২৬ অক্টোবর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১০:১৯

আশা ও আশঙ্কার দিন

-ড. আবদুল লতিফ মাসুম

 

আশা ও আশঙ্কার মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছে নাগরিক জীবন। বিগত কয়েক বছর ধরে নিরন্তর আন্দোলনে আছে সরকারবিরোধী শক্তি। আরো একটু শক্তভাবে বললে, বিগত দেড় দশকে গণতন্ত্রের সংগ্রাম ছিল অবিরাম। স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আশা-হতাশার ইতিহাস আছে। ২০১৪ সালে নির্বাচন পূর্ব দুর্বার আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে দুষ্টচক্রে। নিয়ম রক্ষার নির্বাচন বলে অনিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৮ সালে তিনি বলেছিলেন, আমায় বিশ্বাস করুন। জাতি তাকে বিশ্বাস করেছিল। তিনি জাতিকে হতাশ করেছেন। আশা-আশঙ্কার দোলাচলে আন্দোলন কখনো কখনো বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। নিপীড়ন-নির্যাতন, হামলা-মামলা ও গুম-খুনের মাধ্যমে তারা স্তব্ধ করতে চেয়েছে এই জাতিকে। শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করে বার বার আঘাত হেনেছে মানুষ। ছলে-বলে-কলে কৌশলে তারা জাতিকে প্রতারিত করেছে। গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে সন্ত্রাসের বদনাম দিয়েছে। শান্তির সংগ্রামকে অশান্তির আগুনে পরিণত করেছে। দেশের বিরোধী শক্তিকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বলে প্রমাণ করার অপপ্রয়াস নিয়েছে। শঠতা, ভাঁওতা ও মিথ্যাচার তাদের রাজনীতির অনিবার্য অংশ হয়েছে। দুর্নীতি ও দুঃশাসনে জর্জরিত হয়েছে দেশ। উন্নয়নের মহাসড়কের নামে দুর্নীতির সাগরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে দেশ। দুঃশাসনের দুষ্টচক্র বা সিন্ডিকেট লুটপাট ও দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া আস্ফালনে দুঃসহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। মানুষ দুঃখ, বেদনা ও ক্ষোভে উত্তপ্ত হয়ে আছে। বিরোধী শক্তিগুলো জনগণকে সাথে নিয়ে বিশেষত গত দুই বছর ধরে যে আন্দোলন পরিচালনা করছে তা এখন সাফল্যের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছে। একটি গণআন্দোলন গণবিস্ফোরণের আশায় উদ্বেল হয়ে আছে। ২৮ অক্টোবর ২০২৩ সেই আশা-আশঙ্কার দিন। একদিকে আন্দোলনরত জনতার শক্তি অপর দিকে সরকারি শক্তি মদমত্ততায় সরকার। বিরোধী শক্তির প্রতিভূ বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, জনতার বিজয় অত্যাসন্ন। অপর দিকে, শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রক্তপাতের ভয় দেখাচ্ছেন। তিনি বলছেন, পরিণতি হবে হেফাজতে ইসলামের চেয়েও করুণ। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশকে নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে মোকাবেলা করে আওয়ামী সরকার। অভিযোগ রয়েছে, শত শত মাদরাসা ছাত্র ও ওলামায়ে কেরাম ওই ঘটনা মৃত্যুবরণ করে। শাপলা চত্বর ও চারপাশের এলাকাগুলো রক্তের বন্যায় ভেসে যায়। অথচ সেদিন সরকার বলেছিল, মাত্র ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর বিরোধীজনরা বলেছিল, মৃত্যুর সংখ্যা অগণিত। এখন ওবায়দুল কাদেরের আস্ফালনে প্রমাণিত হয় সেই অসংখ্য মৃত্যুর কথা। ওবায়দুল কাদেরের এই দম্ভোক্তি প্রকাশ্য হত্যার নির্দেশের সামিল। এর মাধ্যমে ওবায়দুল কাদের দেশের আইন, সংবিধান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন।

 

