১৪ অক্টোবর ২০২৩, শনিবার, ১১:২২

অপরাধ, অপরাধপ্রবণতা ও নৃশংসতা

-ইবনে নূরুল হুদা

‘অপরাধ’ মানবসভ্যতার অবদান। কারণ, যখন সভ্যতা বিকশিত হয়নি, তখন মানুষের কোন কাজকেই অপরাধ বলে বিবেচনা করা হতো না। ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতিতেই চলতো সবকিছু। কিন্তু সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথেই মানুষের সকল কাজকেই শ্রেণি বিন্যাস করা হয়েছে। চিহ্নিত করা হয়েছে অপরাধ প্রবণতাকে। আর তা প্রতিবিধানের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে নানাবিধ কার্যক্রম। যা সভ্যতাকে পরিশীলিত করেছে।

বস্তুত, অপরাধ (Crime, Misdemeanor, Felony) হচ্ছে কোন ব্যক্তি কর্তৃক আইনবিরুদ্ধ কাজ। দেশ বা অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রণীত আইনের পরিপন্থী কার্যকলাপই অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। সাধারণ ধারণা অনুযায়ি কোন ব্যক্তি, অন্য কোন ব্যক্তি বা সমাজের সমস্যা সৃষ্টিকল্পে যে সকল কাজ করে তাই অপরাধ। অপরাধ হিসেবে কোন ব্যক্তিকে খুন, জখম, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাসী কর্মকা-, ধর্ষণ, জালিয়াতি, অর্থপাচার ইত্যাদি রয়েছে যা পৃথিবীর সকল সভ্য দেশেই স্বীকৃত থাকায় দ-নীয়।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। কারণ, সব জীবের মধ্যে একমাত্র মানুষেরই রয়েছে ‘বিবেক’। অথচ সেই মানুষই আজ হয়ে উঠেছে সবচেয়ে অপরাধ প্রবণ, হিংগ্র ও ভয়ংকর। তুচ্ছ কারণে অসহিষ্ণু, মানুষ হত্যা, খুন, পুড়িয়ে মারাসহ নানা নৃশংস পন্থার আশ্রয় নিচ্ছে নির্দ্বিধায়। প্রতিদিন চারদিকে এত নৃশংস ঘটনা ঘটছে যে ‘মনুষ্যত্বের’ অস্তত্ব আদৌ আছে কি না সন্দেহ হয়! যা আমাদের সমাজের নিত্যদিনের বাস্তবচিত্র।

আপাতদৃষ্টিতে মানুষের এই অপরাধ প্রবণতা ও নৃশংসতা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে বলে মনে হলেও এটি আসলে হয়েছে ধীরে ধীরে। সমাজ পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় দ্রুত নগরায়ণ এবং যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে ক্রমেই একক পরিবারের (নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি) বিকাশ ঘটছে। শহরে বাবা-মা দু’জনই ব্যস্ত থাকেন তাঁদের ক্যারিয়ার নিয়ে। একক পরিবারের সন্তানেরা বড় হচ্ছে একা একা অথবা গৃহপরিচারিকার কাছে। ফলে সন্তানেরা মা-বাবা বা অন্য আত্মীয়দের কাছ থেকে পর্যাপ্ত গুণগত সময় ও সুযোগ পাচ্ছে না; যা তাদের ‘নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন একজন মানবিক মানুষ’ হতে সাহায্য করে। কিন্তু আমাদের দুর্বলতা খুবই স্পষ্ট।

