২৫ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার, ৮:৫২

গায়েবি মামলা উপাখ্যান

 -ইয়াসিন মাহমুদ

শৈশব ও কৈশোরে আমরা জাদু দেখে খুব মজা পেতাম। অনেক কিছুই সম্ভব হয়ে ধরা দিতে দেখেছি জাদুকরের হাতে! বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে এইসব জাদুকরদেরকে হায়ার করে আনা হতো। বিনা পুঁজিতে অল্পসময়ে বেশ ভালোই ইনকাম হতো জাদুকরদের। এই সময়ে এসে সেইসব জাদুকরদের কথা খুব মনে পড়ছে। আবার কেন যেন মনে হচ্ছেÑদেশের সব জাদুকরদেরকে কী সরকার হায়ার করে কাজে লাগাচ্ছে কিনা সে বিষয়টা সহসা সামনে এসে যায়। আমরা যে জাদু খেলা দেখতাম সেটা ছিলো নিছক আনন্দ দেয়া। তবে দেশে যে জাদু খেলা চলছে সেটা আনন্দদানের বিষয় নয় বরং মানুষকে হয়রানির প্রবণতার বিষয়ে বেশ জোরেশোরে আলাপ হচ্ছে। গায়েবি মামলার বিষয়ে মূলত আজকের কথা-বার্তা। মানুষ নেই কিন্তু মামলা আছে। বিষয়টা অবিশ^াস্য, হাস্যকর মনে হলেও   বিরোধী জোটের নেতাÑকর্মীকে কুপোকাত করতে সরকারি আয়োজনে দেশে চলছে এমন নিষ্ঠুর ও নির্মম ফ্যাসিবাদ। সাম্প্রতিক সময়ের ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনাই প্রমাণ করে এখন আসামী হবার জন্য অপরাধী হবার প্রয়োজন নেই। সংঘটিত ঘটনা স্থলে না থেকেও এখন অপরাধী হবার সৌভাগ্য মেলে অনেকেরই। শুধু সরকারবিরোধী নয় সাধারণ আমজনতা হওয়াটাও এখন নিরাপদ নয়। মানুষ মরে গিয়েও শান্তিতে নেই। বিদেশে গিয়েও স্বস্তিতে নেই।

গত ২ আগস্ট ২০২৩ বুধবার দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পাতার একটি নিউজের শিরোনাম ছিলো এমনÑ ‘ঘটনার’ সময় কেউ মৃত, কেউ কারাবন্দী, কেউ বিদেশে, তবু আসামী।’ মোহাম্মদ মোস্তফার প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ দা, লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে হামলার পর ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানোÑ এমন একটি মামলার আসামীর তালিকায় রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক শওকত হোসেন। তার নামে গেন্ডারিয়া থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় যে ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটি সত্য হয়ে থাকলে সাত মাস আগে মারা যাওয়া শওকত হয়তো ‘গায়েবিভাবে জীবিত’ আছেন বলে জানান চাচা আবুল কাশেম। উল্লেখ্য, প্রতিবেদনে জানা যায় গত বছরের ডিসেম্বরে হৃদরোগে তার ভাতিজা শওকত মারা যান। এবং পুরান ঢাকার ফরিদাবাদ এলাকার একটি কবর স্থানে তাকে দাফন করা হয়। ২ আগস্ট ২০২৩ বুধবার দৈনিক প্রথম আলোর ৭ নং পৃষ্ঠায় প্রকাশিত আরেকটি নিউজের শিরোনাম এমনইÑ ‘তারা হজ্জ্বে ছিলেন, তবু ‘ গায়েবি’ মামলার আসামী।’ চট্টগ্রাম থেকে গাজী ফিরোজের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়Ñ পবিত্র হজ্জ্ব পালনের জন্য দেড় মাস সৌদি আরবে ছিলেন চট্টগ্রামের দুই বিএনপি নেতা। ফেরেন গত ৩০ জুলাই ২০২৩। অথচ ২৮ জুলাই ২০২৩ এক যুবলীগ নেতার করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আগের দিন সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে হজে থাকা ওই দুইজনসহ ১২০ জন মিলে তাকে মারধর করেছেন। ওই সময় তাদের হাতে ছিলো লাঠিসোঁটা ও পেট্টলবোমা। বিশেষ ক্ষমতা ও বিস্ফোরক আইন এবং ভাঙচুর মারধরের অভিযোগে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানায় এই মামলা হয়েছে।

ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয় ২৭ জুলাই দুপুর সোয়া ১২টা। ঘটনাস্থল পৌরসভার গাছবাড়িয়া এলাকা। মামলার বাদী চন্দনাইশ পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন। হজ্জ্বে থাকা বিএনপির দুই নেতা হলেন চন্দনাইশ উপজেলার  যুগ্ম আহ্বায়ক মঞ্জুর মোর্শেদ চৌধুরী ও সাইফুল ইসলাম। প্রতিবেদক গাজী ফিরোজ উল্লেখিত ঘটনাস্থলে যান ৩০ জুলাই ২০২৩। সেখানে স্থানীয় ৮ জনের সাথে কথা বলেন। দিনের বেলায় ওই ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় কেউ কিছু জানেন না বলে জানান। ঘটনাস্থলের আশেপাশে কোনো দোকানপাট নেই। পুলিশ সেই দিন ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি পেট্টলভর্তি কাচের বোতল, বাঁশের লাঠিসহ বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করে জব্দতালিকা তৈরি করে। এই তালিকায়  থাকা  সাক্ষী মো: আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কিছুই জানেন না। পুলিশ সই করতে বলেছে। মামলার অপর আসামী পৌরসভা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ইকতিয়ার উদ্দিন দাবি করেন, সেদিন তারা কোনো মিছিলÑসমাবেশ করেননি। হজ্জ্বে যাওয়া মঞ্জুর মোর্শেদ এর সাথেও মুঠোফোনে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয়। তিনি বলেনÑ ৩০ জুলাই বাংলাদেশ বিমানের বিজি ৩৫৯৬ উড়োজাহাজে করে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশে পৌঁছান। তার কাফেলায় হজ্জ্বে গেছেন সাইফুল করিম। তিনি একই দিন রাতে বাংলাদেশ বিমানের বিজি ৩৯৬০ ফ্লাইটে দেশে ফেরেন। 

এখন মামলায় নতুন ধারা ও ট্র্যাডিশন এসেছে। গায়েবি মামলা। সিস্টেম একই। শুধু নাম পরিবর্তন। স্থান, সময় ও ব্যক্তি সব কিছু ভিন্ন হলেও পলিসির কোনো পরিবর্তন নেই। প্রতিটি স্থানে একই নীতিমালায় চলছে গায়েবি মামলা। বলতে পারেন জব্দমামলা। নিশ্চয় এটি সরকার দলীয়দের কেন্দ্রীয় একটি কর্মসূচি বলা যেতে পারে। বিরোধীজোটকে ফাঁসানোই একমাত্র উদ্দেশ। কাট কপি পেস্ট। কোথাও হেরফের নেই। হুবহু একই ফিরিস্তি দাখিল। এ থেকে বুঝা যাচ্ছেÑএই গায়েবি মামলা হলো উদ্দেশপ্রণোদিত ও হয়রানিমূলক। একটু বিস্তারিত বললে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ বৃহস্পতিবার দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পেজে একটি শিরোনামÑ ‘৩৬ দিনে এক জেলায় ৩০ ‘গায়েবি মামলা।’ জামালপুর প্রতিনিধি আব্দুল আজিজ এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেনÑ গত ২৯ আগস্ট ২০২৩ রাতে আটক হন জামালপুর শহর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মমিনুর রহমান। পরের দিন নাশকতার মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। ২ সেপ্টেম্বর অপর একটি মামলায় আসামী করা হয় মমিনুর রহমানকে। সেই মামলার এজাহার বলছে, ১ সেপ্টেম্বর রাতে নাশকতার উদ্দেশে জামালপুর শহরের একটি মাঠে গিয়েছিলেন মমিনুর।

ডিবি পুলিশের করা মামলার এজাহার ঠিক থাকলে মমিনুর কারাগার থেকে বেরিয়ে গিয়ে নাশকতার উদেশে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। বাস্তবে মমিনুর তখনো কারাগারে ছিলেন, এখনো কারাগারে আছেন। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ২১ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোর শিরোনামÑ নির্বাচনের আগে এবারও ‘গায়েবি’ মামলা। ঢাকা থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেনÑপুরান ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা সূত্রাপুরের বানিয়ানগর মোড়। এই মোড়ে গত ৩০ ডিসেম্বর ২০২২ সন্ধ্যা পৌনে ৬ টার দিকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ২০-২৫ নেতা-কর্মী সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে শুরু করেন। সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে নিষেধ করলে তারা অতর্কিতভাবে আওয়ামী লীগের নেতাÑকর্মীদের ওপর হামলা চালান। পরে হত্যার উদ্দেশে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা খয়ের উদ্দিন আহমেদের করা মামলার এজাহারের ভাষ্য এটি। কিন্তু ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলে কেউ এমন ঘটনা দেখেছেন বা শুনেছেন সেটা বলতে পারেননি।

