১৮ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার, ৩:০৪

নির্বাচনের আগেই আমলা পেলেন ‘উপঢৌকন’

দেশের এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবরে প্রাধান্য পাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেট যুদ্ধ, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর অমানবিক অবরোধ ও নৃসংশ হত্যাকা-, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ভিসানীতি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির রাজপথ দখলের প্রস্তুতির খবর। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিদিন কার্যত এসব খবর শিরোনাম হচ্ছে। এর মধ্যে দেশের কয়েকটি গণমাধ্যমে তিনটি ছোট্ট খবর প্রকাশ হয়েছে। এক. ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে আইএমএফকে রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর বাংলাদেশের অনুরোধ, দুই. ১৮ জন সিনিয়র সচিব ও সচিবকে রাজধানীর অভিজাত আবাসিক প্রকল্প পূর্বাচলে প্লট ‘উপহার’ এবং তিন. ৩৮০ কোটি টাকার খরচ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ডিসি ও ইউএনওদের জন্য ২৬১টি নতুন গাড়ি ক্রয়। কয়েকটি গণমাধ্যম এ খবরগুলো গুরুত্বহীনভাবে প্রকাশ করলেও অনেক গণমাধ্যম খরবকে পাত্তা দেয়নি। ডিসি-ইউএনওদের জন্য গাড়ি কেনায় গুরুত্ব তুলে ধরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, নির্বাচনকালীন মাঠপর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যাতে সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে করতে পারেন সে জন্যই এসব গাড়ি কেনা হয়েছে। এই গাড়ি কিনতে আইনগত কোনো বাধা নেই। প্রশ্ন হচ্ছে সত্যিই কি তাই? নির্বাচনী আইন কি বলে? যে মন্ত্রী কথায় কথায় আইন-বিধি বিধানের অজুহাত তোলেন তিনি বলছেন আইনের বাধা নেই? প্রবাদের সেই বাক্য ‘সত্যি সেলুকাস বিচিত্র এ দেশ। বিচিত্র এ দেশের মন্ত্রীদের বক্তব্য’।

প্রায় দেড় বছর ধরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলারের জন্য হাহাকার চলছে। ব্যাংকিং সেক্টর, খোলা বাজারে একই চিত্র। ডলার উধাও। নিন্দুকেরা বলেন, প্রভাবশালীরা ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে ‘বিদেশে ডলার পাচার’ করায় ডলারের এই হাহাকার। ডলারের তীব্র সংকটে দেশের অর্থনীতির নাজুক অবস্থা। ব্যাংকিং সেক্টরের ওপর প্রবাসীদের আস্থাহীনতায় রেমিটেন্স প্রবাহ কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ তলানিতে নামায় আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ে আস্থাহীনতায় ভুগছে। ডলার সংকটে বিদেশি গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়া বিল পরিশোধ করতে না পারায় তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। বিদেশি বিমান কোম্পানিগুলো ডলারের অভাবে টিকেট বিক্রির টাকা নিজ নিজ দেশে পাঠাতে না পারায় কেউ ফ্লাইট কমিয়ে দিয়েছে কেউ ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়ার কথা বলছে। ডলারের অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের সেক্টরে এলসি খোলা কমে গেছে। যা আমদানি-রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উচ্চ শিক্ষায় বিদেশগমনেচ্ছু শিক্ষার্থীদের ‘শিক্ষা ফাইন ওপেন’ কয়েক মাস বন্ধ রেখে এখন সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে। বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া রোগীদের স্বজনরা ডলার সংগ্রহ করতে হীনসীম খাচ্ছেন। গতকালও খোলা বাজারে ডলারের ক্রয় মূল্য ছিল ১১৭.৫০ টাকা এবং বিক্রয় মূল্য ছিল ১১৯.৫০ টাকা। ডলারের খরচ সীমিত করতে কয়েক মাস আগে সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে। ডলার কম খরচ করতে সরকার বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিয়েছে এবং কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বাতিল করা হয়। ডলার সংকট ইস্যুতে কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ডলার সংকটের সুরাহা হচ্ছে না। অথচ ডলারের চরম সংকটের মধ্যে বিপুল পরিমাণ ডলার খবরচ করে ডিসি ও ইউএনওদের জন্য ২৬১টি নতুন গাড়ি ক্রয় করা হচ্ছে। এটা কি গরিবের ঘোড়া রোগ (সাধ্যের অতিরিক্ত সাধ)! নাকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমলাদের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী উপঢৌকন? অনেকেই বলছেন এটা গরিবের ঘোড়া রোগ নয়, নির্বাচনী উপঢৌকন। ক্ষমতাসীন দল আগামী নির্বাচনের আগে ডিসি ইউএনওদের নতুন নতুন গাড়ি দিয়ে নিজেদের ‘গুড বুকে’ রাখতে চান। নতুন গাড়ি পেলে ডিসি-ইউএনওরা আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘গুড বুকে’ থাকবেন। নির্বাচনী উপঢৌকন শুধু ডিসি-ইউএনওদের নয়; নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিবসহ সরকারের ১৮ জন সিনিয়র সচিব ও সচিবকে রাজধানীর অভিজাত আবাসিক প্রকল্প পূর্বাচলে প্লট ‘উপহার’ দেয়া হচ্ছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বরাদ্দের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে এখন বুঝিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন মাস আগে ডিসি-ইউএনওদের জন্য ২৬১টি নতুন গাড়ি ক্রয় এবং ১৮ জন সচিবকে রাজউকের প্লট উপহার প্রসঙ্গে গণমাধ্যম সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশের প্রশাসন ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নষ্ট হয়ে গেছে। তারা দলীয় আনুগত্য বা ব্যক্তির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে এসব সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। নির্বাচনের আগে সচিবদের প্লট দেয়া হচ্ছে এটা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য। একই কারণে সচিবদের প্লট বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে সুজন সম্পাদকের সন্দেহ কি অমূলক? আপনি কি বলেন?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নেটিজেনরা এনিয়ে নানান মন্তব্য করছেন। তাদের বেশির ভাগই বলছেন, ২০১৮ সালে রাতের নির্বাচনে ভোটের দিন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারি কর্মকর্তা, কর্মচারি, আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের বিপুল পরিমান টাকা বিতরণ করা হয়েছিল। এবার আমলাদের খুশি করতে অন্য কৌশল নেয়া হচ্ছে। দেশে যখন ডলারের অভাবে ব্যাংকিং সেক্টরে ত্রাহি অবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্যে এলসি খোলা যাচ্ছে না, বিদেশগমনেচ্ছু শিক্ষার্থী ও রোগীদের মধ্যে হাহাকার, সরকার ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে; তখন কোটি কোটি ডলার খরচ করে ডিসি-ইউএনওদের জন নতুন গাড়ি ক্রয় ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’! নির্বাচনের আগে সচিবদের নামে কোটি কোটি টাকার প্লট বরাদ্দ দেয়া রহস্যজনক বটে।

https://dailyinqilab.com/national/article/610564