১৩ অক্টোবর ২০২৩, শুক্রবার, ২:৫৬

উৎপাদন বাড়লেও কমছে না দাম

দেশে গত পাঁচ অর্থবছরে চাহিদার তুলনায় ডিমের উৎপাদন বেশি হওয়ার পরও বর্তমানে দাম বাড়তি। খুচরা বাজারে প্রতি ডজন ডিম ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। গত বছর এই সময় প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল ১৪৫ টাকা।

১৪ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো প্রতিটি ফার্মের মুরগির ডিমের খুচরা দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়।
সেই হিসাবে ডজনে দাম দাঁড়ায় ১৪৪ টাকা। ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজারে সরকারি সংস্থা অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করছে। তবু এক মাসেও নির্ধারিত দাম কার্যকর হয়নি। উল্টো ডিমের দাম বেড়েছে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিমের দাম হুট করে বাড়ার পেছনে অন্যতম দুটি কারণ হলো মুরগির খাদ্য ও বাচ্চা মুরগির দাম বাড়া এবং ব্যবসায়ীদের কারসাজি। তাঁরা বলছেন, আগে সরকারকে কম দামে মুরগির খাদ্য ও বাচ্চা মুরগি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এতে ডিমের দাম কিছুটা কমতে পারে।

টানা পাঁচ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
এর পরও ডিমের বাজারে অস্থিরতা চলছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ডিমের চাহিদা ছিল এক হাজার ৮০৬ কোটি পিস। ওই অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন দুই হাজার ৩৩৮ কোটি পিস। চাহিদার তুলনায় ডিমের উৎপাদন বেশি হওয়া সত্ত্বেও দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন ছিল এক হাজার ৭১১ কোটি পিস, যা বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে হয় দুই হাজার ৩৩৮ কোটি পিস।

পাঁচ অর্থবছরে ৬২৭ কোটি পিস ডিম বেশি উৎপন্ন হয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে বর্তমানে ডিমের বাজার ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৬০ লাখের বেশি মানুষ যুক্ত। ছোট-বড় মিলিয়ে বিনিয়োগ আছে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশের মানুষের আমিষের চাহিদার ৬০ শতাংশ আসে মুরগি ও ডিম থেকে।

এমন পরিস্থিতিতে আজ ১৩ অক্টোবর দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডিম দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘ডিমে পুষ্টি ডিমে শক্তি, ডিমে আছে রোগমুক্তি’। প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার বিশ্বজুড়ে ডিম দিবস পালিত হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও দিবসটি যৌথভাবে পালন করছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল এবং ওয়ার্ল্ডস পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের বাংলাদেশ শাখা। দিবসটি উপলক্ষে সেমিনার, ডিমের পুষ্টিগুণবিষয়ক জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে।

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য বলছে, ২০১৩ সালে বাজারে ফার্মের মুরগির ডিমের হালি ছিল ৩৪ টাকা। বর্তমানে তা ৫৫ টাকা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে ডিমের মতো আমিষের দাম বাড়ার জন্য বিশ্ববাজারে কাঁচামাল ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি দায়ী। তবে দাম কতটুকু বাড়ছে বা যৌক্তিক হারে সমন্বয় হচ্ছে কি না, তা-ও দেখার বিষয়।

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশনর অব বাংলাদশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডিমের দাম বাড়ার কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। সরকার ডিমের দর বেঁধে দিয়েছে, এর পরও অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম না কমিয়ে উল্টো বাড়াচ্ছেন। পরিকল্পিত বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা না গেলে ধরেবেঁধে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।’

তিনি বলেন, ‘ডিমের দাম হুট করে বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে দুটি কারণ হলো খাদ্য ও বাচ্চা মুরগির দাম বৃদ্ধি এবং সিন্ডিকেট। আগে সরকারকে কম দামে মুরগির খাদ্য ও বাচ্চা মুরগির দাম নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ডিমের দাম কিছুটা কমানো যেতে পারে। পরে সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। যারা ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের সিন্ডিকেটকে ভাঙতে হবে। তাহলে ডিমের বাজার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।’

অস্থিরতা কাটছে না
নানা অজুহাতে আমিষজাতীয় পণ্যটির দাম গত কয়েক দিনের ব্যবধানে আরো এক দফা বেড়েছে। রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোতে ফার্মের মুরগির ডিম প্রতি ডজনে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে বাজারে ডিম সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় নতুন করে দাম বেড়েছে।

রাজধানীর বাড্ডার কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী ফিরোজ গাজী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টানা কয়েক দিনের বৃষ্টির পর থেকে পাইকারিতে ডিমের দাম বাড়তি। এখন আমাদের প্রতি হালি ডিম কিনতেই সব মিলিয়ে খরচ হচ্ছে ৫২ টাকা, বিক্রি করছি ৫৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেও প্রতি হালি ডিম বিক্রি করেছি ৫০ টাকায়।’

ডিম ও মুরগি উৎপাদনকারী প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘উৎপাদন খরচের সঙ্গে ডিম ও মুরগির দাম যৌক্তিক হারে সমন্বয় হতে হবে। তাহলে খামারিরা উৎপাদন বন্ধ করবেন না। বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। কোনো চক্র যাতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে না পারে, সরকারকে তা দেখার উদ্যোগ নিতে হবে।’

১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি, আসেনি একটিও
দীর্ঘদিন ধরে চলা ডিমের বাজারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার তিন দফায় ভারত থেকে ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি ডিমও আমদানি করা হয়নি। তবে শিগগিরই আমদানি করা না হলে দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা করছেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

আমদানির অনুমতি পাওয়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৩৩ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে প্রতিটি ডিমের আমদানি খরচ ১০ টাকার বেশি পড়বে। শুল্ক কমালে ব্যবসায়ীরা দ্রুত আমদানি করবেন।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তাদের সীমিত লোকবল নিয়ে ডিমের বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আমাদের জেলা কার্যালয়গুলোতে লোকবল কম। আমি চাহিদা দিয়েছি ৪৫০ জন জনবলের। কিন্তু সেখান থেকে অনুমোদন মিলেছে মাত্র ১২ জনের। তবু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তাদের সাধ্য অনুযায়ী কাজ করে চলছে। এই জনবল নিয়ে আমাদের তো সব সময় ছোটা সম্ভব নয়। তবে সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রয়োজন সবার সম্মিলিত উদ্যোগ। এখানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর একা কিছু করতে পারবে না। মাঠে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকেও নামতে হবে।’

https://www.kalerkantho.com/online/national/2023/10/13/1326476