মানুষকে জিম্মি করা ও ফাঁদে ফেলানো একটি অভিনব কৌশল হলো এই গায়েবি মামলা।  থানায় কোনো অভিযোগ নেই। নামে কোনো মামলা নেই। তারপরও আওয়ামী লীগ নেতাদের তালিকায় নাম উঠা মানেই বন্দীশালা। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতার যৌথ অভিযানে এই মামলায় এখন দেশের হাজার হাজার নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ। তবে  কারোর কিছুই করার নেই। কিছুই বলার নেই। কেউ মুখ খুললে পরের তালিকায় সেও আসামী। সোজা লাল দালানে। এই হচ্ছে সমকালীন বাংলাদেশের একটি চিত্র। মামলার রাজনীতি। গোটা দেশটাই আজ কারাগার। তবে এই গায়েবি মামলা নিয়ে কিছুই জানেন না খোদ পুলিশের আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি ৯ সেপ্টেম্বর শনিবার দুপুরে বগুড়ায় পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের বহুতল মার্কেট উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এসব কথা বলেন। (সূত্র: কালবেলা-১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩) এই একই সুরে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেনÑগায়েবি মামলা বলে কিছু নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯) দেশটা আজ মামলাবাজদের দখলে। টু শব্দ করার মতো পরিবেশ নেই কোথাও। সর্বত্র দখলদারী ও কর্তৃত্বের বাহাদুরী চলছে দেদারসে। এখানে কথা বলা মানে বিপদ ডেকে আনা। 

কথায় কথায় মামলা ঠুকে দেওয়া। একটু হেরফের হলেÑ পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতার চক্ষুশুল। পুলিশ ও আওয়ামী নেতার মুক্তিপণ ও জামিননামায় মাশুল গুনতে হয় কড়ায় গন্ডায়। এই আমার স্বদেশ। বাংলাদেশ। মামলার মাধ্যমে মানুষের মুখে ভাষা কেড়ে নেয়া হচ্ছে। সত্যের টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে। আর এখন ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র উপায় অবলম্বন হলো মামলার ভয়। মামলার গ্যাড়াকলে মানুষ এখন পথে বসতে বাধ্য হতে যাচ্ছে। সর্বস্ব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। অসহায়। এই নির্যাতিত মানুষেরা এখন মুক্তির পথ খুঁজছে প্রতিক্ষণ।

সম্প্রতি ৭ আগস্ট বোরবার দুপুরে ২০২৩ সকালে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত ‘গায়েবি মামলা ও আগামী নির্বাচন’ শীর্ষক ওয়েবিনারে ড. আসিফ নজরুল বলেনÑ ‘ঘটনা ঘটেনি অথচ রাজনৈতিক উদ্দেশে এমন ঘটনা সাজিয়ে পুলিশ মামলা  করছে। এমন মামলাই গায়েবি মামলা। এসব মামলার ঘটনায় সম্প্রতিকালে সরকারি দলের নেতাদের বাদী করা হয়েছে। এসব মামলা অজ্ঞাত ও অনেক সংখ্যক মানুষকে আসামী করা হয় যাতে তাদের গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে বিরোধীদের এলাকা ছাড়া করা যায়। অবাধে নির্বাচনে কারচুপি করতেই নির্বাচনের আগে এ ধরনের মামলা বাড়ে। এ ধরনের মামলা অব্যাহত থাকলে আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। একই মঞ্চে  ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক  ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর-রহমান বলেন ‘এই সরকারের আমলে যে গায়েবি মামলাগুলো করা হয়েছে সেগুলো চরিত্রগত দিক থেকে একেবারই ভিন্ন। এগুলোর উদ্দেশ্য একেবারই সুনির্দিষ্ট। তা হলো, আগামী নির্বাচনকে তাদের মতো প্রভাবিত করা।’

 সবমিলিয়ে বলা যায়, শহরÑনগরÑ বন্দর থেকে গ্রামÑগঞ্জে সর্বত্র চলছে মামলা মামলা খেলা। এ খেলা এখন ভয়ানক অবস্থায় রূপ নিয়েছে। মানুষের মানবাধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। মানবতাবিরোধী এ অপরাধকর্ম বন্ধ হওয়া উচিত। যেভাবে পাইকারি হারে  নিরপরাধ, নির্দোষী মানুষকে অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে এ ফলাফল নিশ্চয় ভালো হবে না। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এই ধরনের অগণতান্ত্রিক আচরণ কেউ প্রত্যাশা করে না।

https://www.dailysangram.info/post/538954