১৭ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:০৬

সীমান্ত পেরিয়ে দেশে আসছে অবৈধ অস্ত্র

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সীমান্ত পেরিয়ে দুর্বৃত্তদের হাতে চলে আসছে অবৈধ অস্ত্র। এসব অস্ত্র প্রস্তুতের জন্য ভারতে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট কারখানা। অল্প টাকাতেই এসব কারখানায় অস্ত্র তৈরি করা হয় বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। সীমান্তের ওপারের কারবারিরা দেশীয় কারবারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুযোগ বুঝে হাতে তুলে দিচ্ছে অস্ত্রের চালান। ইতোমধ্যে কয়েক ধাপে অবৈধ অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে চলে আসছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সরকারি ও বিরোধী দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার বক্তব্যেও অবৈধ অস্ত্রের বিষয়টি উঠে আসে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে অভিযানের কথা বলছেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করেই পেশাদার সন্ত্রাসীরা ছোট-বড় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ ও নাইন এমএম পিস্তল বেশি ঢুকছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে। পয়েন্ট টু-টু বোরের রিভলভার আসছে সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে। কুমিল্লা, যশোরের বেনাপোল ও হিলি সীমান্ত হয়েও এ ধরনের অস্ত্র ঢুকছে দেশে।

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টারের (বিডিপিসি) এক গবেষণা অনুযায়ী, দেশে অবৈধ অস্ত্র আমদানির শতাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে। অবৈধ অস্ত্রের মালিকরা অস্ত্র ভাড়া দিচ্ছেন একশ্রেণির সন্ত্রাসীর কাছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে আসা বেশির ভাগ অস্ত্র তৈরি হয় ভারতে। ভারতের বিহারের রাজধানী পাটনা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের শহর মুঙ্গেরে তৈরি হয় এসব অস্ত্র। মুঙ্গেরে তৈরি অস্ত্র অবৈধ পথে আসে বাংলাদেশে। গত বছরের শেষের দিকে পাচারের সময় প্রায় অর্ধশত একে-৪৭ বন্দুক জব্দ করে ভারতের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। মুঙ্গেরের চুরওয়া, মস্তকপুর, বরহদ, নয়াগাঁও, তৌফির দিয়ারা, শাদিপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে কুটির শিল্পের মতো অবৈধ অস্ত্র তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় অল্প খরচে অস্ত্র তৈরি করে বাংলাদেশের অবৈধ অস্ত্রের সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেখানে অর্ডার দিয়ে অস্ত্র তৈরি করে অপরাধী চক্র।

গত কয়েক মাসে রাজধানীর পাশাপাশি বরিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পাবনা ও যশোর এলাকায় সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির অভিযানে গত এক বছরে সাত হাজার ৪১৭টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই আগ্নেয়াস্ত্র। এক পরিসংখ্যানে দুই মাসে প্রতিদিন গড়ে পাঁচজন করে গুলীবিদ্ধ হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। গত এক বছরে অবৈধ অস্ত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরিসংখ্যান থেকে এসব তথ্য জানা যায়।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিরোধ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা এবং অন্যান্য অপরাধমূলক ঘটনায় প্রকাশ্যে ও আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলাবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বে আইনি অস্ত্র উদ্ধারে সমন্বিত অভিযান চালাতে সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, কারা আগ্নেয়াস্ত্র অবৈধভাবে দেশে আনছে, কারা কিনছে, কারা ব্যবহার করছে তা সার্বিকভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে সারা দেশে অভিযান চালিয়ে এক হাজার ৩৯৪টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে তারা। এ সময় ৬০২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে দেশী-বিদেশী রিভলভার ৭১টি, ১৯৫টি দেশী-বিদেশী পিস্তল, একটি এসএমজি, দুটি একে-৪৭ রাইফেল, একটি একে-২২ রাইফেল, তিনটি রাইফেল, ৪৪৩টি ওয়ান শ্যুটার গান, ৪১০টি এয়ারগান, ছয়টি শটগান, ৮২টি পয়েন্ট ২২ বোর রাইফেল, ৮৫টি এসবিবিএল, ২৫টি ডিবিবিএল, ৬৪টি এলজি, তিনটি কাটা রাইফেল, দুটি রকেট লঞ্চার শেল এবং একটি রকেট লঞ্চার। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় ৪৫০টি মামলা করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ডিএমপি ৬৫টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২৬২টি গুলী এবং চার হাজার ২৬৮ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করেছে। এ সময় অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংক্রান্ত মামলায় ৪১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, ২০২২ সালে সারা দেশে আগ্নেয়াস্ত্রসহ পাঁচ হাজার ৮৭৯টি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে যশোরের দর্শনা, বেনাপোল, সাতক্ষীরার শাঁকারা, মেহেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লাসহ অন্তত ৩০টি রুট দিয়ে আমদানি করা হয় অবৈধ অস্ত্র। বিভিন্ন পণ্যের গাড়িতে করে এসব অস্ত্র আমদানি হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অস্ত্রের বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদাভাবে আমদানি করা হয়। কারও কাছে স্প্রিং বা ট্রিগার, কারও কাছে শুধুই নল। এভাবেই নানা কৌশলে আমদানি করা হয় অবৈধ অস্ত্র। গত মাসে সীমান্ত এলাকায় ছয়টি বন্দুক, একটি পিস্তল, ৫৩টি ককটেল ও ৬২ রাউন্ড গুলি জব্দ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। মে মাসে দুটি পিস্তলসহ বিভিন্ন ধরনের ১২টি আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়। একইভাবে এপ্রিল মাসে আটটি পিস্তল জব্দ করে বিজিবি।

এদিকে অবৈধ অস্ত্রধারীদের ধরতে সারাদেশে বিশেষ অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। সম্প্রতি রাজধানীর পল্টনে ট্যুরিস্ট পুলিশ সদর দফতরে ‘পর্যটন নিরাপত্তায় ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা: বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশের দৃষ্টিভঙ্গি’ শীর্ষক সেমিনারে অংশগ্রহণের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের বিষয়টি কৌশলগত কারণে বলতে চাইছি না। চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জাতীয় নির্বাচনে পুলিশ যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে।

এদিকে যাদের কাছে বৈধ অস্ত্র আছে তারা সেগুলো নির্বাচনের আগে থানায় জমা না দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো. হারুন অর রশীদ। গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। নির্বাচনের আগে তাদের বিশেষ অভিযান চলছে জানিয়ে ডিবিপ্রধান বলেন, আমাদের কাছে তথ্য আসছে, অনেকে এসব অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করছে এবং হুমকি দিচ্ছে। এটাও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। আমরা তাদের গ্রেপ্তার করব। হারুন আরও বলেন, খুব শিগগিরই নির্দেশ দেওয়া হবে, যাদের বৈধ অস্ত্র আছে তারা যেন সেগুলো থানায় জমা দেন। কেউ যদি সেই নির্দেশ অমান্য করে, তবে এটা এক ধরনের অপরাধ হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের অবশ্যই গ্রেপ্তার করবে এবং তাদের অস্ত্র নিয়ে আসবে। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলাও হবে বলে উল্লেখ করেন ডিবিপ্রধান।

https://www.dailysangram.info/post/538278