১৫ অক্টোবর ২০২৩, রবিবার, ১২:৫৯

তলে তলে আপস, সাথে নেই জনগণ

-মো: হারুন-অর-রশিদ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বেশি দিন বাকি নেই। নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারবে কিনা সেই সংশয় জনগণের চিন্তারেখা ভাঁজ তুলছে। দেশের জনগণ ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে কিন্তু বিগত দু’টি নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকারি দল বিগত ১৫ বছরে সব ধরনের নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে প্রায় এক তরফা নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে। জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার করছে, কাজেই তারা সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারে না।

আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সমস্ত পুলিশ প্রশাসন, সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্বাচনমুখী করে সাজাচ্ছে, অর্থাৎ আরেকটি ’১৪ কিংবা ’১৮-এর মতো নির্বাচন করার সব ব্যবস্থা সরকার করছে। সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে দমিয়ে রাখাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগসহ প্রায় সব ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে, যাতে করে তারা ভয়ের মধ্যে থাকে এবং সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করতে না পারে। সরকার মনে করছে, জনগণ ভোট দিতে পারলে তাদের শোচনীয় পরাজয় হতে পারে। তাদের এখন প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসঙ্ঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান।

ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের গুরুত্ব বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নেই এ কথা বলা যাবে না, তবে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে তারা জোর দিচ্ছে, এটি বলা যায়। আগামী নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয় সে কারণে তারা নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের জনগণের ওপর ভিসানীতি ঘোষণা ও তার কার্যক্রম শুরু করেছে। তাদের বক্তব্য স্পষ্ট, যে বা যারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ করা হবে। মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর সরকারদলীয় মন্ত্রী, এমপিরা কাষ্ঠ হাসি হেসে বলতে লাগলেন, এতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। ভিসানীতি বিএনপির লোকজনের ওপরই কার্যকর হবে। কারণ, তারা নির্বাচনের প্রতিবন্ধক। কিন্তু একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য যে সরকারি দল মূল প্রতিবন্ধক তা দেশের জনগণ, আন্তর্জাতিক মহল, রাজনৈতিক দলগুলো এমনকি যে দেশ ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তারাও জানে। এ ধরনের হাঁকডাক ডেকে যখন জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি তখন আবার কখনো প্রধানমন্ত্রীর জো বাইডেনের সাথে সেলফিবাজি, কখনো আবার ‘তলে তলে আপস হয়ে গেছে, আগামী নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে হবে ও যথাসময়ে হবে’-এ জাতীয় কথা বলে আবারো জনগণকে বিভ্রান্ত করতে গিয়ে ধরাশায়ী হয়েছে। জনগণকে ধোঁকা দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্ব যেমন প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন না হলে তাদের পরিণতি কেমন হবে সেই চিত্রও ফুুটে উঠেছে।

কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না যে, এই সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ছয় সদস্যের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল, নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে গত ৮ থেকে ২৩ জুলাই বাংলাদেশ সফর করে। প্রতিনিধি দলটি মূলত নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশনের কর্মপরিধি, পরিকল্পনা, বাজেট, লজিস্টিকস ও নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে মূল্যায়ন করে। প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলটি বাংলাদেশের সরকারের প্রতিনিধি, নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক নেতা, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করে যে সব তারা প্রতিবেদন তৈরি করেছে তার ওপর ভিত্তি করে ইইউ জানিয়েছে, আসন্ন নির্বাচনে তারা পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। কারণ, ‘নির্বাচন ঘিরে সঙ্ঘাত দেখছে তারা। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে যে, তাদের নির্বাচন মূল্যায়ন মিশন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য উপযোগী বলে মনে করছে না।

