১৩ অক্টোবর ২০২৩, শুক্রবার, ২:৪৩

ঢাকায় মার্কিন নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশে কি গণতন্ত্র ফিরবে?

বাংলাদেশে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততোই মার্কিন চাপ বাড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রণমূলক নির্বাচনের জন্য তৎপরতা দেখাচ্ছে। এরইমধ্যে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রণমূলক নির্বাচনের পথে যারা বাধা তাদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। মার্কিন পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানোর বিষয়টি মূল্যায়ন করতে গত শনিবার ঢাকায় আসে ৭ সদস্যের মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। ’৯০-এর দশকে পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার আগে এ ধরনের মার্কিন পর্যবেক্ষক টিমগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা গিয়েছিল এবং ঐসব দেশে মার্কিন তৎপরতায় গণতন্ত্র ফিরেছিল। এদিকে আজ শুক্রবার আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় পরিদর্শনে যাবেন বাংলাদেশ সফররত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিদিদলের সদস্যরা। আওয়ামী লীগের উপদফতর সম্পাদক সায়েম খান গতকাল বৃহস্পতিবার এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশে সফর করে। এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন জাতীয় নির্বাচনে তাদের পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানায়। যুক্তরাষ্ট্র কী করবে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। আর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির গণমাধ্যমকে বলেন, ইইউ-এর পর যুক্তরাষ্ট্রও একই সিদ্ধান্ত নিলে সেটা বাংলাদেশের জন্য দুঃখজনক হবে। এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে ‘যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোনো দেশেই সফল হয়নি বলে’ মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। ঢাকা সফররত মার্কিন প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মারিয়া চিন বিনতে আব্দুল্লাহ। তার সঙ্গে রয়েছেন মারিও মাইত্রি, জেমি ক্যানডেন্স সাক্স স্পাইকারম্যান, আকাশ সিসাসাই ।

এদিকে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এক বিবৃতিতে বলেন, নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) যৌথভাবে প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষা মিশন পরিচালনা করছে। এনডিআই এবং আইআরআই হল নির্দলীয় বেসরকারি সংস্থা, যা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের অনুশীলনকে সমর্থন ও শক্তিশালী করতে কাজ করে। সংস্থা দুটি সম্মিলিতভাবে গত ৩০ বছরে ৫০টিরও বেশি দেশে ২০০টিরও বেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, নির্বাচন কমিশন ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে বৈঠক করেছে। নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এমন কয়েকজন জানিয়েছেন ঢাকা সফররত মার্কিন এই দলটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে ঢাকায় এসেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক ফান্ড (জনগণের করের টাকা) ব্যয় করে কোনো টিমকে নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে পাঠানোর মানেই হলো এটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সে দেশের সরকার। এখন ঢাকা সফররত দলটি মূলত খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ যে অচলাবস্থা তার কারণ ও গভীরতা কতটা।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির গণমাধ্যমকে আরও বলেন, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে অনেক দিন ধরেই কাজ করছে। তারা বাংলাদেশে ১৯৯৬, ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় কাজ করেছে। তারা অনেক দিন ধরেই কাজ করছে এবং তাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে।

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ কতখানি আছে সেটাই তারা এসেস করার চেষ্টা করছে। গত বেশ কিছুদিন ধরেই তারা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কাজ করছে। শেষ দুটি নির্বাচন তারা পর্যবেক্ষণ করেনি। এবার করবে কিনা বা মার্কিন সরকার নির্বাচনকে এনডোর্স করবে কিনা- সেটি নির্ভর করবে এ টিমের সুপারিশের ভিত্তিতেই।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গণমাধ্যমকে আরও বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ তারা একইভাবে কাজ করে। তারপরও তারা প্রাক-পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছে তাদের মতো করে সার্বিক পরিস্থিতি অনুসন্ধান করতে। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় আমরা যখন নির্বাচন কমিশনে ছিলাম তখন ইইউ, যুক্তরাষ্ট্রসহ সব আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরাই এসেছিলেন। সেই সময়ের সঙ্গে এখনকার নির্বাচনি পরিবেশের তুলনা চলে না। আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

এর বাইরেও বিশ্লেষকরা যেসব মার্কিন এ দলটির ঢাকা সফরকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। তাদের মতে, গত প্রায় দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র নিয়ে দুটো সম্মেলনের আয়োজন করেছে কিন্তু বাংলাদেশকে তাতে আমন্ত্রণ করা হয়নি। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের ভিসানীতি ‘বিশেষ কোনো পেশা ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নয় ‘সবার জন্য প্রযোজ্য। যারাই নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করবে তার যে কারও ওপর আরোপ করা হতে পারে’।