দেশে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি, আইনের অপপ্রয়োগ, জবাবদিহীতার অভাব, মাত্রারিক্তিক অবক্ষয়, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই দেশে অপরাধ প্রবণতা এখন সকল সময়ের সীমা অতিক্রম করেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতাও এজন্য কম দায়ি নয়। ফলে দেশ এখন অপরাধ ও অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সাথে সাথে বেড়েছে নৃশংসতাও। এমনকি অবস্থা এখন বেশ প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিস্তৃতি ঘটেছে ঘরে-বাইরে সর্বত্রই। প্রতিপক্ষ কিংবা স্বজন; কেউই এই নৃশংসতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ফলে সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক অস্থিরতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সনাতন সমাজ ব্যবস্থা থেকে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অসমতা, দ্বন্দ্ব, লোভ ও হতাশা থেকেই মানুষ দিন দিন নৃশংস ও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠছে। যার সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নয়নের বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার এ ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ভিডিওচিত্র ও নৃশংসতার খবর পড়েও অনেকে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু রাষ্ট্র এসবের প্রতিকারে খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারছে না। ফলে সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দেশে অপরাধ, অপরাধ প্রবণতা ও নৃশংসতা ইতোমধ্যেই লাগামহীন হয়ে উঠেছে। কোন ভাবেই এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না বা লাগাম টানার চেষ্টাও করা হচ্ছে না। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর সে চিত্র নতুন করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে নির্যাতন ও হাতের কব্জি এবং পায়ের গোড়ালি কেটে ভিডিও ধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের নৃশংসতার জানান দিয়ে উল্লাস করতো রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একদল সন্ত্রাসী। গত মাসের শুরুতে এমন কয়েকজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। র‌্যাবের হাতে আটক সন্ত্রাসী রাফাত কারও হাতের কাটা কব্জি হাতে নিয়ে ভিডিওতে সেটার বর্ণনা দিতো বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। রাফাতসহ সাত জনকে আটকের পর গত ৯ সেপ্টেম্বর তাদের নৃশংসতার বর্ণনা দেন তিনি। যা রীতিমত আতৎকে ওঠার মত।

জানা গেছে, গত ৬ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরে মাত্র ১১ বছর বয়সী আকাশ নামের এক শিশুকে চুরির অভিযোগ এনে বাঁশের মধ্যে ঝুলিয়ে লাঠি, লোহার রড ও ক্রিকেট খেলার ব্যাট দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। শিশুটিকে নির্যাতনের ভিডিও করেও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। শিশু আকাশ স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু দুর্বৃত্তরা এই অবুঝ শিশুর ওপর নৃশংসতা চালাতে কসুর করেনি। যা আমাদের দেশের লাগামহীন অপরাধ প্রবণতা ও বর্বরতার কথায় স্মরণ করিয়ে দেয়।

এখানেই শেষ নয়। সম্পত্তির বিরোধে চট্টগ্রামের হালিশহরে বৃদ্ধ মো. হাসানকে হত্যা করেছে স্ত্রী ও দুই ছেলে। হত্যার পর বৃদ্ধের লাশ ১০ টুকরো করে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গুম করার চেষ্টা করে তারা। গ্রেফতারের পর নিহতের স্ত্রী, বড় ছেলে ও পুত্রবধূ জবানিতে উঠে এসেছে হত্যাকা-ের নৃশংসতার ভয়াবহ চিত্র। লাশের টুকরাগুলো কয়েকটি লাগেজ ও ব্যাগে ভর্তি করে তারা। খ-িত লাশের টুকরোগুলো পাশে রেখেই একত্রে খাওয়া-দাওয়া করেছে। তারপর সবাই মিলে লাশ গুমের জন্য বিভিন্ন স্থানে ফেলে এসেছে। যা অতীতের সকল নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতাকে হার মানায়।

এমনকি থেমে নেই পারিবারিক সহিংসতাও। মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয়ের কারণেই পরিবারিক জীবনে এমন অস্থিরতা নেমে এসেছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সবশেষ তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৯১ জন নারী। এরমধ্যে ২৩৫ জনকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৯৪ জন নারী। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬২ জন। যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার ১১৪ নারী। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে এবং যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ছয় জন। এরমধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫৭ জন। যদিও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। পরিবারের বাইরে প্রতিবেশী, পরিচিত-অপরিচিতজনদের হাতেও নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন অনেক নারী। বিগত নয় মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৬৭ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩২ নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন তিন জন। এছাড়া ১০৫ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। যা আমাদের লাগামহীন অপরাধ প্রবণতার কথায় স্মরণ করে দেয়।

