২৯ অক্টোবর ২০২৩, রবিবার, ৭:৪৪

সমস্ত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে সকল বিরোধী দলের সরকার পতনের ‘মহাযাত্রা’

-আসিফ আরসালান

 

আগামীকাল ২৯ অক্টোবর রোববার যখন এই লেখা বের হবে তখন গতকাল ২৮ অক্টোবর শনিবার অনুষ্ঠিত বিএনপি, ৩৮ টি বিরোধী দল এবং আওয়ামী লীগের মহাসমাবেশ, জনসমাবেশ এবং শান্তি সমাবেশের খবর প্রকাশিত হবে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ ডেকেছিল। সরকার এই মহাসমাবেশের অনুমতি দেয়নি। অজুহাত দেখিয়েছে, জামায়াত নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নয়। কিন্তু এই অজুহাত ধোপে টেকে না। কারণ নিবন্ধন না থাকলে সংশ্লিষ্ট দলের নাম নিয়ে কোনো নির্বাচন করা যায় না। তাছাড়া সেই দলকে কোনো প্রতীকও দেওয়া হয় না। গত নির্বাচন অর্থাৎ ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়ও জামায়াতের নিবন্ধন ছিল না। দলটির ২০/২২ জন প্রার্থী ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেছেন। ওটি কোনো নির্বাচন ছিল না। ছিল মধ্যরাতের নির্বাচনী নাটক। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। নিবন্ধন না থাকলে সভা-সমিতি করা যাবে না, এমন কোনো কথা সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদে নেই। একটি দল তখনই কোনো সভা- সমিতি, মিছিল, মিটিং করতে পারে না যখন সেই দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। জামায়াত নিষিদ্ধ কোনো রাজনৈতিক দল নয়। তারপরেও তাকে সভা-সমিতি করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না কেন? 

যদি নিবন্ধনের কথাই ওঠে তাহলে নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি পরিষদ ইত্যাদি দলকে সভা করতে দেওয়া হচ্ছে কেন? এখানে আমরা বলতে চাই যে নাগরিক ঐক্য বা গণসংহতি পরিষদ বা অন্য যে কোনো দল, যাদের নিবন্ধন নেই, তাদের সকলকেই মিটিং-মিছিল করার অনুমতি দেওয়ার পেছনে দৃঢ় সমর্থন রয়েছে আমাদের। আমরা শুধু সরকারের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বিচারিতা দেখানোর জন্য নাগরিক ঐক্য ও গণসংহতির প্রসঙ্গ টানলাম। 

কথায় কথায় আদালতের রেফারেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু আদালতেও তো বিষয়টি চূড়ান্তভাবে ফয়সালা হয়নি। একথা ঠিক যে হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায় দিয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে। সেই আপিলের নিষ্পত্তি হয়নি। আপিলটি এখনও দেশের সর্বোচ্চ আদালতে পেন্ডিং। এই আপিলটি যতদিন পেন্ডিং থাকবে ততদিন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল চূড়ান্ত বলে ধরা যাবে না। সুতরাং আমরা আবার বলছি, জামায়াতকে জনসভা করার অনুমতি না দেওয়াটা দেশের সাধারণ আইন এবং সংবিধানের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। তবে কোনটি সংবিধান সম্মত আর কোনটি নয়, সেই ভেদরেখা আওয়ামী সরকার মোটেই মানে না।

অতীতে দেখা গেছে বিএনপিকে অনুমতি দেওয়া হয়নি এই কারণে যে তারা সভা করলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বিগত দেড় দুই বছরে আওয়ামী লীগ অনেক সভা করেছে এবং প্রত্যেকটি সভার জন্যই রাস্তা বন্ধ করেছে। এমনকি পুলিশ রাস্তা বন্ধে সহায়তাও করেছে। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে রাস্তা বন্ধ বা খোলার প্রশ্ন ওঠেনি। এমনকি আওয়ামী লীগ সভা করার জন্য কোনো অনুমতিরও তোয়াক্কা করেনি। কিন্তু তখন পুলিশ ছিল নির্বিকার। 

