১৭ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:১৪

আট কারণে ধীরগতির শহর চট্টগ্রাম

বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শীর্ষ ২০টি শহরের মধ্যে ১২তম স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম। নগরটিতে দিন দিন যানজটের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে অফিস ছুটির সময় তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গতকাল বিকেলে মুরাদপুর এলাকা থেকে তোলা। ছবি : রবি শংকর
সকাল সাড়ে ৭টা। শহরের অক্সিজেন মোড়। কয়েক শ মানুষ। সবাই গাড়ির অপেক্ষায়।

কেউ কেউ ৪৫ মিনিটেও গাড়ি পাচ্ছিল না। এর কারণ তীব্র যানজট। পুরো সড়কই অনেকটা স্থবির হয়ে ছিল।
চট্টগ্রাম শহরের যানজটের এই চিত্র নিত্যকার ঘটনা।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের গবেষণায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘দ্য ফাস্ট, দ্য স্লো অ্যান্ড দ্য কনজাস্টেড : আরবান ট্রান্সপোর্টেশন ইন রিচ অ্যান্ড পুওর কান্ট্রিজ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় বিশ্বের শীর্ষ ২০ ধীরগতির শহরের তালিকায় চট্টগ্রাম শহরের অবস্থান ১২তম। আগস্টে প্রকাশিত গবেষণার ওই তালিকায় ঢাকার অবস্থান শীর্ষে, ময়মনসিংহ নবম।
অক্সিজেন মোড়ে মানুষের ভিড়ে গাড়ির অপেক্ষায় ছিলেন গার্মেন্টস শ্রমিক নার্গিস আক্তারও।

তিনি বলেন, ‘৪০ থেকে ৪৫ মিনিট ধরে অফিসের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। কখন গিয়ে পৌঁছব বুঝতে পারছি না।’ জসিম উদ্দিন নামের অন্য এক চাকরিজীবী বলেন, ‘যানজট দেখে আমি বাস থেকে নেমে কিছুক্ষণ হেঁটেছি। আরেকটি গাড়ি ধরার জন্য এখানে (অক্সিজেন মোড়) এসেছি। এখানেও তীব্র যানজট।

নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বাণিজ্যিক এলাকায় সরু রাস্তা, অপর্যাপ্ত সড়ক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ঘিরে ব্যস্ততা, গণপরিবহনসংকট, ফুটপাত বেদখল, যাত্রীর তুলনায় কম গণপরিবহন, অতিরিক্ত রিকশা এবং ধারণক্ষমতার প্রায় তিন গুণ জনসংখ্যার কারণে শহরে যানজট প্রকট হচ্ছে।
বাণিজ্যিক এলাকায় সরু রাস্তা

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে পাঁচ হাজারের বেশি আড়ত। কিন্তু এখানকার রাস্তাগুলো সরু। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ও সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে এখনো এখানকার সড়কগুলো অপ্রশস্তই রয়ে গেছে। পণ্যবাহী একটি ট্রাক এখানে এলে যানজটের কারণে বের হতে অনেক সময় দুই-তিন দিনও লেগে যায়। এতে পণ্য আনতে ভাড়া বেশি নিচ্ছে। আবার অনেকে আসতেও চায় না। এখানে ২৪ ঘণ্টা যানজট থাকে।

