১২ অক্টোবর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৬:২৪

রাষ্ট্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রচিন্তা : বাংলাদেশ বাস্তবতা

ড. আবদুল লতিফ মাসুম

রাষ্ট্র শব্দটি ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে ‘স্টেটো’ শব্দ থেকে উৎপন্ন হয়। পরবর্তীকালে ‘স্টেটো’ শব্দটি ইংরেজিতে ‘স্টেট’ হয়ে দাঁড়ায়। ম্যাকিয়াভেলি তার ‘দ্য প্রিন্স’ (১৫১৩) গ্রন্থে ‘বডি-পলিটিক’ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সংগঠন অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেন। রাষ্ট্র শব্দটির সমার্থক সমাজ, জাতি, সরকার এমনকি অঙ্গরাজ্যকেও অনেক ক্ষেত্রে স্টেট বলা হয়। এরিস্টটল স্টেট শব্দটির পরিবর্তে পলিটি ব্যবহার করেন, যা আজকের রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছাকাছি। হেগেলের মতো ভাববাদী দার্শনিক রাষ্ট্রের পরিপূর্তির তত্ত্ব তুলে ধরেন। এদের মতে, একমাত্র রাষ্ট্রের মাধ্যমেই ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশ ও নৈতিক আত্মোপলব্ধি সম্ভব।

নিঃসন্দেহে রাষ্ট্র হলো উন্নত নৈতিক শক্তির আধার। রাষ্ট্রের আর্থিক, সামাজিক কার্যক্রম সম্পর্কের ভিত্তিতেও রাষ্ট্রকে বিশ্লেষণ করা হয়। এই মার্কসীয় দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের বিবর্তনে নিরন্তর শ্রেণিসংগ্রাম প্রত্যক্ষ করা হয়। অবশেষে রাষ্ট্রের বিলুপ্তি প্রত্যাশিত হয়ে দাঁড়ায়। লাস্কি, ওপেনহাইম ও গার্নার রাষ্ট্রকে বাস্তবতার নিরিখে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। তাদের দৃষ্টিতে সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমাজ, সরকার ও সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের উপাদান। সভ্যতার ক্রমবিকাশের এই অধ্যায় বৈশি^ক বাস্তবতা বা গ্লোবালাইজেশনের কারণে রাষ্ট্র গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। তাই যখনই আমরা রাষ্ট্রের কথা বলব, তখনই বাস্তব বৈশি^ক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় আনতে হবে।

রাষ্ট্র থেকে উদ্ভূত বিদ্যা রাষ্ট্রবিজ্ঞান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নানা নাম-ধাম আছে। কোথাও এটি সরকার ও রাজনীতি, কোথাও রাজনীতিবিজ্ঞান আবার কোথাও বা গভর্নেন্স স্টাডিজ বা শাসনসংক্রান্ত বিদ্যা। আসলে সবই রাষ্ট্রবিজ্ঞান। রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেহেতু সমাজবদ্ধ মানুষের আচরণ, সামাজিক সম্পর্ক ও রাষ্ট্রের সমস্যাকে গাণিতিক সূত্রে ব্যবহার করে, সে পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিদ্যা বিজ্ঞান পদবাচ্য। প্রকৃতিবিজ্ঞানের সাথে সমাজের সম্পর্ক সূত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে প্রকৃতিবিজ্ঞানের সম্পর্ক অস্বীকার করা যায় না। তবে সামাজিকবিজ্ঞানের একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ হওয়ার কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে সামাজিকবিজ্ঞানের সম্পর্ক অবিভেজ্য। রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক সমস্যা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অব্যাহত অনুশীলন। সুতরাং রাষ্ট্র যতদিন অর্থাৎ অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যয়ন, অনুশীলন ও অনুশাসন অব্যাহত থাকবে।

তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানেই রাষ্ট্রচিন্তা সীমিত নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বাইরে রাষ্ট্রসম্পর্কিত যে চর্চা ও গবেষণা হয়েছে, তা কোনো অংশে কম নয়। সাহিত্য যেমন ভাষাবিদ্যায় আবদ্ধ নয়, তেমনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন আকাশ ছুঁয়ে দিতে পারে। পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, রাষ্ট্রের পঠন-পাঠন ও ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভূমিকার চেয়ে রাষ্ট্রনায়কদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ে কেউ রাজনীতিবিদ হয় না; বরং রাজনীতি ও রাষ্ট্রনায়কদের অধ্যয়ন করে, বিচার-বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান তার যথার্থতা প্রমাণ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি অধীত বিষয়, যা রাষ্ট্রকে মহিমান্বিত করতে পারে। কিন্তু তত্ত্ব ও বাস্তবতার একসাগর ব্যবধান তো রয়েছেই।

বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তির এই বৈপ্লবিক সময়ে রাষ্ট্র যেহেতু উবে যায়নি, তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়নি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাগরিক সমস্যা জটিল ও কুটিল হওয়ার কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন বিশেষত নাগরিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সরকারগুলোর স্বৈরাচারী প্রবণতা রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের তাৎপর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে। একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে যেমন অবহিত হওয়া যায়, রাষ্ট্রের সমস্যাবলি অনুধাবনে সহায়ক হয় এবং রাষ্ট্র ও সরকারের করণীয় এবং কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া সহজ হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে শুধু রাষ্ট্র নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ঘটে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেহেতু সমাজ, রাষ্ট্র ও বৈশি^ক পরিসরে পঠিত হয়, সে কারণে এটি ক্যারিয়ার বিল্ডিং বা পেশাগত সফলতা অর্জনে সহায়ক হয়। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সিভিল সার্ভিসে অংশগ্রহণে অধ্যয়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। প্রশাসন, কূটনীতি, ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন কৌশল ও বিরোধ নিরসনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান। রাষ্ট্র ও সরকারের নীতি-নির্ধারণে, কাঠামো নির্মাণে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি অধ্যয়ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরই বিষয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আদি-অন্ত যারা জানেন তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, শুধু অধ্যয়নের জন্য এর সৃষ্টি হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে দর্শন বা ইতিহাসের তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে বাস্তব ভূমিকা রাখার প্রত্যয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আবির্ভাব। ১৯০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতি গড়ে উঠে। ১৯০৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান-বিষয়ক জার্নাল ‘American Political Science Review’ যাত্রা শুরু করে। এভাবে দর্শন, আইন, সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির মতো সামাজিক বিষয়কে অতিক্রম করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান তার স্বকীয় সত্তা প্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠাতাদের একজন মানদ্রু স্মিথ রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে ‘The Science of the State’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের কার্যাবলি, সংগঠন ও নাগরিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ শুরু করে। ১৯৪০ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইউনেস্কোর স্বীকৃতি অর্জন করে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতি গঠনের ইতিহাস নেতিবাচক। জাতি বা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে নয়, দলীয় প্রয়োজনে এটি ব্যবহৃত হয়েছে। যে অর্থে অর্থনীতি সমিতি রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে অবলোকন করে, পর্যবেক্ষণ করে ও পরীক্ষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়, সেরকম একটি একাডেমিক ও পেশাগত অবস্থান রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, নাগরিকদের উন্নয়নে ও গণতন্ত্রের অগ্রায়নে ভূমিকা রেখেছে এমন প্রমাণ নেই।

