১৯ অক্টোবর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৩:০৫

ফিলিস্তিনিদের ন্যায়যুদ্ধে বিজয় অবশ্যম্ভাবী

-ড. মাহবুব উল্লাহ্ 

বাংলাদেশে আমার বয়সি মানুষের শৈশবের একটি অভিন্ন স্মৃতি আজও জাগরূক। শৈশবে আমরা বাবা-চাচাদের সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করার জন্য ঈদগাহে যেতাম। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব যে মোনাজাত করতেন তার মধ্যে দুটি বিষয় অবশ্যই স্থান পেত। বিষয়গুলো হচ্ছে কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং ফিলিস্তিনের জনগণের নিজ ভূমিতে জীবনযাপনের অধিকার।

বর্তমান বিশ্বায়িত পৃথিবীতে আন্তর্জাতিকতার মনোভাব অতীতের তুলনায় শতগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। এখন এক দেশের মানুষের সঙ্গে অন্য দেশের মানুষের ঘনিষ্ঠতা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় অন্তরের ঘনিষ্ঠতা খুব একটা দেখা যায় না। এখন মানুষ মানুষের ওপর যে ন্যক্কারজনক অত্যাচার ও অবিচার করে তার প্রতিবাদে সমান তালে নিপীড়িতদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সংহতি বোধ জাগ্রত হতে দেখি না। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। মানবজাতির বৈশিষ্ট্য কি বদলে যাচ্ছে? তাই যদি হয় তাহলে এর কারণ কী? কেন আজ দুনিয়ার মজদুর এক হও স্লোগানটি অতীত দিনের মতো বজ্র নির্ঘোষে উচ্চারিত হয় না।

বর্তমান বিশ্বে যেসব মানবিক ট্র্যাজেডি প্রতিনিয়ত মানবিক মর্যাদায় কুঠারাঘাত হানছে তার মধ্যে ফিলিস্তিন ট্র্যাজেডি সবচেয়ে দুঃখজনক। আজ পর্যন্ত মানবসমাজ যেসব ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি নির্ধারণ করেছে সেগুলোর যে কোনো একটির নিরিখে ফিলিস্তিনি জনগণের ট্র্যাজেডি সবচেয়ে বেদনাদায়ক। ১৯৪৮-এর আগে ফিলিস্তিন ছিল একটি চমৎকার দেশ। এদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের নিয়ে সব ধরনের ধর্মাবলম্বী সৌহার্দমণ্ডিত জীবনযাপন করত। ১৯১৮ সালের ‘বেলফুর’ ঘোষণায় ইহুদিদের জন্য একটি বাসস্থানের প্রয়োজনীয়তার তাগিদ দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানিতে ইহুদিরা ‘হলোকস্টের’ শিকার হয়। হিটলার শত-সহস্র ইহুদিকে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে হত্যা করেন।

গ্যাস চেম্বারে আবদ্ধ করার আগে বন্দি ইহুদিদের খাবার কমিয়ে দিয়ে কঙ্কালসারে পরিণত করা হতো। গ্যাস চেম্বারে যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক, প্রকৃতি বিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানী ছিলেন। এরা নিহত হওয়ায় মানবজাতির বিশাল ক্ষতি হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে ইহুদিদের জন্য এক ধরনের সমবেদনা বোধ তৈরি হয়েছিল। এ অনুভবকে পুঁজি করে অস্ত্রের জোরে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অভিবাসন নিশ্চিত করা হয়। নাম করা ইসরাইলি নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ ফিলিস্তিনের স্থায়ী বাসিন্দাদের হত্যাযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেছিল। আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যাকারীদের কারোর কারোর বিচার হয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিনে যারা সেখানকার আদিবাসীদের হত্যা করেছে তাদেরকে বিচারের আওতায় নেওয়া হয়নি। পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলোর আনুকূল্যে জায়নবাদী ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল টিকে আছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের যে অংশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে বসবাস করছে তারা প্রতিনিয়ত ইসরাইলি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দমনপীড়নে রক্তাক্ত হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের তাদের পূর্বপুরুষদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে এবং সে জায়গায় ইসরাইলি ইহুদিদের জন্য বসত নির্মাণ করছে।

গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলের অভ্যন্তরে সামরিক হামলা চালায়। গত ২-৩ বছর হামাসের সামরিক তৎপরতার কথা শোনা যায়নি। হামাসের মধ্যে ভিন্ন ধরনের কোনো রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা কাজ করছে এমনটিও শোনা যায়নি। ইসরাইল এ সময়টিতে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব অন্যতম। মিসরের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সময়। এসব ঘটনাদৃষ্টে মনে হয়েছিল দেশহারা রাজ্যহারা ফিলিস্তিনিদের ভুলে গেছে তাদের প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলো। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পেছনে কাজ করেছে একটি ধর্মীয় যুক্তি। এটি হলো তাওরাতে বর্ণিত বনি ইসরাইলের জন্য প্রতিশ্রুত ভূমি। যাই হোক গত বেশ কিছু সময়ের নীরবতার ফলে মনে হয়েছিল ফিলিস্তিন ইস্যু বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে হিমাগারে চলে গেছে। এ ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হলো ৭ অক্টোবরের ইসরাইলের অভ্যন্তরে হামাসের সামরিক অভিযানের পর। ইসরাইল হামাসের অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় গাজায় ভয়াবহ বিমান হামলা চালাতে শুরু করে। বড় আকারে এ হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইল। ১৯৭৩ সালের ‘ইয়াম কিপুর’ যুদ্ধের ৫০তম বার্ষিকীর পরদিন প্রত্যুষে হামাস ইসরাইলে কয়েকশ রকেট নিক্ষেপ করে।

এর আগে বিভিন্ন সময়ে হামাস ইসরাইলে রকেট হামলা চালিয়েছে। কিন্তু ইসরাইলের উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। হামাসের রকেটগুলো ইসরাইলের প্রতিরক্ষাব্যূহে আয়রন ডোম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভেদ করতে পারেনি। তবে এবারের ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসরাইলিরা হামাসের অভিযান সম্পর্কে কোনো রকম আঁচ-অনুমান করতে পারেনি। হামাসের আকস্মিক স্থল অভিযানে ১ হাজার ৪০০ ইসরাইলি নাগরিক নিহত হয়। অন্তত ১৫০ ইসরাইলিকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে আসা হয়। নিহত ও বন্দিদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের নাগরিকরাও আছে।

ইসরাইল পরিস্থিতি সামলে নিয়ে গাজার ওপর মুহুর্মুহু বিমান হামলা চালাতে শুরু করে। এর ফলে ২ হাজার ৬০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৭৫০ শিশু ও ৫২৮ নারী রয়েছে। ইসরাইলি হামলায় প্রতিনিয়ত হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। ইসরাইল হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সাধারণ নাগরিকদের ঘরবাড়ির ওপর হামলা চালাচ্ছে। মঙ্গলবার রাতে গাজার এক হাসপাতালে ইসরাইলি হামলায় ৫ শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ ধরনের হামলা জেনেভা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। টেলিভিশনের ফুটেজে দেখা যায় বিমান হামলায় বিধ্বস্ত দালানকোঠার ভগ্নস্তূপ থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করছে। মৃতদেহ পরিবহণে ব্যবহৃত বডি ব্যাগের অভাব দেখা দিয়েছে। খাদ্য, পানীয় ও ওষুধপত্রের অভাবে বড় ধরনের হিউম্যান ট্র্যাজেডি ঘটতে চলেছে।

