২৬ অক্টোবর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১০:৩০

অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের বিশ্লেষণ

নবম শ্রেণীতে বিভাগ না থাকলে উচ্চশিক্ষার ভিত হবে নড়বড়ে

 

আসন্ন ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণীতে বিভাগ বিভাজন তুলে দেয়ার ঘোষণায় শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষার্থীরা নিজেদের মেধাকে তার পছন্দমতো দিকে ধাবিত করতে না পারলে উচ্চশিক্ষার ভিত হবে নড়বড়ে- এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন অভিভাবকরা। এ ছাড়া একাদশ শ্রেণী থেকে বিভাগ বিভাজনের সুযোগ যেহেতু থাকবেই তাহলে নবম শ্রেণীতে কেন নয়- এমন প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। অন্য দিকে পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দেয়ায় ছাত্রছাত্রীরা আগের মতো পড়ালেখায় মনোযোগী হচ্ছে না বলেও অভিযোগ শিক্ষক ও অভিভাবকদের।

গত সোমবার ঘোষণা দেয়া হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী আগামী বছর (২০২৪ সালে) থেকে নবম শ্রেণীতে বিভাগ (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা) বিভাজন থাকছে না। যদিও এ কথা আগেই জানানো হয়েছিল। এবার এ বিষয়ে মাঠপর্যায়ে পত্র জারির প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে সোমবার চিঠি দিয়ে এ অনুমোদনের বিষয়টি জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। এর মানে হলো নবম শ্রেণীতে বিভাগ তুলে দেয়ার এটি এখন আনুষ্ঠানিকতা পেল।


অবশ্য এর আগে গত জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। আগামী বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে তা শুরু হবে। এরপর ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণীতে চালু হবে। উচ্চমাধ্যমিকে একাদশ শ্রেণীতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। সরকারের সিদ্ধান্ত হলো নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে আগামী বছর থেকে নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো বিভাগ বিভাজন থাকবে না। সব শিক্ষার্থীকেই মাধ্যমিক পর্যন্ত অভিন্ন বিষয় পড়তে হবে। বিভাগ বিভাজন হবে উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে। চলতি বছর পর্যন্ত নবম শ্রেণীতে ঠিক হয়েছে কোন শিক্ষার্থী কোন বিভাগে পড়বে।
নবম শ্রেণীতে বিভাগ তুলে দেয়ার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিনেট সদস্য অধ্যাপক এ বি এম ফজলুল করীম গতকাল সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই পড়াশোনায় মনোযোগী নয়। এরপরে যদি নবম শ্রেণীতে বিভাগ তুলে দেয়া হয় তাহলে উচ্চ শিক্ষা অর্জনে তারা পদে পদে হোঁচট খাবে। অন্য দিকে পরীক্ষা তুলে দেয়ার পর থেকে অনেক অভিভাবকও তাদের সন্তানদের পড়াশোনা নিয়ে বেশ শঙ্কিত। পরীক্ষা না থাকায় শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই হচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেক জায়গাতেই অভিভাবকরা রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করে প্রতিবাদ করছেন।


এই শিক্ষাবিদ আরো বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সব ধর্মের শিক্ষার্থীদের জন্যই ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা জরুরি; অন্যথায় তারা সেকুলার শিক্ষার দিকে ধাবিত হবে। নৈতিক শিক্ষা ছাড়া একজন শিক্ষার্থী শুধু নামেই মাত্র সার্টিফিকেট অর্জন করতে পারে কিন্তু আদতে তার জন্য শিক্ষা কোনো কাজে আসবে না এবং সে প্রকৃত অর্থে মেধাবী হিসেবে গড়েও উঠবে না। তাই ইসলামিক স্কলার ও সাধারণ শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে শিক্ষা নীতি প্রণয়নেরও দাবি জানান এই শিক্ষক নেতা।

অন্য দিকে সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলন নয়া দিগন্তকে বলেন, বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থার সাথে তাল মেলাতে না পারলে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে। তিনি উল্লেখ করেন, বর্তমানে যে শিক্ষা কাঠামো সরকার বাস্তবায়ন করতে চাইছে এটা আমরা ২০০১ থেকে ২০০৬ সালেই আরো নতুন উদ্যোমে নতুন কাঠামোতে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অনেক দেরিতে বুঝতে পারছে। তিনি বলেন, সরকার যদি বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে তাল মেলাতে না পারে এবং সেই অনুযায়ী আমাদের শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে না পারে তাহলে আমরা এবং আমাদের শিক্ষার্থীরাও বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।