নৃশংসতার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিগত নয় মাসে ১ হাজার ১৫৭ শিশু নানাভাবে নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এরমধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ৩১৭ শিশু। ধর্ষণের শিকার ৪৩ ছেলে শিশু। দুই ছেলে শিশুকে বলৎকারের পর হত্যা করা হয়েছে। একজন ছেলে শিশু বলৎকারের ভিকটিম হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছে। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ছয় শিশুকে। এছাড়া আত্মহত্যা করেছে ৬৪ শিশু। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে ১১৮ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রহস্যজনক মৃত্যুও হয়েছে পাঁচ শিশুর। এছাড়া অপহরণের পর হত্যা করা হয় ১৫ শিশুকে।

আগের বছর ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৭৯ জন নারী। একই সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৩৬ জন। এছাড়া নির্যাতনের কারণে ৫১৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলেও তথ্য দেয় সংস্থাটি। নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন কথায় বলছেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞা বলছেন, ‘সভ্যতা একদিকে যেমন আমাদের ভালো কাজের উদাহরণ দিচ্ছে, ঠিক তেমনি আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, লোভ, ধর্ষণ, ড্রাগ বেড়ে যাওয়া, সামাজিক অসমতা, অস্ত্রের ব্যবহার এর বিপরীত চিত্র। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, উন্নত বিশ্বেও এটি মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০-২৫ বছর আগে রিলেটিভলি দ্বন্দ্বের উৎস কম ছিল। সমস্যা হলে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করে নিতো। সভ্যতার বিকাশে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন যখন হয়েছে, তখনই মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এরমধ্যে সম্পত্তি একটা বড় কারণ হয়ে উঠছে। আগের তুলনায় জমির মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। ফলে পরিবারের মধ্যেই পিতা, মাতা, ভাই-বোন একে অপরের সঙ্গে বিরোধ বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। জমির জন্য মাকে-বাবাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। ভাই ভাইকে ও বোনকে হত্যা করছে। যা আমাদের মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতার প্রমাণ।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হঠাৎ করে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে বড় হওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। অর্থের মোহে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়েছে। একইসঙ্গে টেকনোলজির মাত্রাতিরিক্ত অপব্যবহারের কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। এতে দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি কালচারাল অ্যাক্টিভিটিজ, ধর্মীয় শিক্ষা, সবকিছু করার ফলে একসময় মনের হিংগ্রতা দমিয়ে রাখার সুযোগ ছিল। লোভ-লালসাও এত বেশি ছিল না। জমি জমার দাম এত বেশি ছিল না। কিন্তু আগের সে অবস্থা আর অবশিষ্ট নেই।