ইপিজেড, কেপিজেডসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কারখানায় প্রতিদিন কয়েক লাখ কর্মজীবী মানুষের যাতায়াত। নগরের আগ্রাবাদ থেকে কাটগড়, পতেঙ্গা সি বিচ সড়ক হয়ে তাঁরা চলাচল করেন। এর মধ্যে বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ থেকে বিমানবন্দরমুখী বারিক বিল্ডিং, কাস্টমস মোড়, সল্টগোলা, ইপিজেড পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার সড়কে যানজট ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সড়ক মাত্র ৮ শতাংশ
বিআরটিআর হিসেবে চট্টগ্রামে তিন লাখ ৩৭ হাজার ১৬১টি যানবাহন চলাচল করে। এর বাইরে রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা আছে তিন লাখের বেশি। জনসংখ্যা ও যানবাহন অনুপাতে যে পরিমাণ সড়ক থাকার কথা, তা ৬০ বর্গকিলোমিটারের আয়তনের চট্টগ্রামে নেই।
জানতে চাইলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (যানবাহন) আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, যেকোনো শহরে যানবাহন চলাচলের জন্য অন্তত ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকা দরকার। সেখানে চট্টগ্রামে আছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্ততা
নগরের কাজীর দেউড়ি থেকে জামালখান, জামালখান থেকে চেরাগী পাহাড় এবং জামালখান থেকে গনি বেকারি—ওই তিনটি সড়কে গতকাল দুপুর পৌনে ১২টায় প্রায় তিন কিলোমিটার যানজট ছিল। দেখা যায়, এ সময় জামালখান এলাকায় এজি চার্জ, ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সেন্ট মেরিজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা আসা-যাওয়া করছে। দুপুর ও বিকেলে ছুটির সময় চকবাজার, বাদশা মিয়া ও সার্সন—এই তিন সড়কে দীর্ঘ যানজট হয়। সিজিএস স্কুলের সামনে সড়কের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে থাকে প্রাইভেট কার।

মেহেদীবাগ থেকে প্রবর্ত্তক, গোলপাহাড় থেকে জিইসি মোড়, প্রবর্ত্তক থেকে পাঁচলাইশ ও চকবাজার থেকে কেবি আমান আলী রোড, কেবি ফজলুল কাদের রোড এলাকায় সরকারি-বেসরকারি অনেক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। দিনের বেশির ভাগ সময় এসব সড়কে যানজট লেগেই থাকে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী খান বলেন, হাসপাতালের সামনের সড়কগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রশস্ত। দিনে কম থাকলেও সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত যানজট বেশি থাকে। কারণ ওই সময় চিকিৎসকদের চেম্বারে রোগী ও তাদের স্বজনরা বেশি আসে। সড়কগুলো প্রশস্তকরণ জরুরি।

যাত্রীর তুলনায় কম গণপরিবহন
সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জনসংখ্যা প্রায় পৌনে এক কোটি। মোট যানবাহনের মধ্যে গণপরিবহন মাত্র ৩.৩১ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু বাস-মিনিবাস আছে মাত্র ১.৪৭ শতাংশ। আর মোট যানবাহনের ৩.৮৬ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা। বাকি ৯৩ শতাংশ অন্যান্য যানবাহন।

বিআরটিএ চট্টগ্রামের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে চলতি ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরে নিবন্ধিত মোট যানবাহনের সংখ্যা তিন লাখ ৩৭ হাজার ১৬১। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুই লাখ পাঁচ হাজার ৬৩টি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ১৩ হাজার, অটো টেম্পো তিন হাজার ২৭০, বাস দুই হাজার ৪১০, হিউম্যান হলার দুই হাজার ৯১৮ এবং মিনিবাস দুই হাজার ৫৬৩টি। প্রাইভেট কার ৩৯ হাজার ৩৩টি।

তিন লাখ রিকশা
চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী মঞ্জু বলেন, নগরের সব সড়কে তিন লাখের বেশি রিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। বিমানবন্দর সড়কেও রিকশা চলছে। ধীরগতির এসব বাহনের কারণে গাড়ির গতি কমে গেছে। দূরপাল্লার গাড়ি চলাচলে শৃঙ্খলা আছে। কিন্তু নগরের রাস্তায় সব রুটে কাউন্টারভিত্তিক গণপরিবহন না থাকায় সড়কে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে।

মেট্রোপলিটন সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, ‘দুটি রুটে আমাদের কাউন্টারভিত্তিক বাস সার্ভিস আছে। সব রুটে প্রয়োজন।’