আরো একটি বিষয় এখানে উল্লেখের দাবিদার। সেটি হলো, এইবার অর্থাৎ ২৮ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত বিএনপির জনসভা একটি নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করলো। সভা অনুষ্ঠানের ৭ দিন আগে ডিএমপি বিশেষ করে তার জয়েন্ট কমিশনার বিপ্লব কুমার অত্যন্ত রূঢ় একং কঠোর ভাষায় বলেছিলেন যে রাস্তায় সভা করতে দেওয়া হবে না। সরকার যেটি অনুকূল মনে করবে সেখানেই রাজনৈতিক দলগুলোর (এখানে আওয়ামী লীগ বাদে) সভা করতে হবে। এটি বাধ্যতামূলক। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে এবারই সর্বপ্রথম ব্যতিক্রম যে বিএনপি পুলিশের মুখের ওপর বলে দিয়েছে যে পারমিশন দেওয়া হোক আর না হোক, তারা সভা করবেই। কারণ নয়াপল্টনে সভা অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করেছে। তাদের পক্ষে এখন আর সভার স্থান পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। বাবু গয়েশ^র চন্দ্র রায় এবং এ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভি ৩ দিন আগেই বলেছেন যে তাদের জনসভা ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনেই হবে। মির্জা ফখরুল অবশ্য একই কথা বলেছেন, তবে ডিপ্লোম্যাটিক্যালি। তিনি বলেছেন যে নয়াপল্টনে দেওয়া হয় কিনা সেটির তিনি শেষ দেখা দেখে ছাড়বেন। সাংবাদিকরা বিশ^স্ত সূত্রে জেনেছিলেন যে যদি পুলিশ অনুমতি না দেয় তাহলেও জনসভা হবে। কারণ আর যাই হোক, রাষ্ট্রশক্তি তো অত্যন্ত বলবান। তাদের সাথে তো আর যুদ্ধ করা যায় না। সেক্ষেত্রে তাদেরকে কৌশলী হতে হবে। তাদের সেকেন্ড প্ল্যানটি ছিল মোটামুটি এরকম: যদি নয়াপল্টনে শেষ পর্যন্ত অনুমতি দেওয়া না হয় তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত লাখো লাখো জনতা অন্তত ২০ টি ভাগে ভাগ হয়ে যাবে এবং এই ২০ টি ভাগ ঢাকা মহানগরীর ২০ টি স্পটে জনসভা করবে এবং পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করবে। 

॥ দুই ॥

সুপ্রিয় পাঠক, আমি প্রথমেই বলেছি যে গতকাল বিএনপির মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেই খবর আপনারা দৈনিক সংগ্রামসহ অন্যান্য পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় পাঠ করেছেন। কিন্তু আমার এই কলামে এই মিটিং সম্পর্কে কোনো কিছু লেখা যায়নি। তার কারণ মিটিংটি হয়েছে শনিবারে। আর আমাকে লিখতে হয়েছে শুক্রবারে। শনিবার সকালেও চেষ্টা করলাম সমাবেশের খবর নিতে। কিন্তু দেখা গেল যে বেলা দুইটার আগে মূল সমাবেশ শুরু হবে না। কিন্তু দুইটার মধ্যে আমাকে এই লেখা সংগ্রামে ইমেইল করে পাঠাতেই হবে। সুতরাং মিটিং সম্পর্কে কোনো খবর বা মন্তব্য ছাড়াই আমাকে এই লেখাটি লিখতে হলো। 

তবে শনিবার সকাল সাড়ে ১১ টার মধ্যে দেখা গেল নয়াপল্টন লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। তারপরেও মিছিল আসছেই। অতএব ধারণা করি, এই সমাবেশ শুধুমাত্র বিরাটই হবে না, এটি একটি জনসমুদ্রে পরিণত হবে। গত ২৮ জুলাই নয়াপল্টনে বিএনপি যে মহাসমাবেশ করেছে সেখানে উপস্থিতি ছিল কারো মতে ৫ লক্ষ, কারো মতে ১০ লক্ষ। কিন্তু এবার জনসমাবেশ ৫ লক্ষ তো দূরের কথা, ১০ লক্ষকেও ছাড়িয়ে যাবে। এখানেই সরকারের মাথা নষ্ট হয়েছে। সারাদেশ থেকে শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে যেভাবে মানুষ আসতে শুরু করেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে এই জন¯্রােত উত্তরে শান্তিনগর এবং পশ্চিমে কাকরাইল মসজিদ পর্যন্ত ছাড়িয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ যে রকম লম্ফঝম্প করছিল সেটি তো সেই পুলিশ বাহিনীর জোরে। আওয়ামী লীগ হয়েছিল পুলিশ বাহিনীর হেলমেট বাহিনী। চট্টগ্রামের এক সমাবেশে বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেছেন, পুলিশ উইথড্র করে মাঠে আসুন। ১২ ঘন্টাও টিকতে পারবেন না। 

এবার বিএনপির এই মহাসমাবেশের পাবলিসিটি দিল কে? বিএনপি তো কোনো পাবলিসিটি দেয়নি। রাস্তা ঘাটে বা অলিতে গলিতে কোনো মাইক পাবলিসিটি শোনা যায়নি। আসলে বিএনপির জনসভার পাবলিসিটি দিয়েছে খোদ আওয়ামী লীগ। কথাটি কি সোনার পাথর বাটির মতো শোনা যায় না? যায়। তারপরেও সত্য। কারণ বিএনপির এই সভা নিয়ে আওয়ামী লীগ অগ্নিসন্ত্রাস, নাশকতা, ভাঙচুর ইত্যাদি কল্পকাহিনী বলে রাজনীতির বাজার এত গরম করে দিয়েছে এবং সরকারী দল বলে গণমাধ্যমেও ঐসব গরম গরম মন্তব্যকে এমন ফলাও করে প্রচার করেছে যে সেগুলো মানুষ পড়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছেন। মানুষের মধ্যে যে কেমন ভয় ঢুকেছিল তার প্রমাণ আমি নিজে। 