মাধ্যমিকের নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকের মতো আলাদা বিভাগ না থাকা নিয়ে আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। আদেশ জারির পর থেকে এটি নিয়ে নানান মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ আদেশ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট থেকে এক পোস্টের মাধ্যমে তিনি এই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।


তিনি লিখেছেন, ২৩ অক্টোবরকে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো দিবস হিসেবে চিহ্নিত হবে এক দিন। এখন থেকে নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা নামে কোনো বিভাজন থাকবে না। বিভাজন না থাকার অর্থ কি সমতা এবং সাম্যতা? আর সমতা এবং সাম্যতা মানেই কি মঙ্গলজনক? সাম্য ও সমতা শব্দটি দু’টি শুনতে একই মনে হলেও বাস্তবে এদের মধ্যে বিশাল ফারাক। ‘সাম্য মানে বয়ঁরঃু আর সমতা মানে বয়ঁধষরঃু এই বিভাজন উঠিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সমতা আনলাম বটে সাম্যতার কী হবে? তিনি আরো লিখেছেন মানুষের কৌতূহল; মনোযোগ, বুদ্ধি, সুবিধা, আগ্রহ, আকর্ষণ ইত্যাদি এক না। কারো ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি বিশেষ প্রতিভা দেখা যায়, কারোবা সঙ্গীতে, কারো গণিতে। সপ্তম শ্রেণী থেকেই কার কোন দিকে ঝোঁক এইটা পিতা মাতা ও শিক্ষকদের খেয়াল করা উচিত। নবম শ্রেণী এসে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যায়।

সবাইকে ঘাড়ে ধরে একই বিষয় পড়াতে বাধ্য করে মন্ত্রীরা এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, মানুষের স্বভাবজাত যেই বিভাজন আছে তাকে অস্বীকার করা হলো। যেই বয়সে ছেলেমেয়েদের প্রিয় বিষয় আবিষ্কারের সময় সেই সময়েই প্রিয় হওয়ার সুযোগটাই নাই করে দিলো। উচ্চতর গণিতকে নাই করে দিলো। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের মতো তিনটি ভিন্ন বিষয়কে এক করে একটি বিষয় বানানো হলো। এর ফলে কোনো সাবজেক্টকেই একটু গভীরে গিয়ে বোঝার বা জানার সুযোগ প্রতিটি বিষয় থেকে ৩ ভাগের ২ ভাগ কমে গেল। এই ৪০০ নম্বরের চারটি আলাদা বিষয়ের পরিবর্তে ১০০ নম্বরের বিজ্ঞান পড়বে এরা ভবিষ্যতে বিজ্ঞানকে কিভাবে দেখবে? নিশ্চিতভাবে বিজ্ঞান নিয়ে ভয় ঢুকে যাবে। উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে বিজ্ঞান নিয়ে সেখানে কোপ করতে হাবুডুবু খাবে। কয়েক বছরের ছেলেমেয়েদের হাবুডুবু খাওয়া দেখে এর পর থেকে বিজ্ঞান নেয়াই অনেকে ছেড়ে দেবে।


নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি। তিনি বলেছেন বাতিলের দাবিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন করছেন অভিভাবকরা। তাদের দাবি, নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করায় বইয়ের সাথে দূরত্ব বাড়ছে শিক্ষার্থীদের। নির্বাচনের আগে এ ধরনের আন্দোলনকে ভিন্নভাবে দেখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাই আন্দোলনকারী অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের দিকে নজর রাখতে শিক্ষকদের ডেকে নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি। সম্প্রতি নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সমস্যা ও উত্তরণের উপায় নিয়ে ঢাকা অঞ্চলের ১১ জেলার প্রায় পাঁচ শ’ প্রধান শিক্ষকের সাথে ভার্চুয়ালি বৈঠকে এ নির্দেশনা দেন মন্ত্রী। পর্যায়ক্রমে সব অঞ্চলের প্রধান শিক্ষকের সাথেই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সভা হবে বলে জানা গেছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/786809