ফুটপাত বেদখল, পথচারী সড়কে
চসিকের হিসাব মতে, শহরে পাকা ফুটপাতের সংখ্যা ১৪৫। মোট দৈর্ঘ্য ১৫১ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৭.২৮ মিটার। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নগরের নিউ মার্কেট, হকার মার্কেট, তামাকুমণ্ডি লেন, রিয়াজউদ্দিন বাজার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে, স্টেশন রোড, কলেজ রোড, গুলজার মোড়, চকবাজার, লালদীঘির পাড়, আন্দরকিল্লা, জামালখান, আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাত বেদখল হয়ে গেছে। এসব ফুটপাতে বসেছে দোকানপাট। বিভিন্ন সড়কের দুই পাশে হকার বসছে।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ছালামত আলী বলেন, নগরে চারটি হকার সমিতির দখলে বেশির ভাগ ফুটপাত। ফুটপাতের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় সড়কের ওপরও তারা ব্যবসা করছে। অবস্থা এমন যে ফুটপাত ও সড়কে পথচারীদের হাঁটারও পথ নেই।

দুর্বল সিগন্যাল ব্যবস্থা
নগরে ৪১টি ওয়ার্ড। ট্রাফিক পুলিশ বলছে, নগরের সড়ক-উপসড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা প্রয়োজন। অথচ শহরের বেশির ভাগ এলাকায় এখনো পুরনো সিগন্যাল ব্যবস্থা আছে। এর বেশির ভাগই নিষ্ক্রিয়। এ কারণে ট্রাফিক পুলিশ সড়কে দাঁড়িয়ে অনেকটা হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করে। যানবাহন নিয়ন্ত্রণে তাদের হিমশিম খেতে হয়। এতে যানজট নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ছে।

ধারণক্ষতার তিন গুণ জনসংখ্যা
সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, নগরে এক হাজার ১৯৫.৫ কিলোমিটার সড়ক আছে। এসব সড়কের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রশস্ততা ৭.২০ মিটার। বর্তমান সড়কারের আমলে সিডিএর মাধ্যমে নগরের অনেক সড়ক-উপসড়ক প্রশস্ত করা হলেও যানবাহন কয়েক গুণ বেড়েছে। এ ছাড়া গণপরিবহন চলাচলের জন্য নতুন কোনো সড়ক নির্মাণ করা হয়নি। চারটি উড়াল সেতু নির্মাণ করা হলেও যানজট কমছে না। বিশেযজ্ঞরা বলছেন, যানজট পরিস্থিতি আরো প্রকট হচ্ছে।

সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, এই শহরে জনসংখ্যা হওয়া উচিত ছিল ২৫ থেকে ৩০ লাখ। সেখানে বর্তমান জনসংখ্যা ৭০ লাখ। জনঘনত্ব ও যানজটের কারণে যানবাহনের গতি যেভাবে কমেছে, তাতে আশঙ্কা করা যেতে পারে ভবিষ্যতে গাড়ির গতি থাকবে না।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (যানবাহন) আবদুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেকোনো শহরে যানবাহন চলাচলের জন্য অন্তত ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকা দরকার। সেখানে চট্টগ্রাম নগরে রয়েছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ঢাকা শহরে বিভিন্ন হালকা যানের জন্য আলাদা রুট থাকলেও চট্টগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে এই ব্যবস্থা নেই। একই সঙ্গে ধীরগতির গাড়ি থেকে শুরু করে সব ধরনের যানবাহন চলাচল করছে। রিকশা, ব্যাটারিচালিত যানসহ বিভিন্ন গাড়ির জন্য আলাদা রাস্তা (লেন) করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক বলেন, ‘নগরে গণপরিবহনের অবস্থা খুবই নাজুক। গণপরিবহনের সংখ্যা কম হওয়ায় মানুষ দুর্ভোগে আছে। অন্যান্য যানবাহন প্রচুর। গণপরিবহনের জন্য যানজট হয় না। সেখানে মানুষের যাতায়াতও বেশি। কিন্তু ব্যক্তিগতসহ অন্যান্য শ্রেণির যানবাহন কমিয়ে গণপরিবহনের দিকে নজর দিলে যানজটও কমে আসবে। নীতিমালার আলোকে নগর পরিবহন ব্যবস্থা পরিচালনা করলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/10/17/1327653