১৫ অক্টোবর ২০২৩, রবিবার, ১০:৫৫

জাতিসঙ্ঘে যুদ্ধবিরতির আহ্বান রাশিয়ার

ইসরাইলি হামলায় শত শত ফিলিস্তিনি নিহত

- ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত ৩২৪

ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে নির্বিচারে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত বিমান হামলায় গাজায় দুই হাজার ২০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গতকাল শনিবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত আট দিন ধরে চলা ইসরাইলি বিমান হামলায় দুই হাজার ২১৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে শিশুই ৭২৪ জন। নির্বিচার এসব হামলায় আট হাজার ৭১৪ জন আহত হয়েছেন। আলজাজিরা, বিবিসি ও রয়টার্স।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরো জানিয়েছে, শুধু সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় বিমান হামলায় ৩২৪ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া এক দিনেই আহত হয়েছেন এক হাজার মানুষ। এখন পর্যন্ত যত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৬৬ শতাংশই নারী ও শিশু বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

এ দিকে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ট্যাংকের সহযোগিতায় পদাতিক বাহিনী গাজায় স্থানীয়ভাবে অভিযান চালিয়েছে। যদিও তারা দাবি করেছে, হামাসের অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালানো হচ্ছে। তবে নির্বিচার এসব হামলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অব্যাহত বিমান হামলার মধ্যেই গাজায় স্থল অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইল। এর অংশ হিসেবে গাজা সীমান্তের কাছে তিন লাখ সেনা ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র জড়ো করেছে তারা। সম্ভাব্য স্থল অভিযানের আগে, গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ১১ লাখ মানুষকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরাইল। তাদের এমন নির্দেশনার পর কয়েক হাজার মানুষ সরে গেলেও, বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি তাদের নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছেন।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের এক কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা গাজার উত্তরাঞ্চলের এবং গাজা শহরের জনগণকে নিজেদের বাড়িতে থাকতে বলেছি। ইসরাইল বলেছে, শুক্রবার তাদের পদাতিক বাহিনী এবং ট্যাংকগুলো, গাজা উপত্যকার অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়েছে।

এর আগে ইসরাইল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলের ১০ লাখের বেশি বাসিন্দাকে ওই অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। তবে হামাস জানিয়েছে, ইসরাইলের এমন হুমকিতে ভীত নন ফিলিস্তিনিরা। তারা ইসরাইলের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। এ দিকে শুক্রবার লেবাননে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর হামলায় ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক ফটোসাংবাদিক নিহত এবং আলজাজিরা, রয়টার্স, এপিসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, ইসরাইলের হামলায় রয়টার্সের এক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। তার নাম ইশাম আবদুল্লাহ। এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে রয়টার্স জানায়, ‘ইশাম দক্ষিণ লেবাননে কাজ করা রয়টার্সের ক্রুদের সাথে সরাসরি সিগন্যাল দেয়ার কাজ করছিলেন। ওই অঞ্চলের কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করছি এবং ইশামের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছি।’ সংস্থাটি আরো জানায়, ইসরাইলের এ হামলায় রয়টার্সের অপর দুই সাংবাদিক আল-সুদানি ও মাহের নাজেহ আহত হয়েছেন। এখন তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। আলজাজিরা জানিয়েছে, শুক্রবার আহত সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন করতে ইসরাইল-লেবানন সীমান্তের আলমা আস-সাবে গিয়েছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, ইসরাইলি সেনাবাহিনী একটি ট্যাংক থেকে তাদের ওপর সরাসরি গোলা ছোড়ে। সেখানকার অবস্থা ভয়াবহ ছিল। আলজাজিরা আরো জানিয়েছে, হামলার শিকার সাংবাদিকরা সবাই ‘প্রেস’ লেখাসংবলিত নিরাপত্তা ভেস্ট পরে ছিলেন। তারা একটি খোলা স্থানে ছিলেন এবং জায়গাটি একটি পাহাড়ের উপরে ছিল। যারা সেখানে নজরদারি চালাচ্ছিল, লক্ষ রাখছিল তারা সবাই স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন, ওই দলটি সাংবাদিকদের দল ছিল। হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর এখন পর্যন্ত ১০ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে প্রেস গেজেট।