গত ২৭ অক্টোবর শুক্রবার ব্যক্তিগত কাজে আমাকে একটু বাইরে যেতে হয়েছিল। গিয়েছিলাম গুলশান ১ নাম্বারে। যাওয়ার সময় রাস্তা দেখলাম খুব ফাঁকা। ভাবলাম, জুম্মার কারণে হয়তো রাস্তা ফাঁকা। সেখান থেকে রওয়ানা দিলাম রাত ৮ টায়। ভাবলাম, অন্ততপক্ষে ঘন্টা দেড়েক লাগবে। কিন্তু আসার সময়ও দেখলাম রাস্তা ফাঁকা। ড্রাইভারকে কারণ জিজ্ঞেস করলাম। ড্রাইভার বলল, স্যার, বিভিন্ন জায়গায় র‌্যাব এবং পুলিশের চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। মানুষের গাড়ি এবং সিএনজি থামিয়ে চেক করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যাত্রীর মোবাইল নিয়ে চেক করা হচ্ছে। কেউ যদি সোজা সরল মনে বলছেন যে আগামীকালের (শনিবার) জনসভায় যোগদানের জন্য ঢাকায় এসেছেন তাহলে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে নাহলে, অন্যভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগরীর প্রায় দুই কোটি মানুষ নন-পলিটিক্যাল। তারা নিরীহ। চাকরি বাকরি বা ব্যবসা করে খান। তারা পুলিশের এই হয়রানির শিকার হতে চান না। 

॥ তিন ॥

আগেই বলেছি যে জনসভা থেকে পরবর্তী কী কর্মসূচী দেওয়া হলো সেটি জানার আগেই এই লেখাটি শেষ করতে হলো। সুতরাং সুনির্দিষ্টভাবে কর্মসূচীটি এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না। তবে যেটুকু জনান্তিকে শুনেছি, সেখান থেকে ধারণা করছি আগামী এক সপ্তাহেরও কম সময়ে একটি কঠোর কর্মসূচী আসছে। যে কর্মসূচী আসছে সেটা বেশ কঠোর হবে। সেই কর্মসূচীকে সরকারী দল এবং পুলিশ বাহিনী শান্তিপূর্ণ থাকতে দেবে না। বেগম খালেদা জিয়া যখন প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলেন তখন ১৯৯৪ থেকে ৯৬ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এই কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ যে আন্দোলন করেছে সেই আন্দোলন কোনো দিনও শান্তিপূর্ণ ছিল না। তারা ১৭৩ দিন হরতাল করেছে। এসব হরতালের মধ্যে কোনো কোনো হরতাল ছিল টানা লাগাতার ৪৮ ঘন্টা বা ৭২ ঘন্টা। তারা যাত্রী ভরা বাসে গান পাউডার ঢেলে আগুন লাগিয়েছে এবং ১১ জনকে হত্যা করেছে। তারা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর যে নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে এবারও সম্ভবত দানবীয় হত্যাকান্ড ঘটাতে চেয়েছিল। ২৮ অক্টোবরের আগের দুই তিনদিন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সমাবেশে ওবায়দুর কাদের, জাহাঙ্গির কবির নানক, মেয়র তাপস প্রমুখ নেতা তাদের কর্মীদেরকে লাঠি নিয়ে মিছিলে আসতে বলেছেন। আরো বলেছেন, লাঠি যেন মোটা হয়। 

ঠিক এমনই ঘটনা ঘটেছিল ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। তার কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের এক মিটিংয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে যদি তত্ত্বাবধায়কের প্রধান উপদেষ্টা বানানো হয় তাহলে তার কর্মীরা যেন লগি বৈঠা নিয়ে ঢাকায় আসে। তারা লগি বৈঠা নিয়ে ঢাকায় এসেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই সব লগি বৈঠা নিয়ে দিনের বেলা প্রকাশ্যে হামলা করেছিল বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে অনুষ্ঠানরত জামায়াতে ইসলামীর মিটিংয়ে। তার পরের ঘটনা সকলেই জানেন। ৬ জন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশের ওপর নৃত্য করেছিল। 

সেই দিন হয়েছে বাসি। দিন বদলে গেছে। অনেক হম্বিতম্বি করে বলা হয়েছিল যে বিএনপি এবং অন্যান্য দলকে মিটিং করতে দেওয়া হবে না। বিএনপিও ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছিল তারা নয়াপল্টনে মিটিং করবেই। সরকার বাধ্য হয়েছে নয়াপল্টনে পারমিশন দিতে। সরকার বিরোধী চলমান গণআন্দোলনে সরকারের এটিই প্রথম পরাজয় এবং সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রথম বিজয়। 

বিজয় সূচিত  হওয়া শুরু হয়েছে। সামনে যতদিন যাবে  ততই ফ্যাসিবাদ ও কর্তৃত্ববাদের দুর্গের একটির পর একটির পতন ঘটবে।

https://www.dailysangram.info/post/539290