২৬ অক্টোবর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১০:২৩

২৮ অক্টোবর ঘিরে ব্যাপক ধরপাকড়-তল্লাশি 

রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দকে গতকাল বুধবার সকালে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর আগে মঙ্গলবার রাত ১১টা থেকে তার বাসা ঘিরে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মতিউর রহমান আকন্দের স্বজনরা জানান, তিনি একজন গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি, যার ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়েছে। ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। তাকে নাশকতার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হলে কারাগারে পাঠানো হয়। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি। আর এজন্য সর্বোচ্চ লোক জমায়েতের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এই ঘোষণার পর থেকেই নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও বাসাবাড়িতে তল্লাশি শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এমনকি গ্রেফতার আতঙ্কে অনেক নেতা-কর্মী এখন বাড়িতেও থাকছে না বলে জানা গেছে। মহাসমাবেশ ও সামনের কর্মসূচি ঘিরে সারা দেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অনেকটা নীরবে গ্রেপ্তার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। 

বিশেষ করে জামায়াত-বিএনপি ও এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতিদিনই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্বশেষ গত ৭ দিনে সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের সহ¯্রাধিক নেতা-কর্মীকে আটকের পর নতুন ও পুরাতন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া বাসায় বাসায় তল্লাশি-হয়রানি, ভয়ভীতি দেখানো, জামিন পাওয়ার পরও অন্য মামলা গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ বিএনপির নেতাকর্মীদের। এ নিয়ে জামায়াত-বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিরোধী দলগুলোর দাবি, মহাসমাবেশ ঘিরে নতুন করে ধরপাকড় শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুধু রাজধানী নয় সারা দেশে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার চলছে। দেয়া হচ্ছে নামে-বেনামেও মামলা। অনেককে দুই-তিন দিন বা তারও আগে গ্রেপ্তার করলেও তা প্রকাশ করছে না পুলিশ। সব মিলিয়ে এক আতঙ্কের মধ্যে আছেন নেতাকর্মীরা। গ্রেপ্তার ভয়েও নেতাকর্মীরা বাসাবাড়িতে ঘুমাতে পারছেন না। তবে পুলিশি ধরপাকড়, সরকারের বাধা ও উসকানি এড়িয়ে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ সফল করতে নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকমান্ড। পুলিশ বলছে, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশ রয়েছে। তাই রাজপথে ত্রিমুখী রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সহিংসতায় আশঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন গোয়েন্দারা। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা নতুন কৌশলে নীরবে ধরপাকড় অভিযানে নেমেছে। চলমান অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ধরপাকড় না করে তৃণমূলের সক্রিয় কর্মীদের আটকের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। যাতে তাদের গ্রেপ্তারে রাজনৈতিক অঙ্গন সহসা সরগরম হয়ে না ওঠে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিয়ে পরে সময় সুযোগ বুঝে এ অভিযান জোরদার করা হবে বলে পুলিশের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে নিত্যনতুন গায়েবি মামলা, পুরোনো নাশকতার ঘটনায় সম্পৃক্ততা, সন্দেহভাজন কিংবা নাশকতার পরিকল্পনার কথিত অভিযোগ এনে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ে কৌশলী অভিযান জোরদার করা হলে হিতে বিপরীত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। 

এদিকে বিএনপির আগামী ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচিতে বাধা না দিতে সরকার ও প্রশাসনকে হুঁশিয়ার করেছেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, এই সমাবেশ শুধু নয়াপল্টনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, সারা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়বে। মহাসমাবেশ পল্টনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, সারা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়বে হুশিয়ারী বিএনপি নেতাদের। গতকাল রাজধানীর তোপখানা রোডে জনতার অধিকার পার্টির আলোচনা সভায় এ কথা বলেন বিএনপি নেতারা। সভায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম বলেন, ২৮ তারিখ বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে কাউন্টার প্রোগ্রাম দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। গত ১৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিএনপির নানা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দলটির ১২ হাজার ৯৩০ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৪৯টি নতুন মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৬২০ জনের বেশি ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। সোমবার রাজধানীর নয়া পল্টনে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য জানান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। তিনি জানান, গত ২৮ ও ২৯ জুলাই থেকে সারা দেশে বিএনপির মোট ১ হাজার ৯৯০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। মামলা ৩৯৫টি, গ্রেফতার ২ হাজার ৯৭৫ জন, আসামি করা হয়েছে ২৬ হাজার ৫০ জনকে।

