১৯ অক্টোবর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৩:১৪

রাজধানীতে তীব্র গ্যাস সংকট

বাসাবাড়িতে গ্যাসলাইনের পাশে জ্বলছে সিলিন্ডার গ্যাস

 

তীব্র গ্যাস সংকটে রাজধানীতে দিনের বেলায় জ্বলছে না রান্নার চুলা। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক। তবে এ সময়ে গ্যাস তেমন কাজে লাগছে না। শুধু রান্নার চুলা নয়, গাস সংকট চলছে সিএনজি পাম্পেও। গ্যাসের জন্য পাম্পগুলোতে দেখা দিয়েছে বিশাল লাইন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যাচ্ছে সেখানে। রাস্তা জুড়ে যানবাহনের এই লাইনের কারণে পুরো নগর জুড়ে দেখা দিয়েছে অসহনীয় যানজট। রাজধানীর অনেক এলাকায় এখন পাইপলাইনের গ্যাসের পাশাপাশি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন গ্রাহকরা। এতে পরিবারের খরচ বেড়ে চলছে। একদিকে দিতে হচ্ছে গ্যাস বিল অপরদিকে সিলিন্ডার খরচ। এই অবস্থায় ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।

গ্যাস-সংকটের কথা জানিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গত কয়েকদিন ধরে যুগান্তর কার্যালয়ে অনেকে ফোন করে অভিযোগ জানিয়েছেন। তারা বলছেন, কয়েক দিন আগেও সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত গ্যাস পাওয়া যেত। এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। ভোর ৫টার পরই গ্যাসের চাপ কমে যায়। যে চাপ থাকে, তাতে চুলা নিবু নিবু করে জ্বলে, রান্না করা যায় না। বুধবার নগরীর সচিবালয় সংলগ্ন জাতীয় প্রেস ক্লাবেও দিনভর গ্যাস ছিল না। এ কারণে রান্না করতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ক্যান্টিনে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের জরুরি অভিযোগ কেন্দ্রে জমেছে অভিযোগের পাহাড়। তারা বলছে, এক মাস ধরেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ কম বলে তারাও অভিযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু তাদের হাতে করার কিছু নেই। চাহিদা অনুযায়ী তারা পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছে না। তাই রেশনিং করে গ্যাস দিতে হচ্ছে। সিএনজি পাম্পে চাহিদা অনুযায়ী অর্ধেক গ্যাসও দেওয়া যাচ্ছে না। আগে যেখানে ৩ থেকে ৫ মিনিটে একটি গাড়িতে গ্যাস ভরা সম্ভব ছিল, চাপ না থাকায় এখন সেখানে লাগছে ১৫ থেকে ২০ মিনিট।

জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, পান্থপথ, কাঁঠালবাগান, কলাবাগান, জাতীয় প্রেস ক্লাব, মিরপুর, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, মুগদা, মান্ডা, বাড্ডা থেকে গ্যাস-সংকটের বিষয়ে অভিযোগ আসছে বেশি। বুধবার গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি থেকেও অনেকেই গ্যাস-সংকটের বিষয়ে অভিযোগ করেন। জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য এক মাস ধরে রাজধানীতে একেক দিন একেক এলাকায় দিনের বেলায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকছে।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। একসময় সর্বোচ্চ ৩২০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে। এখন দিনে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে দিনে ৪৮ কোটি ঘনফুট। দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের কথা। তিতাসের দায়িত্বশীলরা বলছেন, চাহিদা অনুসারে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এতে পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কমে গেছে। গ্রাহকরা নিয়মিত অভিযোগ করছেন। কিন্তু তারা কোনো সমাধান দিতে পারছেন না। দিনে তাদের গ্যাসের চাহিদা ১৮০ থেকে ১৯০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু এখন পাচ্ছেন ১৬০ কোটি ঘনফুটের মতো।