মূলত, নানা কারণে মানুষের মূল্যবোধ ও মানবিক গুণাবলি লোপ পেতে শুরু করেছে। এই প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে বৈ কমছে না। যতই আধুনিক সমাজের দিকে আগ্রসর হচ্ছি, ততই তা প্রকট আকার ধারণ করছে। সিরিয়াল কিলিং বা সিরিয়াল কিলার তো শুধু আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। সেটা হয়েছে উন্নত দেশেও। যত বেশি আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার দিকে অগ্রসরতা বাড়ছে, তত বেশি সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার বা মানসিক অস্থিরতাও আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ড্রাগ, গ্যাং কালচার আধুনিকায়ণেরই বাই প্রডাক্ট। ফলে বিভৎস কার্যকলাপও আগর তুলনায় বেড়ে গেছে।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও মা তার সন্তানকে হত্যা করতে পারেন না। কোনও কারণে যখন মায়ের মাতৃত্বটা ক্ষয়ে যায়, যখন সে ভোগবাদী নারীতে পরিণত হয়, বা ইনসাইড লস্ট বা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য একটা নারীতে পরিণত হয়। তখনই একজন নারী সন্তানকে হত্যা করতে পারে। যেমন আমরা বিভিন্ন সময় দেখি, সন্তান বাবাকে হত্যার ঘটনা ঘটনা ঘটাচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তা বাবাকে খুন করা মেয়ে ঐশীর ঘটনাও কারো অজানা নয়। পরিবার কিংবা স্বজনদের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা কী কী কারণে ঘটতে পারে- যেমন বাবা বিয়ে করতে চাইছে একজন টিএনএজ মেয়েকে। সম্পত্তি অন্য কাউকে দিয়ে দিতে চাইছে। তখন তাকে তার সন্তান কিংবা আপনজনরা নৃশংসভাবে খুন করছে। সম্পত্তি আর বিয়ে-সাদী এখন কমন বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন নৃশংসতাটা কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘যখন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, তখন চিন্তা করে লাশ কী করবে? হত্যার আলামত ধ্বংসের জন্য গুম করা হচ্ছে। এই গুম করার পরিকল্পনার মধ্যেই হিংগ্রতার বিষয়টি স্পষ্ট। পৃথিবীর যেকোনও খুনেই খুনি লাশ গুম করার চেষ্টা করে। এমনভাবে সরানোর চেষ্টা করে, যেনও কেউ বুঝতে না পারে। সেখানে নৃশংসতা আসতে পারে। একটা অপরাধ আরেকটা অপরাধকে উস্কে দেয়। একটা অপরাধ করে ফেলেছে, তখন এটা থেকে বাঁচার জন্য আরও অপরাধ করতে থাকে অপরাধ প্রবণরা। তখন চক্রবৃদ্ধি হারে অপরাধ ঘটে।’

কেউ কেউ এজন্য সোসাল মিডিয়াকে দায়ি করে থাকেন। কিন্তু এমন অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয়। সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মিডিয়াতে যে হিংগ্রতার চিত্র দেখানো হয়, এভাবে খুন হতে পারে, ওভাবে গুম করা যেতে পারে। সেটাও অবশ্যই কুশিক্ষা। তবে সোশ্যাল মিডিয়াতে তো ভালো কিছুরও উপস্থিতি আছে। কিন্তু এসব ইতিবাচক দিক থেকে শিক্ষা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে দেশের অপরাধ প্রবণতা ও নৃশংসতা এখন প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ‘যেখানে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা থাকে না, সেখানে সমাজ-পরিবার সকল ক্ষেত্রেই হতাশা দানা বাঁধে। সবার মনেই অস্থিরতা দেখা দেয়। সেই হতাশা আর অস্থিরতা থেকেই সমাজ ও পরিবারে সহিংসতা ও নৃশংসতা ছড়িয়ে পড়ে।’

মূলত, আইনের শাসনের বিচ্যুতি, সুশাসনের ব্যত্যয়, মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয়, মূল্যবোধের বিচ্যুতি, ধর্মীয় আদর্শের প্রতি অনিহা, জবাবদিহীতার অভাব, বিচারহীনতা ও লাগামহীন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই আমাদের অপরাধ ও অপরাধ প্রবণতা এখন সকল সময়ের সীমা অতিক্রম করেছে। কোন ভাবেই এসব অপরাধের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। একই সাথে নৃশংসতাও একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে এসেছে ঠেকেছে। যা আমাদের রাষ্টীয় ও সামাজিক পরিবেশ অশান্ত ও অস্থির করে তুলেছে। যা আমাদের জাতিস্বত্ত্বার ভিত্তিমূলকেই দুর্বল করে দিয়েছে।

এমতবস্থায় দেশ ও এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে হলে সবার আগে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। বেড়িয়ে আসতে হবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে। সকল থেকে জবাবদিহীতা ও মূল্যবোধের চর্চা নিশ্চিত হওয়া দরকার। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের একটা যৌক্তিক সমাধান হওয়ার দরকার। অন্যথায় আগামী দিনে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

https://www.dailysangram.info/post/537968