অন্যদিকে রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার আতঙ্কে আছেন। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে গ্রেপ্তার আতঙ্কে মায়ের জানাজা পড়তে পারেননি উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব গাজি নিজাম উদ্দিন। সাদা পোশাকে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি জানাজার আগে চলে যান।দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর শুক্রবার রাতে নিজাম উদ্দিনের মা মাহমুদা খানম (৭৩) মারা যান। গত শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় নিজ বাড়িতে তার জানাজার আয়োজন করা হয়। মায়ের জানাজার ২০ মিনিট আগে বাড়িতে উপস্থিত হন নিজাম উদ্দিন। তার উপস্থিতির খবর পেয়ে জোরারগঞ্জ থানার বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য সাদা পোশাকে অবস্থান নেন জানাজার মাঠে। জানাজার পর গ্রেপ্তার করা হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে মায়ের জানাজা না পড়েই স্থান ত্যাগ করেন গাজী নিজাম। এ সময় নেতাকর্মীরা তাকে নিরাপত্তা দিয়ে এলাকা পার করে দেন। মীরসরাই উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, গাজী নিজাম উদ্দিন মায়ের জানাজা পড়তে উপস্থিত হওয়ার পর পুলিশ সাদা পোশাকে অবস্থান নিলে তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে সটকে পড়েন। আওয়ামী সরকারের পুলিশ বাহিনী এখন জানাজা পড়তেও বাধা দিচ্ছে আমাদের নেতাকর্মীদের। জোরারগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জাহিদ হোসেন বলেন, বিএনপি নেতার মায়ের জানাজার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। ওটা শুনেছি রাতে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে থানাজুড়ে পুলিশ সাদা পোশাকে ডিউটি করেছে। তিনি যেহেতু হত্যা মামলার আসামি, হয়তো ভয় কাজ করেছে। তবে জানাজায় উপস্থিত থাকলে গ্রেপ্তারও হতে পারতেন, যেহেতু তিনি আসামি।

এছাড়া খুলনায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ১২ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার রাতে জেলার সাতটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন- খুলনার ফুলতলা উপজেলার জামিরা ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি জিয়াউর সরদার, জামিরা ইউনিয়ন যুব দলের সদস্য আব্দুল্লাহ খান, রূপসা উপজেলা ছাত্র দলের সাবেক সভাপতি এস এম বোরহান উদ্দিন, ৪ নং টিএসবি ইউনিয়ন যুব দল নেতা মো. সাগর সরদার, বটিয়াঘাটা উপজেলা যুব দল নেতা শাহারিয়ার আলম বাপ্পী খান, বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়ন বিএনপি নেতা আখতার শেখ, তেরখাদা উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি লস্কর আবুল কালাম, উপজেলা যুব দলের আহ্বায়ক মোল্লা হুমায়ুন কবির, ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুরঘোনা ইউনিয়ন বিএনপি সদস্য সচিব আশরাফুল, খর্নিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাসেম মেম্বার, কয়রা উপজেলা যুব দলের আহ্বায়ক শরিফুল আলম ও দিঘলিয়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক রাজু আহম্মেদ। খুলনা বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব মিজানুর রহমান মিল্টন জানান, রাতে খুলনা জেলার সাতটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশকে ঘিরে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ বিষয়ে খুলনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান বলেন, যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা বিভিন্ন মামলার আসামী।

 

https://www.dailysangram.info/post/539078