বিএনপিসহ সব বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির সমীকরণ ঘটেছে ২৮ অক্টোবর। ডান, বাম ও ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো এক ও অভিন্ন কর্মসূচিতে রাজধানী অচল করে দেবে। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, সেদিন বিএনপি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে যাচ্ছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মহাসমাবেশ শেষে ঢাকার রাজপথ নিজেদের দখলে নেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান নিয়ে সারা দেশ থেকে রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। এ নিয়ে রাজধানীর সব থানা ও ওয়ার্ড নেতাকর্মীদের কাছে বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলে প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়। একই দিন পাল্টা সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। ওই দিন ঢাকার সবকটি প্রবেশমুখে সতর্ক অবস্থান নেবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু এভিনিউ অথবা বায়তুল মোকারোমের সামনে তথাকথিত শান্তি সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। গত বছরগুলোতে বিএনপি কর্মসূচি দিলেই সরকারি দল ঢাকা সরকারিভাবে একরকম অবরুদ্ধ করে দিত। সেখানে একতরফা শক্তি প্রয়োগের মহড়া ছিল। এখন তারা দু’ধারী কর্মসূচি নিয়েছে। সেদিনের মতো ঢাকার প্রবেশমুখ বন্ধ করে দিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি, এবার তারা বিরোধী শক্তিকে মুখোমুখি মোকাবেলা করার কর্মসূচি নিয়েছে। নাগরিক সাধারণ আশা ও আশঙ্কার মধ্যে আতঙ্কিত। মুখোমুখি কর্মসূচি দেয়ার ফলে রক্তপাতের সম্ভাবনা দেখছে বিশেষজ্ঞমহল। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বিএনপি সূত্র জানায়, সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করছে বিএনপির কর্মসূচি কোন দিকে মোড় নেবে। দাবি না মানলে এমনকি সরকার কঠোর হলে বিএনপিও বাঁচা-মরার লড়াই হিসেবে টানা কর্মসূচিতে যাবে। ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। ওই দিন রাজধানীতে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী হাজির করতে চায় দলটি। দেশের সবগুলো জেলা-উপজেলা থেকে নেতাকর্মীকে ঢাকায় আনতে ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল, শ্রমিক দল ও মহিলা দল, পেশাজীবী সংগঠনসহ অঙ্গদলগুলোকে মহাসমাবেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে আসার জন্য বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগরসহ জেলাগুলোতে প্রস্তুতি সভা শুরু হয়েছে। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত দু’ধাপে সাতটি বিভাগীয় রোডমার্চ ও সমাবেশ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। গত সপ্তাহে নয়াপল্টনে সমাবেশ থেকে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়। এর মধ্যে দাবি না মানলে তফসিলের আগ পর্যন্ত লাগাতার কর্মসূচি চলবে বলে জানা গেছে। বিএনপি নেতারা জানান, প্রথমে পদযাত্রা কিংবা ঘেরাও দিয়ে শুরু হতে পারে। এরপর ধারাবাহিকভাবে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও, গণভবন ঘেরাও, অবস্থান কর্মসূচি, আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকামুখী রোডমার্চ, সড়ক, রেল ও নৌপথ অবরোধের কর্মসূচি আসতে পারে। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে কর্মসূচির ধরনও পাল্টাতে পারে। তফসিল ঘোষণার দিন থেকে হরতাল-অবরোধের মতো হার্ডলাইন কর্মসূচিতে যেতে পারে বিএনপি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আগামী ২৮ অক্টোবর শনিবার ঢাকায় মহাসমাবেশ থেকে মহাযাত্রা শুরু হবে। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আর থেমে থাকব না। অনেক বাধা ও বিপত্তি আসবে। সেই সব বাধা ও বিপত্তি অতিক্রম করে মহাসমাবেশকে সফল করে জনগণের অধিকার আদায় করতে আমাদেরকে সামনে ছুটে যেতে হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, বিএনপির কর্মসূচি মানেই মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি। তাই যখনই তারা কোনো কর্মসূচি ঘোষণা দেয় তখনই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সতর্ক অবস্থানে থাকে। সামনে নির্বাচন। তাই নির্বাচন বানচাল করার চক্রান্ত শুরু করেছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। তারা কর্মসূচি দিয়ে সরকার হটানোর ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু জনগণ তাদের সাথে নেই। আমরা জনগণের শক্তি নিয়ে রাজপথে তাদের মোকাবেলা করব। তাই বিরোধীদের ২৮ অক্টোবরসহ সামনের সব কর্মসূচিতে ব্যাপক পরিসরে মাঠে নামার পরিকল্পনা করেছে আওয়ামী লীগ।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিএনপির ডাকা কর্মসূচির আড়ালে যদি কেউ সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করে তবে ডিএমপির পক্ষ থেকে তা কঠোর হস্তে দমন করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। মেট্রোরেলের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পাওয়া এমআরটি পুলিশের কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে রাজধানীর উত্তরা উত্তর মেট্রো স্টেশনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, দেশের সংবিধানে যেকোনো রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন, মিছিল-মিটিং সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে পুলিশ নিরাপত্তাও দিয়ে থাকে। ২৮ অক্টোবর নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য প্রসঙ্গে কোনো গোয়েন্দা তথ্য আছে কি না, জানতে চাইলে কমিশনার বলেন, আমরা নজরদারির ভেতরে রেখেছি। বিএনপির নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে আওয়ামী লীগ দৃশ্যত যুদ্ধংদেহি কর্মসূচি গ্রহণ করছে। পত্রিকান্তরের খবরে বলা হয় মাঠ নিয়ন্ত্রণের একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করবে আওয়ামী লীগ। গত ১০ ডিসেম্বরের মতো ২৮ অক্টোবরও একাধিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে তারা। এদিন প্রতিটি থানা-ওয়ার্ডে সতর্ক অবস্থায় থাকবেন ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এর বাইরে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসানো হবে সতর্ক পাহারা। প্রতিটি পাড়া-মহল্লার মোড়ে ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সামিয়ানা টাঙিয়ে সকাল থেকে অবস্থান নেবেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এর সাথে দলীয় সংসদ সদস্য ও কাউন্সিলররাও তাদের অনুসারীদের নিয়ে মাঠে থাকবেন। রাজধানীজুড়ে এমন অবস্থানের পাশাপাশি এ দিন মহাসমাবেশের মাধ্যমে বড় শোডাউন করবে দলটি। সব মিলিয়ে ২৮ অক্টোবর রাজনীতির মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকারি দল।