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) যৌথভাবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষা মিশন পরিচালনা করার জন্য সাত সদস্যের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এনেছেন। দলটি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, সরকারি সংস্থা, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, নারী সমাজ, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন সংস্থা এবং বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং ঢাকার বিদেশী মিশনের কূটনীতিকদের সাথে কথা বলছেন। সর্বোপরি বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের দিন আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক মিশন পাঠাবে কিনা, তা নির্ধারণ করা হবে এ প্রতিনিধিদলের সুপারিশের মাধ্যমে।
মার্কিন প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষা মিশনের সদস্যরা যাদের সাথেই কথা বলেছেন, সরকারি দল ব্যতীত প্রত্যেকেই এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে নেতিবাচক কথাই বলেছেন। এখন প্রশ্ন হলো- এই সরকারের ওপর যখন কেউ আস্থা রাখতে পারছে না, তখন এই সরকার সংবিধানের দোহাই দিয়ে কেন নিজেদের অধীনে নির্বাচন করার পাঁয়তারা করছে? তাদের এই পাঁয়তারার অর্থই হলো- তারা আরেকটি ’১৪ কিংবা ’১৮-এর মতো নির্বাচন করার জন্য মরিয়া।

এই সরকার কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে কিন্তু বিগত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে তারা নিজেদের মতো করে সংবিধানের যে সংশোধন করেছে, দেশের বেশির ভাগ মানুষ সেই সংশোধিত সংবিধানের সাথে একমত নয়। এ ছাড়াও বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও সরকারের চাহিদার সাথেই তাল মিলিয়ে চলছে। যেমন ইতোমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ১ শতাংশ ভোট কাস্ট হলেও আইনত বৈধ নির্বাচন হবে। তারা ধরেই নিয়েছে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও ভোট যেটাই পড়–ক নির্বাচনকে ‘জায়েজ’ করতে হবে যার কারণে আগে থেকেই এমন বক্তব্য দিয়ে রাখছে। সিইসির এমন বক্তব্যে প্রমাণিত হয়, খোদ নির্বাচন কমিশনও আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক তা মনে চায় না। অর্থাৎ সরকারের ইচ্ছাই তাদের ইচ্ছা।

সবচেয়ে প্রহসনের বিষয় হলো- সরকারি দল বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলে, তারা নাকি বিদেশীদের ঘাড়ে ভর করে ক্ষমতায় আসতে চায়। কিন্তু দেশের জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে, আওয়ামী লীগ ভারতের ওপর ভর করে আরেকটি ’১৪ কিংবা ’১৮ ঘটানোর সব রকম চেষ্টা তদবির করে চলেছে। কখনো স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দেয়া হচ্ছে, কখনো রাখঢাক না করেই বলেছে, তাদের আরেক টার্ম ক্ষমতায় রাখার জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। আবার প্রধানমন্ত্রীর সাথে জ্যাক সুলিভ্যানের সাথে বৈঠককালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক জনসমাবেশে বলেছেন, ‘কোথায় স্যাংশন? কোথায় ভিসানীতি? তলে তলে আপস হয়ে গেছে। চিন্তার কিছু নেই।’ তিনি যেহেতু ‘স্যাংশন’ ও ‘ভিসানীতি’ শব্দগুলো বলেছেন, আমরা ধরে নিতে পারি যে, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গোপন আলোচনার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, ‘দিল্লি আছে, আমেরিকারও দিল্লিকে দরকার। দিল্লি আছে, আমরা আছি।’ এর অর্থ হলো- নিশ্চিতভাবেই এই গোপন চুক্তি সংশ্লিষ্ট আরেকটি পক্ষ ভারত। অর্থাৎ, ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সাথে একটি গোপন চুক্তি হয়েছে, যার ফলে আওয়ামী লীগের ‘চিন্তার কোনো কারণ নেই’।

আজকে জনগণের মনে প্রশ্ন জেগেছে, এভাবেই কি বাংলাদেশে গণতন্ত্র কাজ করছে? এভাবেই কি আমরা আমাদের নাগরিক সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিতে থাকব? অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের সময় জনগণের একক সার্বভৌমত্ব হলো, ভোট দিয়ে তাদের পছন্দসই সরকার নির্বাচন করা। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ ১৫ বছরে সেই সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলেছে বহির্শক্তির সাথে আওয়ামী লীগের তলে তলে আপসের কারণে।
harun_980@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/784170