১৬ অক্টোবর ২০২৩, সোমবার, ১২:৪৪

মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণ ধুঁকছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান

পরিস্থিতি উন্নয়নে ৭ প্রতিষ্ঠানের কাছে পরিকল্পনা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক

বিতরণ করা ঋণের বেশির ভাগই আদায় করতে পারছে না ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার আমানতকারীদের অর্থ যথাসময়ে ফেরত দিতে না পারায় আস্থার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। আগের মতো আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। এতে নতুন করে ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এতে বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে পড়ছে। একদিকে অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে, সেই সাথে কাক্সিক্ষত আয় না থাকায় খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছেন না। এতে বড় অঙ্কের মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় সঙ্কট দ্রুত কাটিয়ে পরিস্থিতি উন্নয়নে সাত প্রতিষ্ঠানের কাছে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা চেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সাথে বৈঠক করে এমনই পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাহীদের কাছে। বৈঠক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, নানা ছাড় দেয়ার পরও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ হিসাবে মতে, ১০০ টাকার ঋণের মধ্যে প্রায় ২৮ টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে। তবে, প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অনেক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের অর্থ ফেরতই দিতে পারছে না। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ফেরত দিচ্ছে অল্প অল্প করে। এ বিষয়ে একজন গ্রাহক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, মেয়ের বিয়ের জন্য কিছু টাকা জমিয়েছিলেন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক অনুরোধ করে কিছু টাকা ফেরত দিয়েছে। তবে ফেরত দেয়া হয়েছে তার জমানো অর্থের মাত্র ৫ ভাগের এক ভাগ। বাকি অর্থ মাসে মাসে ফেরত দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যথাসময়ে টাকা না পাওয়ায় এখন মেয়ের বিয়েই পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।

দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমনই চিত্র অহরহ শোনা যাচ্ছে। গ্রাহকরা টাকা রেখে তা যথাসময়ে ফেরত পাচ্ছেন না। এমনকি সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ রেখে ফেরত পাচ্ছে না। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, মূলত কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পি কে হালদারের ঋণ কেলেঙ্কারির চিত্র বের হওয়ার পর থেকে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এতে আস্থার সঙ্কট দেখা দেয় গ্রাহকদের মধ্যে। এতে আমানত প্রবাহ কমে গেছে। আবার যাদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তারাও যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করছেন না। একদিকে আমানত কমে গেছে, অপর দিকে কমে গেছে ঋণ আদায়। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো নগদ টাকার সঙ্কটে পড়েছে। এতে ব্যাপক ভিত্তিতে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর তিন মাস আগে গত মার্চ শেষে ঋণ স্থিতি ছিল ৭১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৫ দশমিক ০৫ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দুই হাজার ৯৬ কোটি টাকা।

তবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে চার হাজার ১৫ কোটি টাকা। গত বছরের জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থিতি ছিল ৬৯ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। ওই সময়ে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২২ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে চলতি বছরের (এপ্রিল-জুন) প্রান্তিকে। গত বছরের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত কেউ কিস্তির অর্ধেক পরিশোধ করলে তাকে খেলাপি না করার নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নির্দেশনার ফলে খেলাপি ঋণ কমার কথা ছিল। কিন্তু উল্টো খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৮০ শতাংশের ওপরে। এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড ও ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। এর মধ্যে প্রথম চারটি প্রতিষ্ঠানে মালিকানা আছে পি কে হালদারের। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ টাকা তিনি নামে-বেনামে তুলে নিয়েছেন, যা এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে।

গতকাল সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সাথে বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দ্রত সঙ্কট উত্তরণে পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নির্বাহী পরিচালক, পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বৈঠকে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে নিজ নিজ কোম্পানির মূলধন সংরক্ষণ পরিকল্পনা জমা দেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। শিগগিরই বাকি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই নির্দেশনার আওতায় নিয়ে আসা হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/784539