২৫ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার, ৮:৫৩

সিগন্যাল না পেলেও স্টেশনে প্রবেশ করে মালবাহী ট্রেন, এতেই দুর্ঘটনা! 

কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনের প্রবেশ সিগন্যাল না পাওয়ার পরও মালবাহী ট্রেনটি স্টেশনে প্রবেশ করে। ফলে স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া এগারসিন্দুর ট্রেনকে ধাক্কা দিলে যাত্রীবাহী দুটি বগি উল্টে যায়। এ দুর্ঘটনায় ভৈরব স্টেশন থেকে দেওয়া সিগন্যালের কোনো ত্রুটি ছিল না বলে দাবি করেছেন ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার ইউসুফ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এ দাবি করেন স্টেশন মাস্টার। এদিকে নিহত ১৭ জনের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ ২৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ জানতে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ে। গতকাল সকাল ৭টার পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মিজানুর রহমান জানান, সকাল থেকে রেল চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। 

স্টেশন মাস্টার ইউসুফ বলেন, ‘আমরা শুধু এগারসিন্দুর ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার জন্য সিগন্যাল দিয়েছি; ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মালবাহী ট্রেন স্টেশনে প্রবেশের জন্য কোনো সিগন্যাল দেওয়া হয়নি। স্টেশনের সিগন্যাল সিস্টেমে কোনো ত্রুটি ছিল না।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের সিগন্যাল সিস্টেম সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড। ফলে কোনোভাবেই একসঙ্গে দুটি ট্রেনের সংকেত দেওয়া যায় না। ভৈরব স্টেশন থেকে শুধু এগারসিন্দুর ট্রেনের জন্য সংকেত দেওয়া হয়েছিল।’ এ দুর্ঘটনার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে সবধরনের ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে বলেও জানান স্টেশন মাস্টার। তিনি বলেন, শিডিউল অনুযায়ী ট্রেন চলাচলের জন্য কিছুটা সময় লাগবে। তবে আজকের (মঙ্গলবার) মধ্যেই সব ট্রেন শিডিউল অনুযায়ী চলাচল করতে পারবে। এ বিষয়ে ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনের সিগন্যাল কর্মকর্তা জয়বুন্নেসা বলেন, আমরা শুধু যাত্রীবাহী এগারসিন্দুর ট্রেনের জন্য সিগন্যাল দিয়েছি। মালবাহী ট্রেনের প্রবেশের জন্য সিগন্যাল দেওয়া হয়নি। এটি সিগন্যাল অমান্য করে স্টেশনে প্রবেশ করে।

এক পরিবারের সবাই নিহত: ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনায় একই পরিবারের চারজনের সবাই নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন-ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার রাজগাতি ইউনিয়নের বনহাটি গ্রামের মফিজ উদ্দিনের ছেলে সুজন মিয়া, তার স্ত্রী ফাতেমা আক্তার, তাদের ছেলে সজীব মিয়া ও ইসমাইল মিয়া। নিহত সুজনের ভাই স্বপন মিয়া জানান, সুজন মিয়া ঢাকার মোহাম্মদপুর তাজমহল রোড এলাকায় পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। সেখানে ভ্যানে ডাব বিক্রি করে সংসার চালান। গত শুক্রবার বড় ভাইয়ের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে বাড়িতে আসেন। অনুষ্ঠান শেষে আজ ট্রেনে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। পথে দুর্ঘটনায় তার পরিবারের সবাই মারা যান। এদিকে, তাদের সঙ্গে স্বপন মিয়াও ঢাকায় ফিরছিলেন। তবে দুর্ঘটনার সময় পাঁচ নম্বর বগিতে থাকায় বেঁচে যান তিনি। বাজিতপুর উপজেলার দয়গাঁও বোর্ডবাজার এলাকার রনি জানান, নরসিংদীতে টেক্সটাইল মিলে চাকরি করেন। কয়েকদিন আগে স্ত্রী ও ৪০ দিনের শিশু সন্তানকে নরসিংদী নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়িতে আসেন। আজ নরসিংদী যাওয়ার পথে জগন্নাথপুর এলাকায় ট্রেন দুর্ঘটনায় তার বাবা নাসির উদ্দীন মারা যান। শিশু সন্তানসহ তারা অক্ষত আছেন। ভৈররেব রাণীবাজার এলাকার শান্তী রাণী শীল জানান, তার স্বামী সবুজ শীল সোমবার দুপুরে নরসিংদী বালিয়ারচর বৌবাজার এলাকায় মেয়ের জামাইয়ের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হন। ট্রেন দুর্ঘটনায় তার স্বামী মারা যান। ভৈরবের আগানগর এলাকার আরমান হোসেন জানান, তার ভাই আফজাল হোসেন ঢাকা কলেজ থেকে অনার্স শেষে সাউথ কোরিয়ার স্কলারশিপ পেয়েছেন। এক সপ্তাহ পর চলে যাওয়ার তারিখ ছিল। সোমবার বড় ভাই সাদ্দাম হোসেনের কর্মক্ষেত্র সৌদি আরবে যাওয়ার কথা; রাত ৯টায় ফ্লাইট ছিল। বড় ভাইকে এয়ারপোর্টে দিয়ে আসার জন্য দুপুরে ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠেন। এরই মধ্যে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে আফজাল হোসেন মারা যান। ভৈরবপুর গ্রামের রিপা আক্তার বলেন, আমার ছেলে রাকিব মিয়া (১৩) শারীরিক প্রতিবন্ধী। তার একটি পা নেই। সে ট্রেনে উঠে ভিক্ষা করতো। প্রতিদিনের মতো আজকেও ট্রেনে ভিক্ষা করতে বের হয়। দুর্ঘটনার সময় সে ট্রেনে ছিল। আমার ছেলে রাত ৯টা পর্যন্ত ঘরে না ফেরায় ছেলের সন্ধানে ভৈরব হাসপাতালে এসেছি। বেঁচে আছে কি না আমি জানি না।

কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, এটা খুবই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। এ পর্যন্ত দুর্ঘটনায় ১৭ জন মারা গেছে। নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ ২৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আহতদের চিকিৎসার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা করা হবে। বিভিন্ন উপজেলা থেকে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স নিয়ে আসা হয়েছে। সর্বদা জেলা প্রশাসন কাজ করছে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে রাত ৯টায় দুর্ঘটনার শিকার তিনটি বগি রেখে ট্রেন ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গিয়েছে। দ্রুত ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা     বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখনো ক্ষতিগ্রস্ত বগির নিচে মরদেহ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডিসি আরও বলেন, আমাদের উদ্ধারকাজ অব্যাহত আছে। উদ্ধার অভিযানে স্থানীয় প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট, ৯ প্লাটুন বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, আনসার সদস্যসহ স্থানীয় লোকজন সহযোগিতা করছেন।

তিনজনকে বরখাস্ত: ভৈরবে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হলেন-লোকোমাস্টার জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী লোকোমাস্টার আতিকুর রহমান ও গার্ড আলমগীর হোসেন। গতকাল মঙ্গলবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য অফিসার সিরাজ উদ-দৌলা খান। এরআগে সোমবার (২৩ অক্টোবর) বিকেলে ভৈরব জংশনের কাছাকাছি জগন্নাথপুর এলাকায় এগারসিন্দুর ও চট্টগ্রামগামী মালবাহী ট্রেনের মধ্যে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৮ জন নিহত হন। নিহত ১৭ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এরমধ্যে একই পরিবারের রয়েছেন চারজন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. বুলবুল আহমেদ জানান, ১৬টি জনের লাশ রাতেই তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক। তাদের মধ্যে ২০ জনকে ঢাকায়, ৪০ জনকে বাজিতপুর জহুরুল ইসলাম ও কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ১২ জনকে অন্যান্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এখন পর্যন্ত যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন-ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার সুজন মিয়া (৩৫), তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৩০), তাদের দুই ছেলে সজীব মিয়া (১৪) ও ইসমাইল মিয়া (১০); কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার দড়িগাঁও গ্রামের আছির উদ্দিন (৩০), মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের রাসেল মিয়া (২১), চানপুর গ্রামের সাইমন মিয়া (২৬), ভৈরব পৌর শহরের টিনপট্টি এলাকার বাসিন্দা সুবোধ শীল (৪৫), ভৈরব পোস্ট অফিসের সহকারী পোস্ট মাস্টার হুমায়ুন কবির জাহাঙ্গীর (৫৫), ভৈরব যুব উন্নয়ন কার্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ জালাল আহমেদ, ঢাকা কলেজের ছাত্র ভৈরবের রাধানগর গ্রামের আফজাল হোসেন (২৩), ভৈরব পৌর শহরের রানীরবাজারের সবুজ চন্দ্র শীল (৫০), ভৈরব উপজেলার শ্রীনগরের রাব্বি মিয়া, ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মেরেঙ্গা গ্রামের হোসনা আক্তার, কুলিয়ারচর উপজেলার লক্ষ্মীপুর এলাকার ইমারুল কবীর (২২) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বরইছড়া এলাকার নিজাম উদ্দিন সরকার। 

রেলওয়ের তদন্ত কমিটি: দুর্ঘটনার কারণ জানতে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ে। কমিটিকে আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। গতকাল রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. তৌফিক ইমাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানা যায়। অফিস আদেশে বলা হয়, ভৈরবে যাত্রীবাহী এগারসিন্দুর গোধূলি ও মালবাহী ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষের কারণ অনুসন্ধানের জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। এতে আরও বলা হয়, কমিটি সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান, দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করবে। অফিস আদেশ জারির ৭ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে এবং কমিটি প্রয়োজনে যেকোনো কর্মকর্তাকে সদস্য হিসেবে দলে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (অডিট ও আইসিটি) হাসান মাহমুদকে আহ্বায়ক এবং উপসচিব (প্রশাসন-৬) মো. তৌফিক ইমামকে সদস্য সচিব করে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এছাড়া কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশন) এ এম সালাহ উদ্দীন, যুগ্ম মহাপরিচালক (মেকানিক্যাল) তাবাসসুম বিনতে ইসলাম, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (ভূমি) মোহাম্মদ হানিফ, বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত সিসটিই (টেলিকম) এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতালের ডিভিশনাল মেডিকেল অফিসার। 

শোক: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কিশোরগঞ্জ জেলার পক্ষ থেকে ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে শোক প্রকাশ করেছে। জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রেীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও কিশোরগঞ্জ জেলা আমীর অধ্যাপক মো: রমজান আলী এক বিবৃতিতে নিহতদের পরিবারের প্রতি শোক প্রকাশ করেন এবং আহতদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান। জামায়াত নেতা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেন।

https://www.dailysangram.info/post/538986