১৫ অক্টোবর ২০২৩, রবিবার, ১০:৫৮

এক দিনে আরও ১০ জনের মৃত্যু, ভর্তি ২০৪৭

ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের ৮৭ ভাগই ডেন-২

দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের ৮৭ শতাংশই ডেন-২ ধরনের শিকার। বাকি ১৩ শতাংশ শিশু ডেন-৩-এ আক্রান্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের এক গবেষণায় ভয়ংকর এ তথ্য উঠে এসেছে।
শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে শিশু হাসপাতাল মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে এ গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন হাসপাতালের পরিচালক ও গবেষণার প্রধান গবেষক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম।

এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৫৮ জনে। এছাড়া ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৪৭ জন। শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

অন্যদিকে ডেঙ্গু কেড়ে নিল রাজধানীর মিরপুরের একটি মাদ্রসার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী ৯ বছর বয়সি হাফসাতুন্নেসা তাসনিমের। হাফসাকে হারিয়ে পরিবারে চলছে শোকের মাতম। হাফসার গর্ভবতী মা রাকিবা আক্তার রূপা জানান, এ মাসেই ‘ভাই পৃথিবীতে আসবে’ এ নিয়ে অপেক্ষার তর সইছিল না হাফসার। ভাই আসবে, জেনে কী যে খুশি সে। সারাক্ষণ শুধু বলত, মা ভাইয়াটা কবে আসবে? কবে ভাইয়াকে কোলে নেব?

মিরপুর-২ নম্বরের বাসিন্দা হাফেজ আবুল কালাম ও রাকিবা আক্তার রূপার মেয়ে হাফসা জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার তিন দিনের মাথায় মারা যায়। তিন দিনের জ্বরে সন্তানের এমন মৃত্যু অবিশ্বাস্য ঠেকছে মায়ের কাছে।

রূপা বলেন, ‘মেয়েটা আমাকে বলছিল, জন্মদিনে বিরিয়ানি রান্না করতে। আমার বিরিয়ানি রান্না করা হলো না। মেয়ের খাওয়াও হলো না। মেয়েটা কেন এভাবে চলে গেল? ওর ভাইকে দেখতে পারল না। আমার মেয়েটা শুধু বেঁচে থাকত। আর কিছুর দরকার ছিল না। আমার ঘরটা খালি হয়ে গেছে। জ্বর ওঠার পরও ছোট বোনের সঙ্গে গাড়ি নিয়ে খেলছে বাসার সামনে। আর এখন সে পৃথিবীতেই নেই। এই কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে কেমন করে বেঁচে আছি।’

হাফসার বাবা হাফেজ আবুল কালাম বলেন, ‘আমাকে আমার মেয়ে বলছিল, আব্বু আমি বাসায় যাব। বাসায় ঠিকই নিয়ে আসছি; কিন্তু ওর লাশ। ওর চিরস্থায়ী বাসায় ওকে আমরা রেখে আসছি।’

হাফসার মতো অসংখ্য শিশু এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সরকারি হিসাবেই এ সংখ্যা ১৯৯। এর বেশির ভাগই আক্রান্ত হয়েছিল ডেঙ্গুর ডেন-২ ধরনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তারা প্রকাশ করতে পারে না। ডেঙ্গুতে তাদের ফ্লুইড ব্যবস্থাপনাও বেশ জটিল। এ কারণে তারা থাকে ঝুঁকিতে।

২০২৩ সালের জুন থেকে আগস্ট-এ তিন মাস বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১ হাজার ৩৯ শিশু ভর্তি হয়। এ শিশু রোগীর মধ্যে ৭২২ জনের ওপর রোগতাত্ত্বিক গবেষণা চালনো হয়। অন্যদিকে ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ নির্ধারণ এবং অন্যান্য ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্তকরণে ওই ৭২২ শিশু রোগীর মধ্য থেকে থেকে ১০৪ জনের রক্ত ও ন্যাজোফ্রানজিয়াল সোয়াব সংগ্রহ করা হয়। পরে সেই নমুনা আইসিডিডিআর,বির ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়।

অপরদিকে ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ ছিল; কিন্তু এনএস-১ অথবা আইজিএম পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়নি-এমন ৫০ জন ভর্তি রোগীর রক্ত ও ন্যাজোফ্রানজিয়াল সোয়াবও সংগ্রহ করা হয়। পরে সেই নমুনা আইসিডিডিআর,বির ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়।

এসব শিশু রোগীর নমুনা সংগ্রহের ফলাফলে দেখা যায়, এনএস-১ এবং আইজিএম নেগেটিভ ৫০টি নমুনার মধ্যে আরটি পিসিআর পরীক্ষায় ১৭টি (৩৪ শতাংশ) ফলস নেগেটিভ। এ নেগেটিভ রোগীর মধ্যে আবার ১৯ শতাংশের ছিল ডেঙ্গু পজিটিভ। এছাড়া বাকি ১২ শতাংশ রোগী অন্যান্য ভাইরাসে (ইনফ্লুয়েঞ্জা ও রেসপাইরেটরি সিনসাইটাল ভাইরাস) আক্রান্ত ছিল।

জিনোম সিকোয়েন্স পরীক্ষায় দেখা যায়, ওই শিশুদের মধ্যে ১১৩টি ডেঙ্গু পজিটিভ নমুনায় ৮৭ শতাংশ ডেন-২ এবং ১৩ শতাংশের ডেন-৩ ধরনের উপস্থিতি মেলে। শিশুরা ২০১৮ সালেও এসব ধরনে আক্রান্ত হয়েছিল। ওই বছরও ৮৭ শতাংশ শিশুর দেহে ডেন-২ ধরনের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল।

প্রধান গবেষক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, গবেষণার অংশ হিসাবে পূর্ণাঙ্গ সিকোয়েন্সিংয়ের কাজ চলমান। যার ফল হাতে পেলে আরও তথ্য আমরা জানাতে পারব।

আইইডিসিআর-এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন বলেন, প্রথমবার যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়, তাদের খুব বেশি ডেঙ্গুর উপসর্গ থাকে না। প্রথমবার সাধারণত ডেন-১ সেরোটাইপে আক্রান্ত হয়। তবে দ্বিতীয়বার তারা অন্য সেরোটাইপে আক্রান্ত হয়। এ বছর ডেন-২ এবং ডেন-৩ সংক্রমণ বেশি পাওয়া যাচ্ছে, যা শিশুর জীবনকে বেশি ঝুঁকিতে ফেলছে। তিনি বলেন, শিশুর প্রতি আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। শুধু ডেঙ্গু আক্রান্ত নয়, ডেঙ্গু উপসর্গ থাকলেও সেটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, শিশু মশার বিষয়ে সচেতন না। তাদের প্রতিরোধের ক্ষমতাও কম। রোগের বিষয় থাকে আড়ালে। এমন শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের সুচিকিৎসা পাওয়াও কঠিন। কারণ, তাদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল খুব কম। ঢাকার বাইরে জেলা-উপজেলায় সুবিধা নেই বললেই চলে। ফলে চাপ পড়ে ঢাকার হাসপাতালে। অনেক শিশু দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে তাদের ঝুঁকি বেশি। আমি মনে করি, মশক নিধনে জোর দেওয়ার পাশাপাশি আক্রান্ত শিশুর দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/728917