সরকারি দল হেফাজত ইসলামের মতো রক্তাক্ত অধ্যায় সৃষ্টি করার হুঁশিয়ারি দিচ্ছে বটে। তবে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের মাধ্যমে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল এবং নির্মম শক্তি প্রয়োগের যে সুযোগ তাদের সেদিন ছিল আজ আর তা নেই। বিরোধী শক্তিগুলোর কৌশলী আন্দোলনের ফলে তারা এখন বেকায়দায় রয়েছে। সেদিন তারা যেমন ‘মৌলবাদ’-এর উত্থানভীতি প্রদর্শন করেছিল এবারে তার বিপরীত অবস্থা বিরাজ করছে। সেদিন জ্বালাও পোড়াওয়ের যে ভীতিকর পরিস্থিতি তারা উল্লেখ করতে পেরেছে, এবার তা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, কোনো বদনামকে যাতে পুঁজি করতে না পারে সেজন্য বিএনপি ও এর সহযোগী শক্তিগুলো সতর্ক ছিল। মানুষের ক্ষোভ ও ক্রোধকে কঠোরতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে বিএনপি ও তার সঙ্গীরা। এ ছাড়া এবার এমন এক বৈশ্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে আওয়ামী সরকারকে যা অতীতে হয়নি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশের মানুষই শুধু প্রতারিত হয়নি; বরং আন্তর্জাতিক বিশ্ব প্রতারিত হয়েছে। ফলে এবার যখন তারা ‘বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে’ বলে চিৎকার করছে, ওদিকে কোনো সাড়া মিলছে না। বিগত দেড় দশকের আমলনামা পাশ্চাত্য ভালো করেই রেকর্ড করেছে। এখন সময় ও সুযোগ বুঝে তারা বারবার নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুযোগ নিচ্ছে।
জনগণই যদি শক্তির উৎস হয় তাহলে ২৮ অক্টোবর তাদের আশা করার কারণ রয়েছে। ঢাকা শহর যেভাবে জনতার প্লাবনে প্লাবিত হওয়ার কথা তা স্বৈরশক্তিকে উৎখাত করবে নিশ্চিতভাবেই। অপর দিকে, তারা যদি রক্তপাতের নির্মম নিকৃষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়, সেটিই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। কারণ রক্ত কখনো বৃথা যায় না। রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়। আজকে জনগণের উচ্চারণ হোক, ‘বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার তোমার ঘুঘু বধিবো পরাণ।’
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com

 

 

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/786758