গ্যাসের সংকটে নগরীর আশকোনা, দক্ষিণ খানের পুরো এলাকার বাসিন্দারা গ্যাস লাইনের পাশাপাশি এলপিজি সিলিন্ডার লাইনও লাগিয়েছেন। এই এলাকায় আগে ভোর রাতে তিতাসের গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যেত। এখন অনেক বাড়িতে ভোর রাতেও গ্যাস পাওয়া যায় না। এই এলাকার বাসিন্দা গোলাম সাত্তার যুগান্তরকে বলেন, তার বাড়িতে দুটি গ্যাস লাইন। বাসা ভাড়া দেওয়ার সময় তিনি ভাড়াটিয়াদের আগেই বলে দেন ভোর রাতে তিতাসের গ্যাস আর দিনে এলপিজি গ্যাস থাকবে। তিনি বলেন, শুধু প্রেস্টিজের জন্য তিতাসের লাইনটি রেখে দিয়েছেন। আর প্রেস্টিজ রক্ষা করতে গিয়ে তিনি প্রতি মাসে দুই চুলার গ্যাস বিল দিয়ে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে প্রতি মাসে তার ৩ হাজার টাকার এলপি গ্যাস লাগছে। তিনি বলেন, শুধু তার বাড়িতে নয়, পুরো এলাকার মানুষ দুই লাইনের গ্যাস বিল দিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। আর আশায় থাকছে যদি কোনো দিন গ্যাস পাওয়া যায়। সরেজমিন রাজধানীর এ রকম অনেক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে যেসব বাসিন্দা তিতাসের লাইনের পাশাপাশি এলপিজির সিলিন্ডার কিনছেন, তারা এখন আর স্বস্তিতে নেই। গ্যাস না পেলেও মাসে বিল দিতে হচ্ছে ১ হাজার ৮০ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার স্থানীয়ভাবে গ্যাসের চাহিদা না বাড়িয়ে এলএনজি আমদানির দিকে দৌড়াচ্ছে বেশি। এ কারণে গ্যাসের জন্য রাখা বাজেটের বেশিরভাগ টাকা ওই খাতে চলে যাচ্ছে। আরও তিনগুণ এলএনজি আমদানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০২৬ সালের পর এলএনজি আমদানি ১০.৫০ মিলিয়ন টন পার ইয়ার (এমটিপিএ) ছাড়ানোর ব্যবস্থা চূড়ান্ত হয়ে আছে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. এম শামসুল আলম বলেন, ঋণ করে জ্বালানি কেনা কোনো সমাধান নয়। এই ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। এটি কোনো না কোনোভাবে জনসাধারণের ওপরই চাপবে। এর চেয়ে জরুরি হলো অপচয়, অনিয়ম বন্ধ করা। অভ্যন্তরীণ গ্যাস উত্তোলন ও উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেওয়া।

অবশ্য পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেছেন, কিছুদিনের মধ্যে এই সংকট আর থাকবে না। তিনি বলেন, বাসাবাড়ির পাশাপাশি তারা এখন ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাই এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। তবে এলএনজি আমদানির পাশাপাশি সরকার দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলনের নানা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে মোট ৪৬টি কূপ খনন, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার সম্পন্ন করা হবে। ৪৬টি কূপের মধ্যে রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রম ২টি, বাপেক্স ১টি কূপ খনন এবং বিজিএফসিএল ১টি ওয়ার্কওভার সম্পন্ন করেছে। ২০২৪ সালের মধ্যে বাপেক্সের রিগগুলোর শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। এর মাধ্যমে ৩টি অনুসন্ধান, ৫টি উন্নয়ন ও ১০টি ওয়ার্কওভার কূপ রয়েছে। বাকি কূপগুলোর মধ্যে ১৬-১৮টি বিদেশি সংস্থা, যাদের বাংলাদেশে খননের অভিজ্ঞতা ও রিগ আছে, তাদের দিয়ে খনন করা হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/730405