এবারের যুদ্ধে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। বহু ইসরাইলি ইসরাইল ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বিমান বন্দরে ভিড় করছে। এতে বোঝা যায় ইসরাইলিদের মনোবলে চিড় ধরেছে। ইসরাইল ঘোষণা করেছে তারা গাজার উত্তরাংশে স্থল অভিযান চালাবে। ইসরাইলিদের নির্দেশে সেখানকার ১১ লাখ ফিলিস্তিনি দক্ষিণাঞ্চলে সরে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বড় ধরনের শরণার্থী সমস্যার উদ্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সাম্প্রতিক ঘটনাবলি যেভাবে তুলে ধরা হচ্ছে, তাতে মনে হয় হামাসের অতর্কিত হামলা ইসরাইলকে জেদি করে তুলেছে। অথচ এই ব্যাখ্যা সঠিক নয় এবং সর্বাংশে বিভ্রান্তিকর। ফিলিস্তিনের ইতিহাসের সঙ্গে যারা পরিচিত তারা জানেন এ পরিস্থিতির উৎপত্তি ৭৫ বছর আগের। ১৯৪৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব বাসগৃহ থেকে উচ্ছেদ করা, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমারেখাকে অগ্রাহ্য করে ইসরাইল রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণ এবং ফিলিস্তিনিদের নিজ বাসভূমে অধিকারহীন করার যে প্রক্রিয়া ইসরাইল জারি রেখেছে, সেসবের মধ্যেই নিহিত আছে বর্তমান সংঘর্ষের জমাটবাঁধা অবিচারের ইতিহাস। ফিলিস্তিনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুদের পড়ানো হয় ‘পাখিদেরও বাসা আছে কিন্তু আমাদের বাসাগুলো কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।’ যুগ যুগ ধরে যে জনগোষ্ঠী ফিলিস্তিনের ন্যায্য মালিক সেই জনগোষ্ঠীকে তার বাসগৃহ থেকে উচ্ছেদ করে পরবাসী করা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়। পাশ্চাত্যের দেশগুলো প্রতিনিয়ত মানবাধিকারের দর্শন প্রচার করে, অথচ তারাই হয়ে উঠেছে ইসরাইলিদের নীতি নৈতিকতাবিহীন অত্যাচার ও অবিচারের সহযোগী।

ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে হামাসের আবির্ভাব দুই থেকে আড়াই দশকের ইতিহাস। হামাস নেতৃত্ব মুসলিম ব্রাদার হুডের রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী। হামাস গাজায় সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে গাজাবাসীর মন জয় করতে সক্ষম হয়। গাজায় হামাস নির্বাচিত হওয়ার পর ১৬ বছর ধরে সেখানে ইসরাইলের অবরোধ চলছে। এ অবরোধের ফলে গাজার ২৩ লাখ মানুষ কার্যত একটি লকআপবিহীন কারাগারে বাস করছেন-এটাই ৭ অক্টোবরের পটভূমি। (সূত্র : আলী রিয়াজ, ১৭-১০-২৩)। অতীতে বিভিন্ন সময়ে গাজায় ইসরাইলের বিমান হামলা হয়েছে এবং হামাস ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে। ২০১২ ও ২০১৪ সালে দুই পক্ষ সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু ইসরাইল ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। তারা চুক্তির বেশ কিছু শর্ত বাস্তবায়ন করেনি। অতীতের সংঘাতের তুলনায় এবার ইসরাইলের ওপর হামাসের হামলা অনেক বড় এবং স্বাভাবিকভাবে এর প্রতিক্রিয়াও বিশাল হতে বাধ্য।

তবে রাজনৈতিকভাবে হামাস অতীতের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিসম্পন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪টি ছাত্র সংগঠন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে। এর মধ্য একটি সংগঠন হলো ‘জুজ ফর লিবারেশন’। যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া এবার ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে সক্রিয় হয়েছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ফিলিস্তিন প্রশ্নে আরব লীগ আহূত সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য সিরিয়ার বাইরে গেছেন। কয়েক মাস হলো চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরান সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। এটাও ফিলিস্তিনিদের শক্তি জোগাবে। ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীও প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। অন্যদিকে ইসরাইলের সমর্থনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রণতরি পাঠিয়েছে এবং বিমান বোঝাই অস্ত্রশস্ত্রও পাঠিয়েছে। বিশ্ব এখন এমন একটি পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে যার মধ্যে অনৈতিক সময় স্পৃহার তুলনায় মানবাধিকারের নৈতিকতা অধিকতর শক্তিশালী হচ্ছে।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ 

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/730438