংশের মধ্যে। যা সর্বোচ্চ, যা এখন সংশোধিত এসআরও-তে করা হয়েছে ১৫ লাখ টাকা বা দলিল মূল্যের ওপর ৮ শতাংশের যেটি সর্বোচ্চ। কিন্তু তা সত্ত্বেও শ্রেণিভেদে জমি নিবন্ধন খরচ বেড়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি। কারণ নতুন উৎসে কর আদেশ অনুযায়ী নিবন্ধনের ক্ষেত্রে দেশের জমিকে ৫ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘ক’ শ্রেণির জমি সরকারি সংস্থা নির্মিত বাণিজ্যিক এলাকা, ‘খ’ শ্রেণি সরকারি সংস্থার আবাসিক এলাকা, ‘গ’ ও ‘ঘ’ শ্রেণি হচ্ছে যথাক্রমে বেসরকারি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকা। এই চার শ্রেণির বাইরের জমি থাকবে ‘ঙ’ শ্রেণিতে। শ্রেণিভেদে নিবন্ধন কর নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে আয়কর আইন ২০২৩-এর আওতায় ‘উৎসে কর বিধিমালা’ অনুসারে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরসহ দেশের সকল এলাকার সম্পত্তি নিবন্ধন কর দ্বিগুণ করা হয়। বাংলাদেশের যে কোনো এলাকায় স্থাবর সম্পত্তি বা জমি ও ফ্ল্যাট হস্তান্তর হোক না কেন মালিকানা অর্জন করতে কর দ্বিগুণ গুনতে হবে। অর্থাৎ যেখানে রেজিস্ট্রেশনে যে এলাকায় ১, ৩ ও ৪ শতাংশ কর ছিল তা বৃদ্ধি করে ২, ৬ ও ৮ শতাংশ করা হয়। নিবন্ধন কর হিসেবে রাজধানীর গুলশান, বনানী, মতিঝিল, দিলকুশা, নর্থ সাউথ রোড, মতিঝিল সম্প্রসারিত এলাকা ও মহাখালী এলাকায় সম্পত্তি কিনলে ক্রেতাকে জমি, ফ্ল্যাট বা যে কোনো স্থাপনা নিবন্ধনের জন্য কাঠা প্রতি ৮ শতাংশ বা ২০ লাখ টাকার মধ্যে যেটি সর্বোচ্চ সেটি গুনতে হতো।

 চলতি বছর ১৮ জুন জাতীয় সংসদে ‘আয়কর বিল-২০২৩’ পাস হয়। গত ৩ জুলাই আয়কর আইন ২০২৩-এর আওতায় উৎসে কর নতুন বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশ করে এনবিআর। এরপর থেকেই বেড়ে যায় জমির নিবন্ধন খরচ। এর মধ্যে ৫ ভাগে বিভক্ত জমির কোনো কোনো শ্রেণির জমি নিবন্ধনের খরচ বেড়ে দাঁড়ায় জমির স্থানীয় মূল্যেরও বেশি। যেমন জমির স্থানীয় মূল্য যদি হয় ২২ লাখ টাকা। উৎসে করসহ জমির নিবন্ধন খরচ দাঁড়ায় ২৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ মুহূর্তে কোনো ক্রেতা যদি ২২ লাখ টাকার জমি কিনতে চান, তাকে পরিশোধ করতে হবে ৪৬ লাখ টাকা। এ কারণে এই শ্রণির জমির খরিদদাররা আপাত জমি বা ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি কমছে না। এ বাস্তবতা স্বীকার করে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা নিবন্ধন অধিদফতরে মহাপরিদর্শক (আইজিআর) উম্মে কুলসুম বলেছেন, আইনমন্ত্রণালয় নিবন্ধন ফি ৫০ ভাগ কমিয়েছে। এরপরও যদি মানুষ সাফকবলা জমি নিবন্ধন না করে তাহলে কি করার আছে? বিষয়টি নিয়ে আমরা এনবিআররের সঙ্গে কথা বলছি। হয়তো উৎসে করের এই হার রিভাইস করবে।

এদিকে জমি বা ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে দেশের আবাসন শিল্পে। জমি বা ফ্ল্যাটের ক্রেতারা কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এ কারণে মাথায় হাত পড়েছে শিল্প সংশ্লিষ্টদের ওপর। আবাসন খাতের জাতীয় সংগঠন ‘রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’-রিহ্যাব বরাবরই নিবন্ধন খরচ কমানোর দাবি জানিয়ে আসছে। সংগঠনটির নেতা, সাবেক সহসভাপতি লিয়াকত আলি ভুইয়া জানান, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নির্মাণ খাতের অবদান প্রায় ১৫ শতাংশ। এই খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত ২ কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। জমি বা ফ্ল্যাটের নিবন্ধন খরচ বেড়ে যাওয়ায় আবাসন শিল্প সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারও বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে।

এ বিষয়ে এনবিআর’র সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় ইনকিলাবকে বলেন, এখানে দুই দিকের বক্তব্য আছে। ভূমি নিবন্ধনে মূল্য কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকির বাস্তবতা যেমন আছে, তেমনি উৎসে করের নামে অতিরিক্ত কর আদায়ের বিষয়ও রয়েছে। জমির নিবন্ধন বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো উৎসে কর বাড়ানো ঠিক হয়নি। তিনি বলেন, বছরে কত জমি বিক্রি হয়। এ খাত থেকে কত রাজস্ব আহরণ হয় এ বিষয়ে হোমওয়ার্ক থাকার কথা। নিবন্ধই যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে অবশ্যই এনবিআর’র উচিত এটি রিভাইজ করা। ২২ লাখ টাকার জমির রেজিস্ট্রেশন খরচ ২৪ লাখ টাকা অর্থাৎ মোট ৪৬ লাখ টাকায় উন্নীত হলে বুঝতে হবে সেখানে রাজস্ব আরোপে হোমওয়ার্কের ঘাটতি আছে। এমনটি হওয়ার কথা নয়। এখানে কোনো ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি থাকতে পারে। এনবিআর’র উচিত পরিপত্র জারি করে বিষয়টি পরিষ্কার করা। এনবিআর’র যদি কোনো ব্যখ্যা না থাকে তাহলে রিভাইজ হওয়া উচিত। তারা (এনবিআর) কি ভেবে কোনো তথ্যের ভিত্তিতে এটি করেছে-এটি জানা দরকার। এখানে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। আমার ধারণা, বিষয়টি নিয়ে এনবিআর কাজ করছে।

https://dailyinqilab.com/national/article/613535