২৯ অক্টোবর ২০২৩, রবিবার, ৭:৪৫

দেশ এখন অঘটনের এক জনপদ

সালাহউদ্দিন বাবর

 

বাংলাদেশ এখন যেন এক অঘটনের জনপদ। এই অঘটনগুলো প্রায় প্রতিটি মানুষকে শোকাভিভূত করছে, কোনোটি মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করছে। কিছু অঘটন মানুষকে হতাশ হতবুদ্ধি করে ফেলছে। কোনো অঘটনের সংবাদ মানুষকে ভেঙে পড়ার পর্যায়ে পর্যন্ত নিয়ে যায়।

হাতেগোনা মাত্র দু-একটি ঘটনা কালেভদ্রে মানুষকে মুহূর্তের জন্য খানিকটা স্বস্তি দেয় বটে, তবে পরক্ষণেই কোনো অঘটনের সংবাদ মানুষকে আবারো শোকবিহ্বল করে তোলে। এটাই যেন এখন দেশবাসীর নিয়তি। আর এসব ব্যত্যয়গুলোর প্রায় প্রতিটি ঘটাচ্ছে সঙ্ঘবদ্ধ দুরাচারীরা। এসব দুর্বিনীতদের পিছন থেকে যারা মদদ দেয় তাদের হদিস নিতে গেলে দেখা যাবে, এসব নেপথ্যচারী এতটাই প্রভাব প্রতিপত্তিশালী যে, তারা রাষ্ট্রশক্তির বৃত্তের মধ্যেই অবস্থান নিয়ে আছে। তারা দিবাভাগের কাজ রাতে করতেও সমর্থবান। আবার নিশীথে তারা সব কিছু স্বচ্ছ করে ফেলতে পারে। এটা কোনো জাদুমন্ত্রের ছলাকলা নয়। এদের অবস্থান যেহেতু রাষ্ট্রবৃত্তের মাঝে- সেই বৃত্তের প্রভাব বলয়ই তাদের ক্ষমতার উৎস। আজ যেহেতু জবাবদিহির কোনো সংস্কৃতি আর বজায় নেই, তাই তাদের বিচরণ অসীম মুক্ত আকাশের মতোই অবারিত। এসব নেপথ্যচারীর কেউ নায়ক বলুক বা খলনায়ক বলুক সে ব্যাপারে মানুষের বিবেচনাই যথেষ্ট। এসব দুরাচারীর সৃষ্ট ব্যত্যয়গুলো একে একে সারিবদ্ধ করা হলে দেখা যাবে, ব্যত্যয়ের এক বিরাট মিছিল।

 

প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত যেসব ব্যত্যয় ও অনিয়মের সংবাদ দেখা যায়, তার দু-একটিকে নমুনা হিসেবে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।

একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে গত ১৯ অক্টোবরের সংখ্যায় দ্বিতীয় শীর্ষ সংবাদ হিসেবে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে সেই খবরের শিরোনামের ভাবানুবাদ করলে হয়তো এমন দাঁড়াবে- ‘সরকার সরিয়ে দিলো নদী কমিশনের প্রধান নির্বাহীকে।’ শিরোনামের নিচে ছোট অক্ষরে সাব-হেডিংয়ে লেখা ছিল, এই আদেশ দেয়া হলো, এমন সময় যার তিন সপ্তাহ আগে, তিনি (সেই নির্বাহী) যখন চাঁদপুরের এক মহিলা মন্ত্রীর সমালোচনা করেছিলেন। সেই খবরে যা বলা হয়েছে তার ভাবানুবাদ করা হলে এমনই দাঁড়ায়- নদী কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীর চাকরির মেয়াদ আরো দেড় বছর থাকা সত্ত্বেও তার চাকরির চুক্তিপত্র বাতিল করেছে সরকার। তার এক মাসেরও কম সময় পূর্বে, তিনি বলেছিলেন চাঁদপুরের এক মহিলা মন্ত্রী মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলনকারী সিন্ডিকেটকে মদদ দিয়ে যাচ্ছেন।

সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সেই বিশেষজ্ঞ ড. মনজুর আহমেদের চাকরিচ্যুতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে, ‘জনস্বার্থে তাকে চাকরিচ্যুত’ করা হলো। আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার তিন বছর মেয়াদে চাকরি চুক্তি করে নিয়োগ দিয়েছিল।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর ড. মনজুর অভিযোগ করেন মেঘনা নদী থেকে ছয় হাজার কোটি টাকা মূল্যের বালু লুণ্ঠন করছে এক সিন্ডিকেট। ড. মনজুর আরো বলেছিলেন, এই সিন্ডিকেট আবারো ড্রেজিং করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদের অবৈধ ও অপরিকল্পিত ড্রেজিং অব্যাহত থাকলে নদীটির ভয়ানক ক্ষতি হবে। সেই সাথে এই নদীর মৎস্যসম্পদও বিপদগ্রস্ত হবে বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন। এমন অপরিকল্পিত ড্রেজিং চলতে থাকলে মেঘনা নদী রক্ষা করা যাবে না। এটা সবাই জানেন এমন ড্রেজিংয়ের ফলে নদীস্রোত অনিয়ন্ত্রিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাতে কোথাও কোথাও নদীভাঙন মারাত্মক রূপ নেবে। এতে ফসলি জমি, বসতবাড়িসহ নানা সরকারি স্থাপনা নদীতে বিলীন হতে পারে। যা আমরা হরহামেশা দেখছি। এজন্য মারাত্মক ইকোলজিক্যাল ইমব্যালান্স সৃষ্টি হয়। ফি-বছর এমন নির্বুদ্ধিতার কারণে সারা দেশে লাখ লাখ একর জমিজিরাত, বাড়িঘর স্থাপনা ধ্বংস হয়। দেশের অপরিমিত ক্ষতি হচ্ছে এবং সেই সাথে পরিবেশের চরম ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে।

যে নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা নদী ও তার সম্পদ রক্ষার জন্য শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন-তাকে এখন ব্যক্তিবিশেষ বা কোনো সিন্ডিকেটের স্বার্থে ‘চাকরিচ্যুতির মতো পুরস্কার’ দেয়া হলো। এই প্রশ্নটি এখন জাতির সম্মুখে হাজির হয়েছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে যদি কেউ ভালো কাজ করেন তবে তাদের হাতে এমন পুরস্কার ধরিয়ে দেয়া হয়। তাহলে প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মকর্তা রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করতে এগিয়ে আসবে। এমন বার্তা প্রশাসনের দক্ষ যোগ্য সৎ নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাদের কেবল নিষ্ক্রিয়ই করে তুলবে। কেননা তাদের সামনে ড. মনজুরের পাওয়া পুরস্কারের দৃষ্টান্ত থাকছে। সেই সিন্ডিকেটের সাথে হাত মিলালে শুধু চাকরি বাঁচতো না, নগদ কিছু পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকতো। ছয় হাজার কোটি টাকা উপার্জনকারীদের সাথে মিলেমিশে চললে ড. মনজুরের কোনো সমস্যা হওয়ারই কথা নয়। এভাবেই দেশ এখন চলছে। তাতে দেশের ‘অধঃগতির’ ‘গতি’ ডিজিটালের মতো দ্রুতগামী এবং ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসের মতো কোথাও আর থামতে হয় না।

আর একটা প্রশ্ন সবার মনে এখন খচ্ খচ্ করছে। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নির্বাহীরা দায়িত্ব বুঝে নেয়ার আগে সংবিধানের আলোকে একটা শপথবাক্য উচ্চারণ করেন। সেই শপথবাক্যটি এমন- ‘এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিবো।’ এখন কথা হচ্ছে জনপ্রশাসনের রাজনৈতিক নির্বাহী রাষ্ট্রের একজন হিতাকাক্সক্ষী কর্মকর্তাকে কোন ‘জনস্বার্থে’ এবং কী অনুরাগের বশবর্তী হয়ে তাকে অকালে চাকরিচ্যুতির মতো পুরস্কার দিলেন! এই জিজ্ঞাসার কি কোনো জবাব পাওয়া যাবে? না, পাবার কোনো কারণ নেই। এর আগেও প্রজাতন্ত্রে অনেক যোগ্য দক্ষ ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বিনা কারণে বিদায় করে দেয়া হয়েছে তথাকথিত ‘জনস্বার্থে’র অজুহাত তুলে। এসব উদাহরণ প্রশাসনকে এমন বিশেষণে বিশেষায়িত করছে যার নজির একমাত্র তারাই। যারা বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিজেদের উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি বলে মনে করে।

