২৫ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার, ৮:৫৯

নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার

আলোচনাতেই সমাধান দেখছেন আইনবিদরা

 আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থা নিয়ে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে। দেশের প্রধান দু’টি দলের মধ্যে বিরোধপূর্ণ অবস্থান রাজনীতিতে সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। এক দিকে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলো। এ দাবিতে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ করতে যাচ্ছে বিএনপি। ওই দিন ঢাকায় বিপুল জনসমাবেশ ঘটাতে চায় দলটি। অপর দিকে ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিন ঢাকার গুলিস্তান ও এর আশপাশের সড়ক নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তারা রাজপথে নেতাকর্মীদের বড় ধরনের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় ওই দিন। রাজপথে দুই দলের শক্তি প্রদর্শন নিয়ে সারা দেশেই উত্তাপ ও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের ব্যবস্থা না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে আইনবিদরা মনে করেন। বর্তমান অবস্থায় দেশকে সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে না দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চান তারা।

 

আইনবিদদের মতে, বর্তমান সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট আইনি ব্যবস্থা নেই। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ১৪ দলীয় জোট এবং জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নিয়ে একটি ছোট আকারে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় আগের সরকারই বহাল থাকে। এমনকি মন্ত্রিসভার আকার ছোট করাও হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী বিগত দু’টি নির্বাচনে সরকার গঠিত হয়েছিল। বর্তমানে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে। এ অবস্থায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে সংবিধানের মধ্য থেকে কোনো সমাধান দেখছেন না আইনবিদরা। তাদের মতে আলোচনার মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান হতে পারে।

বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বর্তমান সরকারের পদত্যাগ দাবি এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। সরকারি দল বলছে, এই দাবি মানার কোনো সুযোগ নেই এবং সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন হবে। এমনকি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ক্ষেত্রে আলোচনার বিষয়ও নাকচ করে দিয়েছে সরকার।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত ১৫ অক্টোবর বলেন, নির্বাচন নিয়ে সংবিধান বা প্রচলিত আইনে যা আছে, তার বাইরে কোনো সংলাপ হতে পারে না। সংবিধান ও আইন মেনে যদি কেউ নির্বাচনে আসে, তাহলে আলোচনারও প্রয়োজন থাকে না।

অন্য দিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থবহ সংলাপে বসতে বলেছে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, তারা যে কথাগুলো বলেছেন, তার প্রায় সব আমরা মেনে ফেলেছি। আরেকটি কথা, দেশে একটি সংবিধান আছে এবং সেই সংবিধানে বলা আছে নির্বাচন কিভাবে হবে। দেশে আইনও আছে। সংবিধান ও আইন মেনে নির্বাচন হবে। সংবিধানের বাইরে বা প্রচলিত আইনে যা আছে, তার বাইরে কোনো সংলাপ হতে পারে না। সংবিধান ও আইন মেনে যদি কেউ নির্বাচনে আসে, তাহলে কিন্তু আলোচনারও প্রয়োজন থাকে না। এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে কী সমাধান হতে পারে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উভয় পক্ষ যদি মনে করেন আলোচনায় বসলে সমস্যার সমাধান হতে পারে, তাহলে আলোচনা হতে তো কোনো সমস্য নেই।

অন্য দিকে এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবু উদ্দিন খোকন বলেন, সরকারের ভয় কী, ১৫ বছরে তারা অনেক উন্নয়ন করেছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি শুধু বিএনপির না, এটা দেশের সাধারণ মানুষেরও দাবি। এই দাবি মানতে হবে। তা না হলে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করে যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় করেছে, আমরাও সেরকম আন্দোলন করে দাবি আদায় করব ইনশাআল্লাহ।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক সিনিয়র আইনজীবী মহসিন রশিদ বলেন, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়ে সংবিধানে কোনো সমাধান নেই। রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতা না থাকায় সমাধানের পথ নেই। যদি সব দল সংলাপে বসেন তা হলেই একটি সমাধানের পথ বের হতে পারে। এ ছাড়া রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় করতে হবে। আওয়ামী লীগের আন্দোলন ও দাবির মুখে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন হয়েছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ২০১১ সালে এ ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের একটি রায়ের ভিত্তিতে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।

নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে যা বলা আছে সংবিধানে : সংবিধানে সপ্তম ভাগে ১২৩ অনুচ্ছেদে নির্বাচন প্রসঙ্গে দু’টি বিষয় উল্লেখ রয়েছে। সেটি হলো, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে।’
‘তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ-সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।

(৪) সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদের কোনো সদস্য পদ শূন্য হইলে পদটি শূন্য হইবার নব্বই দিনের মধ্যে উক্ত শূন্যপদ পূর্ণ করিবার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে : তবে শর্ত থাকে যে, যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতে, কোন দৈব-দুর্বিপাকের কারণে এই দফার নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হয়, তাহা হইলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’

এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, সংবিধানে নির্বাচনের সময় সংক্রান্ত দুটো বিধান আছে। একটা হলো সংসদ ভেঙে দিলে। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেশে রাষ্ট্রপতি যেকোনো সময় সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। সংসদ ভেঙে দিলে ভেঙে যাওয়া দিন থেকে তখন হবে কি যারা সংসদ সদস্য ছিলেন তারা আর আসনে থাকবেন না এবং নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, আমাদের গত ২০১৪ ও ১৮’র নির্বাচনে কিন্তু সংসদ রেখে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের সময় সংসদ ভেঙে দিলে বিরোধীরা কিছুটা হয়তো সমতার ব্যাপারে সমঝোতায় চলে আসবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/786643