এর বাইরে ঢাকায় ইউরোপীয় কূটনীতিকদের সাথে নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস পরিষ্কার করে বলেছেন যে, তারা বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। সবকিছু মিলে বাংলাদেশের প্রাক-নির্বাচনী পরিবেশ অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের উপযোগী কিনা সেটাই উঠে আসবে তাদের প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হয়-মার্কিন এই মিশনটি প্রথমে বৈঠক করেন ক্ষমতায় থাকা দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। বৈঠকের পর দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে বিরোধী বিএনপি যে দাবি করছে সেটিকে তারা সংবিধানসম্মত মনে করেন না। মার্কিন দলটি নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা ও আপসের কোনো উপায় আছে কিনা জানতে চেয়েছিল জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সমঝোতার পথ বিএনপিই বন্ধ করে দিয়েছে। আর সংবিধান লঙ্ঘন করে কোনো সমঝোতায় আওয়ামী লীগ আগ্রহী নয়। বৈঠকের পর দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেছেন, তারা নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে তাদের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন।

এ ছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধাগুলো কী কী হতে পারে এমন প্রশ্নও মার্কিন দলটি জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে করেছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ ও তপশিলের সময়সীমাসহ পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কেই জানতে চেয়েছিল মার্কিন দলটি। পরে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি ও নির্বাচনী বিধিবিধান সম্পর্কে মার্কিন প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলটিকে বিস্তারিত জানিয়েছেন তারা।

আউয়াল আরও বলেন, ওরা নির্বাচন কমিশন ও সরকারের ভূমিকা, দায়িত্ব এবং কার্যক্রমসহ অনেক কিছু জানতে চেয়েছে। আমরা সবকিছু তাদের সামনে তুলে ধরেছি। তারা যা যা জানতে চেয়েছিল, আমরা জানিয়েছি। এখন তারা কী করবে, তা আমরা জানি না। হয়তো তারা দেশে ফিরে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে- নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে কী পাঠাবে না। অথবা পাঠালে কীভাবে পাঠাবে। এর বাইরে সিভিল সোসাইটি, নারী প্রতিনিধি, গণমাধ্যম প্রতিনিধিসহ অন্যদের সঙ্গে আলোচনার সময় মূলত নির্বাচনে সহিংসতার সম্ভাবনা কতটা, সবার জন্য সঠিক পরিবেশ আছে কিনা- মূলত এগুলোই ছিল মার্কিন দলটির মূল জিজ্ঞাসা।

যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট পার্টির থিংক ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত আইআরআই আর এনডিআই’র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত মার্কিন নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সমন্বয়ে গঠিত মার্কিন নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল বুধবার ঢাকায় সচিবালয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, মার্কিন দল তার কাছে কিছু বিষয় জানতে চেয়েছে যে- সরকার ঠিকমতো নির্বাচন করতে পারবে কিনা ও সেই সক্ষমতা আছে কিনা। আর বিরোধী দল নির্বাচনে আসলে ঠিকমতো প্রচারের সুযোগ পাবে কিনা। তারা জানতে চেয়েছে- প্রার্থীরা নিরাপত্তাহীন বোধ করলে কিংবা কোনো দল যদি মনে করে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হবে তখন সরকার কি করবে? জবাবে আমরা বলেছি, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা আগে হতো, এখন আর এগুলো হয় না।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বর্তমান সরকার অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি মার্কিন প্রতিনিধিদলের সাথে। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা আইনের কি পার্থক্য আছে তা জানতে চায় প্রতিনিধি দল। নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হবে, এজন্য যা যা করার দরকার সরকার সেটা করছে বলে প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করার কথাও জানিয়েছেন তিনি। তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হবে কিনা, এ বিষয়ে মার্কিন প্রতিনিধি দল কিছু জিজ্ঞেস করেনি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। কারো নির্বাচনে আসা না আসা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পূর্ব-পরিস্থিতি যাচাই করতে মার্কিন এই দলটি ঢাকায় এসেছে গত ৭ অক্টোবর। এ দলটি ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করার কথা রয়েছে। সফরের শেষ দিন সংবাদ সম্মেলন বা একটি লিখিত বিবৃতি দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

https://www.dailysangram.info/post/537938