ওয়াদি থেকে পালাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা : ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফের আলটিমেটাম ঘোষণার পর গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চল ওয়াদি থেকে পালানো শুরু করেছেন ফিলিস্তিনিরা। শুক্রবার দিন শেষ হওয়ার আগেই ওয়াদি এলাকার চার লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে এলাকা ত্যাগ করেছেন। গতকাল শনিবারেও এই ধারা অব্যাহত রয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক অঙ্গ সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্স (ওচা)। ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট গাজা উপত্যকায় বসবাস করেন ২৩ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি। তাদের মধ্যে অন্তত ১১ লাখ, অর্থাৎ গাজা উপত্যকার মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই বসবাস করেন ওয়াদিতে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিমান হামলার পর এবার গাজায় স্থল অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইডিএফ। সেই অভিযানের অংশ হিসেবেই ওয়াদি থেকে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের সরে যেতে বলা হয়েছে। আইডিএফের সেই অভিযান এখনো শুরু হয়নি। কবে থেকে শুরু হবে, তাও এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ওয়াদির সীমান্ত এলাকায় বেশ কিছু ইসরাইলি ট্যাংক ও টহলরত সেনা সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

রোগী সরিয়ে নেয়া সম্ভব নয় : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, উত্তর গাজার হাসপাতাল থেকে হাজার হাজার গুরুতর রোগীকে সরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর গাজা ফাঁকা করার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি বলেছে, রোগীদের জীবন বিপন্ন করে স্থানান্তর সম্ভব নয়। শনিবার আলজাজিরা এ খবর জানিয়েছে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বলেছে, উত্তর গাজায় দু’টি হাসপাতাল আছে। যদি ইসরাইলি বাহিনীর দাবি অনুযায়ী রোগীদেরকে সরিয়ে নেয়া হয় তা হলে তারা জীবনের ঝুঁকিতে পড়বে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১১ লাখ ফিলিস্তিনিকে উত্তর গাজা ছাড়ার ইসরাইলি হুমকিকে প্রত্যাহার করতে হবে। সংস্থাটি আরো বলেছে, গণ উচ্ছেদ ভয়ঙ্কর হবে। এতে রোগী, স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্য বেসামরিক লোকজন সমস্যায় পড়বে।

ফিলিস্তিনিদের গাড়িবহরে হামলা : গাজায় বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের গাড়িবহরে বোমা ফেলেছে ইসরাইল। এতে অন্তত ৭০ জন নিহত এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য নিশ্চিত করে জানিয়েছে, নিহতদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, এ দিন গাজা ছেড়ে পালানোর সময় বেসামরিকদের একটি গাড়িবহরে বিমান হামলা চালায় ইসরাইল।
যুদ্ধবিরতির আহ্বান রাশিয়ার : গাজা উপত্যকা ও ইসরাইলে চলমান সঙ্ঘাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করার পাশাপাশি ‘মানবিক যুদ্ধবিরতির’ আহ্বান জানিয়েছে রাশিয়া। শুক্রবার জাতিসঙ্ঘে এ আহ্বান জানান রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থাপিত রাশিয়ার খসড়া প্রস্তাবে ‘অবিলম্বে’ যুদ্ধবিরতি শুরু এবং জিম্মিদের নিরাপদ মুক্তির আহ্বান জানানো হয়েছে। শুক্রবার নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর রুশ রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত, নিরাপত্তা পরিষদকে অবশ্যই একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রক্তপাত বন্ধ করতে এবং শান্তি আলোচনা আবার শুরু করতে হবে।’ এ ছাড়া গাজা উপত্যকায় বেসামরিক স্থাপনায় ইসরাইলি বিমান বাহিনীর হামলার বিষয়ে দৃষ্টি না দেয়ার জন্য ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেয়নেরও সমালোচনা করেন তিনি। ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে জাতিসঙ্ঘে নিরাপত্তা পরিষদ বরাবরই বিভক্ত। সভার শেষে সদস্যরা প্রস্তাবের বিষয়ে সতর্কতার সাথে প্রতিক্রিয়া জানান।

অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি চায় ইউনিসেফ : টানা ছয় দিন ধরে বোমাবর্ষণ ও বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকা গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘের শিশু নিরাপত্তা ও অধিকারবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। শনিবার এক লিখিত বিবৃতিতে ইউনিসেফের প্রধান নির্বাহী পরিচালক ক্যাথেরিন রাসেল বলেন, ‘এ মুহূর্তে গাজা উপত্যকায় কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। অনেক বেসামরিক মানুষ হাসপাতাল ও স্কুলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেক স্কুল বোমার আঘাতে ধ্বংসও হয়ে গেছে।’

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/784281