১৬ অক্টোবর ২০২৩, সোমবার, ১২:৪৬

ই-পাসপোর্ট প্রকল্প ব্যয়ে বড় উল্লম্ফন

গুদাম ভাড়া, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শকসহ বেশ কয়েকটি খাতের ব্যয় মূল প্রকল্পে ছিল না

সরকারের অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত ই-পাসপোর্ট প্রকল্প ব্যয়ে বড় ধরনের উল্লম্ফন হতে যাচ্ছে। এক লাফে খরচ বাড়ছে ৭৬ শতাংশের বেশি। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবের খসড়া (আরডিপিপি) চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের।

তবে ব্যয় বাড়লেও প্রকল্পের সময়সীমা বহু আগেই পেরিয়ে গেছে। এখনো নির্ধারিত কাজের অনেক কিছুই বাকি। প্রশ্ন রয়েছে সম্পাদিত কাজের মান নিয়েও। তবে অজ্ঞাত কারণে এসব নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি নন সংশ্লিষ্টদের কেউ।
জানা যায়, দেশে ই-পাসপোর্ট প্রবর্তনের লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই জার্মান প্রতিষ্ঠান ভেরিডোজের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। এ সময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় চার হাজার ছয়শ কোটি টাকা। শর্ত অনুযায়ী দেড় বছরের মধ্যে প্রকল্পের প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু পাঁচ বছর পর এখন অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধির তোড়জোড় চলছে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাদাত হোসেন রোববার তার কার্যালয়ে যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিক হচ্ছে তা এখনই চূড়ান্তভাবে বলা যাবে না। কারণ এ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি এখনো একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। ব্যয় প্রস্তাব গোপনীয় বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে একনেকের অনুমোদনের পর চূড়ান্ত হবে। তখন হয়তো টাকার অঙ্ক বলা যাবে।

সূত্র বলছে, প্রকল্পের জন্য গুদাম, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শকসহ বেশ কয়েকটি খাতে নতুন করে ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মূল প্রকল্পে ছিল না। এর বাইরে উন্নত মানের ক্যামেরা, বুকলেট ক্রয়, নতুন লোকবল, বাড়ি ভাড়া, ফোন বিল, এসএমএস (খুদে বার্তা) সেবা, যানবাহনের জ্বালানি ও ভ্রমণ খাতে ব্যয় বাড়ছে। এর মধ্যে গুদাম (ওয়্যার হাউজ) ভাড়া ও পরামর্শক খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে যথাক্রমে ২৮ ও ১৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল চার হাজার ৬শ ৩৫ কোটি টাকা। সেটি এখন বেড়ে হচ্ছে ৮ হাজার দুশ কোটি টাকার বেশি।

তবে গুদাম ভাড়া, বুকলেট ক্রয়, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শক খাতের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক এক মহাপরিচালক যুগান্তরকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে গুদাম ভাড়া দেওয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া এমআরপি (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) প্রকল্পেও গুদাম ভাড়া দেওয়া হয়নি। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরাসরি মিশনে পৌঁছে দেয় তৎকালীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আইরিশ। ফলে ই-পাসপোর্টের প্রকল্পের নতুন করে গুদাম ভাড়া দেওয়া হলে বিতর্ক তৈরি হবে। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাই মূলত তদারক বা পরামর্শকের ভূমিকা পালন করে। ফলে পরামর্শক খাতে নতুন করে বরাদ্দ দেওয়া হলে এতে ব্যয়ের বোঝা আরও বাড়বে। এছাড়া চুক্তি অনুযায়ী বিনামূল্যে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ১০০ জনবলকে জার্মানিতে এবং ১ হাজার কর্মীকে দেশে প্রশিক্ষণের আওতায় আনার কথা বলা আছে। এ অবস্থায় নতুন করে প্রশিক্ষণ খাতে অর্থ খরচের প্রস্তাব মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, খরচের একটি বড় অংশ যাচ্ছে বর্ধিত দরে ৫০ লাখ বুকলেট কিনতে। কিন্তু এখনই বুকলেট কেনার উদ্যোগ অপ্রাসঙ্গিক মনে করেন অনেকে। কারণ চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে তিন কোটি বুকলেট সরবরাহ করতে হবে। তাই পুরো চালান আসার আগেই নতুন করে ৫০ লাখ বুকলেট কেনা হলে অহেতুক বিতর্ক তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় বিদেশ ভ্রমণের সুযোগের অপব্যবহার হচ্ছে। ই-পাসপোর্ট উদ্বোধনের কথা বলে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত স্টাফরাও বিদেশ সফরে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুক্তির শর্ত ছিল ২০২০ সালের মধ্যে দেশের সব অফিসসহ ৮০টি বিদেশি মিশনে ই-পাসপোর্ট চালু করতে হবে। কিন্তু কয়েক দফায় সময় বাড়িয়ে দেশে ই-পাসপোর্ট চালু হলেও বেশিরভাগ বিদেশি মিশন এখনো অন্ধকারে। তদুপরি বড় মিশন বাদ দিয়ে ছোট ছোট দেশে ই-পাসপোর্ট চালু করা হচ্ছে। অথচ সৌদি আরব বা মালয়েশিয়ায় পাসপোর্ট পেতে হাহাকার করছেন প্রবাসীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল প্রকল্প শুরুর এক বছরের মধ্যে দৈনিক ২৫ হাজার পাসপোর্ট বই প্রিন্টিং সক্ষমতা অর্জন করা। কিন্তু বর্তমানে সর্বোচ্চ প্রিন্টিং রেকর্ড ২২ থেকে ২৩ হাজার। অথচ এখন দৈনিক চাহিদা বেড়ে ৩০ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। এর সঙ্গে সৌদি এবং মালয়েশিয়া মিশন যোগ হলে চাহিদার পরিমাণ আরও বাড়বে। তখন পাসপোর্ট নিয়ে বৈরী পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন কেউ কেউ।

সূত্র জানায়, স্পর্শকাতর বিবেচনায় প্রকল্পে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলা হয়। বিশেষ করে স্থানীয় জনবল নিয়োগে গোয়েন্দা যাচাই ও ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক। কিন্তু বর্তমানে গোয়েন্দা ক্লিয়ারেন্স ছাড়াই স্থানীয়দের অনেকে প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, জনৈক মির্জা, ফাউজুর রহমান ওরফে রাজু এবং সাফকাত মতিন ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে সম্পৃক্ত। এমনকি তাদের কেউ কেউ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকেও অংশ নেন। কিন্তু কাগজপত্রে কোথাও তাদের নাম নেই। এদের মধ্যে ই-গেট সরবরাহ, স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে বিমানবন্দরে সক্রিয় মির্জা ও সাফকাত মতিন নিজেদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোক বলে পরিচয় দেন। এ ছাড়া ফউজুর রহমান ওরফে রাজু সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতা হিসাবে পরিচিত। তিনি এর আগে এমআরপি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

সূত্র জানায়, চলতি বছর সার্ভিস মেইনটেনেন্সর নামে হঠাৎ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৮৮ কোটি টাকার অতিরিক্ত বিল দেওয়া নিয়ে হইচই পড়ে। কারণ চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিনামূল্যে সার্ভিসিং, আপগ্রেডেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ সেবা চালু রাখতে হবে। এমনকি প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও বিনামূল্যের সেবা চালু থাকবে টানা ১০ বছর। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলে ক্ষতিপূরণের শর্ত রয়েছে চুক্তিতে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/729314