২৬ অক্টোবর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৫

এজলাসে কাঠগড়ার বদলে লোহার খাঁচা

 

ঢাকার নিম্ন আদালতের এজলাস কক্ষে কাঠগড়ার (কোমর পর্যন্ত কাঠের বেস্টনি) বদলে লোহার খাঁচা ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব পিঞ্জর বা লোহার খাঁচায় মামলার শুনানির সময় আসামিদের রাখা হয়। শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে খাঁচার মধ্যেই থাকতে হয় দীর্ঘ সময়। এদিকে কাঠগড়া উঠিয়ে লোহার খাঁচা রাখার আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। লোহার খাঁচা অপসারণ করতে ইতোমধ্যেই সরকারকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের দশ আইনজীবী। নোটিশ পাওয়ার ৪ সপ্তাহের মধ্যে আদালতের এজলাস কক্ষ থেকে লোহার খাঁচা অপসারণ করার অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যথায় মৌলিক অধিকারের সুরক্ষার্থে হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করা হবে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই অভিযুক্তকে প্রকাশ্য আদালতে লোহার খাঁচায় বন্দি করে নিরপরাধ ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার ভঙ্গ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের প্রচলিত আইন এবং আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের পরিপন্থি। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, আদালতে উপস্থিত সবার নিরাপত্তার স্বার্থেই কাঠগড়ার বদলে লোহার খাঁচা ব্যবহার করা হচ্ছে।

নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে লোহার খাঁচা করা হয়েছে জানিয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আব্দুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, আসামিরা অনেক সময় কাঠগড়াতে খারাপ আচরণ করেন। বিচারকের দিকে অনেক কিছু ছুড়ে মারেন। বিষয়গুলো মাথায় রেখে কাঠের কাঠগড়া বাদ দিয়ে লোহার কাঠগড়া বানানো হয়েছে। আগে কাঠগড়া উন্মুক্ত ছিল আর এখন পুরোটাই বেস্টনি দেওয়া হয়েছে।

এজলাস কক্ষে কাঠগড়ার বদলে লোহার খাঁচা বা পিঞ্জিরায় আসামি রাখা সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের সম্পূর্ণ পরিপন্থি বলে মনে করেন বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সংবিধানে বলা আছে, আসামিকে শুধু নির্যাতন করা যাবে না তাই না, তার সঙ্গে অমানবিক, নিষ্ঠুর ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহার করা যাবে না। তিনি বলেন, যে দেশে গণতন্ত্র যত সংকুচিত সেই দেশে অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে বর্বরতা এবং কঠোরতা বাড়ে।

সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আমাদের আদালতগুলোতে ব্রিটিশ আমল থেকেই ‘সাক্ষীর কাঠগড়া’ রয়েছে। ব্রিটিশরা যেসব আইন-কানুন করে গেছে-তা বহু গবেষণা করেই করেছে। হঠাৎ করে আবেগের বশীভূত হয়ে এগুলো ফেলে দেবেন, আর ফেলে দিলে কি পরিস্থিতি হবে-তা ভাবা দরকার। ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে। যেভাবে আইনের বিধান আছে সেভাবেই করা উচিত। ইচ্ছামতো কিছু করা ঠিক হবে না।

দশ আইনজীবীর পক্ষে নোটিশটি পাঠান অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার নিম্ন আদালতের অন্তত ১৭টি এজলাস কক্ষে কাঠগড়ার বদলে লোহার খাঁচা ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়রা জজ আদালতের বিভিন্ন এজলাস কক্ষ উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, দেশি-বিদেশি আইন, আন্তর্জাতিক বিধিবিধান ও উচ্চ আদালতের নজিরগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, আদালতে কাঠগড়ার পরিবর্তে লোহার খাঁচা ব্যবহার অমানবিক। এর আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে সরকারকে দশজন আইনজীবী আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন।

১৬ অক্টোবর রেজিস্ট্রি ডাকে আইন সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর এ চিঠি পাঠানো হয়। নোটিশে বলা হয়, দেশের সিংহভাগ আইন ও আদালতের ব্যবস্থা এবং অবকাঠামো ব্রিটিশ শাসনামলে তৈরি। আদালতে অভিযুক্ত হাজিরার জন্য কাঠগড়ার প্রচলন ব্রিটিশ আমলেই শুরু হয়। তবে দুর্ধর্ষ আসামি, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করানো হতো। বিচার শেষে দোষীকে লোহার খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়েছে এমন ইতিহাস আছে। কিন্তু বিচার চলাকালীন আদালতে লোহার খাঁচায় বন্দি করে রাখার কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। ভারতেও সাধারণ আদালতের কাঠগড়ায় লোহার খাঁচার ব্যবহার নেই। আমাদের দেশের কোনো আইনে কাঠগড়ায় লোহার খাঁচার ব্যবহার নিয়ে কোনো বিধান নেই।

তবে কারা আইন, ১৮৯৪ এর ৫৬ ধারামতে জেলে বন্দি কয়েদিকে সরকারের অনুমোদনক্রমে লৌহ-শৃঙ্খলে আটক করে রাখার বিধান আছে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই অভিযুক্তকে প্রকাশ্য আদালতে লোহার খাঁচায় বন্দি করে অভিযুক্ত ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার ভঙ্গ করা হচ্ছে। যা একই সঙ্গে দেশের প্রচলিত আইন এবং আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের পরিপন্থি।

নোটিশ দেওয়া ১০ আইনজীবী হলেন-জিএম মুজাহিদুর রহমান, মুহাম্মদ মিসবাহ উদ্দিন, মো. জোবায়দুর রহমান, মোহাম্মদ নোয়াব আলী, আজিমুদ্দিন পাটোয়ারী, মোহাম্মদ সাজ্জাদ সারোয়ার, মো. মুজাহিদুল ইসলাম, মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন, মোহাম্মদ মিজানুল হক ও আবদুল্লাহ সাদিক।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/732908