দেশের বিভিন্ন নদীতে প্রতিনিয়ত ড্রেজিং চালিয়ে যাচ্ছে নানা সিন্ডিকেট তথা বালুখেকোদের দল। ১৯ অক্টোবর এমন এক অবৈধ ড্রেজিংয়ের এক সচিত্র খবর প্রকাশিত হয়েছে একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকে। সে খবরের শিরোনাম, ‘লুট হয়ে যাচ্ছে সোমেশ্বরী নদী।’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘লুট হয়ে যাচ্ছে সোমেশ্বরী নদী। এতকাল দখল, দূষণ শব্দের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল নানা নদীর নাম। কিন্তু পাহাড়ি খর¯্রােতা সোমেশ্বরীর দশা দেখে মনে হলো শুধু দখল দূষণ নয়, দুর্বিনীত তাণ্ডব চলছে নদীকে নিয়ে। নেত্রকোনা জেলার বিরিশিরির বটতলা মোড়ে সোমেশ্বরীর পাড়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে নদীর ক্ষতবিক্ষত চেহারা। ইজারা নিয়ে নদী থেকে বালু তুলছে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই। কিন্তু মানা হচ্ছে না ইজারার শর্ত। শত শত ‘বাংলা ড্রেজারের (অননুমোদিত ড্রেজার) কান ফাটানো বিকট শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে। নদীর দুই পাশের প্রায় এক দেড়-কিলোমিটার এলাকায় দূষিত পরিবেশ। দুর্বিষহ পরিস্থিতি। ... নদীর বুক খুঁড়ে প্রতিদিন তুলে নেয়া হচ্ছে হাজার হাজার ট্রাকবোঝাই বালু, নুড়িপাথর আর কয়লা। আরো জানা গেছে, এবারো প্রায় ৭৭ কোটি টাকায় পাঁচটি বালুমহাল ইজারা দেয়া হয়েছে। সব কয়টি পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা। সর্বত্র যেন দেশের সম্পদ লুটে নেয়ার প্রতিযোগিতা চলছে।

সরকার সোমেশ্বরী নদীকে বালুমহাল পরিচিতি দিয়েছে। নদী নাব্যতা বজায় রাখার জন্য ড্রেজিংয়ের বালু তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ২০০৫ সালে। কালক্রমে বালুদস্যুরা ড্রেজিংকে নদী লুটের হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করেছে।

নদী থেকে ‘বালু তোলা’ শব্দটির বদলে ‘বালু লুট’ কথাটিই বাস্তবতার সাথে মানানসই। সে দৃশ্য চোখে পড়ল বিরিশিরি সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে। উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে যাওয়া সোমেশ্বরীর চওড়া বুকে পানিপ্রবাহ এখন সরু খালের মতো পুরো নদীতে শত শত ‘বাংলা ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু তোলা।’ পত্রিকাটি আরো লিখেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেত্রকোনার নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, অননুমোদিত ‘বাংলা ড্রেজার’ দিয়ে বালু তোলায় নদীটি অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে। পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। তাদের কাছে সঠিক জরিপ নেই, তবে আনুমানিক প্রতিদিন ২১ লাখ ঘনফুট বালু ও পাথর তোলা হচ্ছে।

ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বরাবরই শাসকদলের লোকেরাই বালু মহালগুলোর ইজারা পেয়ে থাকে। বালুমহাল থেকে প্রতিদিন দুই শতাধিক ট্রাক বালু বহন করে শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি পর্যন্ত ৩৭ কিলোমিটার রাস্তাটার পুরোটা দখল করে নেয়।

এই বারো কিলোমিটার রাস্তাটা মাত্র বছর তিনেক আগে ৩১৬ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হয়। এখন সড়কটি ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। মানুষের চলাচলের পর্যন্ত অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

আসলে পুরো দেশের নদীগুলোর এমন দুর্ভাগ্য যে, হয়তো নদী দখল হয়ে যাচ্ছে, নয়তো নদীতে বর্জ্য ফেলায় বিষাক্ত হয়ে পড়েছে তার পানি। এসব নদীর পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। এখন নদীর পানি দিয়ে কৃষিজমিতে সেচ দেয়াও ফসলের জন্য ক্ষতিকর। নদ-নদীর দেখভাল করা যাদের দায়িত্ব, তারা সে দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ বা তারা তা পালন করতে পারছেন না। আজ শুধু পানিসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে না। শুধু নদী নয়, সর্বত্র এমন ধ্বংসযজ্ঞ চলছে।
ndigantababar@gmail.com

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/787398