২৬ অক্টোবর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১১:১৭

দণ্ডিতদের অযোগ্যতা

আদেশ নয় অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট

 

দণ্ডিতদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা  করে কোনো আদেশ দেননি হাইকোর্ট। হাইকোর্ট শুধু তার পর্যবেক্ষণে জানিয়েছেন, দুর্নীতির মামলায় দুই বছরের বেশি সাজা হলে সেই ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় ও নির্দেশনা অনুযায়ী হাইকোর্টের এই পর্যবেক্ষণ মান্য করা কারও উপর বাধ্যকর নয়। এছাড়া এনিয়ে উচ্চ আদালতে একাধিক রায় থাকায় তা নিয়ে জটিলতা দেখা দেবে ।

 

২০১৮ সালের ২৭শে নভেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলম সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ সংক্রান্ত বিষয়ে সংক্ষিপ্ত একটি রায় ঘোষণা করেছিলেন। পাঁচ বছর পর গত ২২শে অক্টোবর রোববার বিচারপতিদের পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘দুর্নীতির মামলায় দুই বছরের বেশি সাজা পাওয়া আসামি সাংবিধানিকভাবেই সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। জামিন বা সাজা স্থগিত থাকলেও দণ্ডিত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, যদি তার সাজা উপযুক্ত আদালতে বাতিল না হয়। আপিল বিচারাধীন থাকা মানে দণ্ডিত ব্যক্তি নির্দোষ নন।’

বিএনপি’র পাঁচ নেতা দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে তাদের যে সাজা দেয়া হয়েছিল তা স্থগিতের আবেদন করেছিলেন। তারা ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৪২৬ ধারায় এবং ৫৬১-ক ধারায় এ আবেদন করেন। তাদের এই আবেদন হাইকোর্ট প্রত্যাখ্যান করেন।

কিন্তু হাইকোর্ট আবেদনের মূল বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে সংসদ সদস্য যোগ্যতা এবং অযোগ্যতার প্রশ্নে কতিপয় মন্তব্য করেন। হাইকোর্ট একই সঙ্গে তার পর্যবেক্ষণে দুর্নীতি মামলায় তাদের অপরাধকে নৈতিক স্খলনজনিত অপারাধ হিসেবে অভিমত দেন। তবে মামলায় এ সংক্রান্ত কোনো ইস্যু গঠিত হয়নি এবং তা পরীক্ষার জন্য আদালত কোনো নোটিশও দেননি। বিষয়টি ছিল একটি সাংবিধানিক ইস্যু। উক্ত আদালত সাংবিধানিক বিষয় পরীক্ষার জন্য কোনো উপযুক্ত আদালত ছিল না। এটি ছিল দুর্নীতি দমন আইন সংক্রান্ত একটি ফৌজদারি আপিল আদালত। আদালতের সামনে যে আবেদনটি উত্থাপিত হয়েছে তা একটি ফৌজদারি আবেদন। ফৌজদারি আবেদনে সাংবিধানিক বিষয় নিয়ে (যা ছিল রিট আবেদনের বিষয়বস্তু) আদালত কতিপয় অভিমত দেন। যে কোনো বিষয়েই আদালতের অভিমত দেয়ার প্রচলন আমাদের বিচারব্যবস্থায় আছে। তা এখতিয়ারবিহীনও  নয়। কিন্তু এই অভিমত কারও প্রতি বাধ্যকর নয়। অর্থাৎ আদালতের এই অভিমত মান্য করতে কোনো কর্তৃপক্ষ বাধ্য নয়।

এ প্রসঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের রায় ও নির্দেশনা আছে। সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগে মওদুদ আহমদ বনাম রাষ্ট্র মামলার রায়ে এ বিষয়ে নির্দেশনা আছে। যা  ৬৮ ডিএলআর-এ প্রকাশিত হয়েছে। ওই রায়ে বলা আছে আবেদনে উত্থাপিত মূল বিষয়বস্তু বা ইস্যুর বাহিরে কোনো রায়, নির্দেশনা, অভিমত কারও প্রতি বাধ্যকর নয়। আপিল বিভাগের রায়ে ‘আউট অফ কনটেক্স’ (বিষয়বস্তু বাহিরে) কোনো নির্দেশনা না দিতে হাইকোর্ট বিভাগকে বারিত করেছে।

আলোচ্য মামলায় সাংবিধানিক বিষয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু অভিমত দিয়েছেন। বিশেষ করে দুর্নীতির মামলায় কোনো ব্যক্তি দুই বছরের বেশি দণ্ড হলে নির্বাচনে অযোগ্য হবেন আর দুর্নীতি দমন আইনের সকল অপরাধকে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ বলে গণ্য করেছেন। এই দু’টি সাংবিধানিক বিষয় নিষ্পত্তির জন্য কোনো রুল ইস্যু হয়নি এবং এই আদালতে এই ইস্যু নিষ্পত্তির জন্য উপযুক্ত আদালতও ছিলেন না।
আমাদের আইনে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ কি তার কোনো সংজ্ঞা নেই। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের মামলায় নৈতিক স্খলনজনিত যে অপরাধের কথা বলা হয়েছে তা জনতা টাওয়ার মামলার উপাদানের ওপর ভিত্তি করে আদালত সিদ্ধান্ত পৌঁছেছিলেন। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একাধিক রায় রয়েছে। একেকটি মামলায় একেক ধরনের সিদ্ধান্ত আছে। দুর্নীতি দমন আইনে  তফসিলভুক্ত সকল  অপরাধ একই প্রকৃতির নয়। তাছাড়া এরশাদের অপরাধ নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ কিনা তা নির্ধারণের জন্য আদালত যথাযথ প্রক্রিয়ায় রুল ইস্যু করে তা পরীক্ষা করেছেন। আলোচ্য মামলার ক্ষেত্রে তা হয়নি।

সুতরাং দুর্নীতির অপরাধের দায়ে কেউ দণ্ডিত হলেই এবং সেই রায়ের কার্যকারিতা আপিলে স্থগিত হোক বা না হোক, তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন কিনা তা একটি সাংবিধানিক এবং আইনগত প্রশ্ন। এ প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামের বইয়ে তিনি লিখেছেন- ‘ব্যাপক অর্থে সব ধরনের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সঙ্গেই নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ জড়িত। কিন্তু এখানে নৈতিক স্খলন সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, অন্যথায় এর ব্যবহার অর্থহীন হয়ে পড়বে। নৈতিক স্খলন নিশ্চিত করতে হলে দুরাচারত্ব বা ডিপ্রাবেটির উপাদান দেখাতে হবে। তিনি, নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের তিনটি মাপকাঠি চিহ্নিত করেছেন; সাধারণভাবে তা বিবেক বা সমাজকে আঘাত দিয়েছে কিনা? অপরাধ করার উদ্দেশ্য নিয়েই ঘটনাটি ঘটানো হয়েছিল কিনা? অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি সমাজের চোখে নীতিবিবর্জিত (ম্যান অব ডিপ্রেব ক্যারেক্টার) কিংবা সমাজ তাকে খাটো করে দেখে (লুকড ডাউন) কিনা। এসবের উত্তর ইতিবাচক হলে কোনো ব্যক্তির নৈতিক স্খলন ঘটেছে। সুতরাং নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ নির্ধারণ করতে হলে প্রতিটি  মামলার বিষয়বস্তু আলাদা করে পরীক্ষা করতে হবে। বিএনপি’র পাঁচ নেতার মামলায় তা পরীক্ষা করা হয়নি।

https://mzamin.com/news.php?news=80286