উল্লেখ্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক উত্থান ঘটে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তখন রাষ্ট্রবিজ্ঞান তত্ত্বকথার সীমাবদ্ধতা ফেলে রেখে প্রথমত আচরণবাদ ও দ্বিতীয়ত তুলনামূলক পন্থায় সরাসরি রাষ্ট্রের ভূমিকা ও কার্যক্রম নিয়ে বিপ্লবী যাত্রা শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ১৯৬০ ও ’৭০-এর দিকে এর প্রতিফলন ঘটে। ২০০০ সালের দিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চায় আরেকটি উল্লম্ফন ঘটে। তখন গাণিতিক বিশ্লেষণে রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়। এভাবে আরো বাস্তব ও ঘনিষ্ঠভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সরকার ও রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যয়ন এখন সর্বব্যাপী- ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিধি অবধি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এখন স্থিতিশীলতা, ন্যায়বিচার, শান্তিশৃঙ্খলা এমনকি সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাদের নিজ নিজ সরকারকে এসব বিষয়ে সতর্ক করছে, পরামর্শ দিচ্ছে এবং শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করছে। এটি এখন বাস্তব যে ‘Political science provides analysis and predictions about political and govarnmental issues.' (Maddocks, Krysten Godfrey 26 June 2020). ÔWhat is Political Science All About?Õ.www.snhu.edu. Archived from the original on 25 September 2021. Retrieved 25 September 2021)’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিকদের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন পৃথিবীর সর্বত্র। তারা পেশাগতভাবে রাজনৈতিক দলের অফিসও নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের যদি নির্বাহী দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়; রাষ্ট্র উত্তম সেবা পায়। বিশ্বব্যাপী এনজিওগুলো পরিচালনায় তারা দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করছেন। বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তারা থিংকট্যাংক বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। বিভিন্ন দেশে তারা রাষ্ট্রিক নীতিমালা নির্ণয়, কূটনীতির মতো জটিল বিষয়, জনমত গঠন, নির্বাচন পরিচালনা ও পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছেন। রাষ্ট্রিক সঙ্কট সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়া, সঙ্কট উত্তরণে সহায়তা ও জাতীয় ঐকমত্য অর্জনে বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভূমিকা প্রশংসিত হচ্ছে।
এই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যথার্থ ভূমিকা পালন করছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তারা যদি ইচ্ছা করেন; সফল ভূমিকা রাখতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাই যে একমাত্র ভূমিকা রাখার অধিকারী এমন নয়। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে যেসব রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কর্মরত তাদের বিষয়ানুগতার কারণে সঙ্গত ভূমিকা রাখতে পারেন।

কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন ও এর প্রায়োগিক বাস্তবতা ভিন্নতর। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি আয়তনে ছোট হলেও জনসংখ্যায় বিশাল। অশিক্ষা, জনদারিদ্র্য ও জীবন সমস্যা এতটাই তীব্র যে, একটি নিয়মানুগ শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা সুকঠিন। সুকঠিন এর মোকাবেলায় যে সুশাসন বাংলাদেশকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে, তা এখানে রীতিমতো অনুপস্থিত। বিশেষ করে বিগত দেড় দশকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ায়, রাজনৈতিক উন্নয়নের (Political Development) পরিবর্তে রাজনৈতিক অনুন্নয়ন (Political Decay) ঘটেছে। শুধু রাজনৈতিক অনুন্নয়নই নয়, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক এলিটরা কর্তৃত্ববাদী, একদলীয় ও স্বৈরাচারী অভিধায় অভিযুক্ত হচ্ছেন। গণতন্ত্রের জন্য যে জাতির সৃষ্টি, তারা আজ গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি লক্ষ করছে। বিশেষ করে যে নির্বাচনব্যবস্থা গণতন্ত্রের প্রাণ, সেই নির্বাচন ব্যবস্থা নির্বাসিত হয়েছে।

বাংলাদেশের বহমান সঙ্কটে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের ভূমিকা রাখার যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র যে রাজনৈতিক সঙ্কট অতিক্রম করছে, সে সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রয়েছে নিজস্ব দর্শন, প্রক্রিয়া ও কলাকৌশল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্টন বলেন, ‘Conflict resolution is competent of simultaneously copying with domestic, regional and international conflicts and capable of operating in this similar socio-economic and political conditions or environments’. (Burton : 1993 : P-64). রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাদের অনুসন্ধান, গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের নিরিখে রাজনীতির গহীন গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম।
বাংলাদেশের চলমান সঙ্কটের নৃতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও আচরণগত অধ্যয়নের মাধ্যমে সঙ্কটের আপাত সমাধান না হলেও দীর্ঘকালীন বা স্থায়ী সমাধান অসম্ভব নয়। সে জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের তত্ত্বকথা থেকে বেরিয়ে প্রায়োগিক সমস্যায় গভীর অধ্যয়ন করতে হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রচিন্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় সমঝোতা সৃষ্টিতে (National Consensus) সহায়তা করতে পারে। সিভিল সোসাইটির প্রাসঙ্গিক এজেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মধ্যবর্তী ভূমিকা পালন করতে পারেন। বাংলাদেশে অতিমাত্রিক রাজনৈতিক অবস্থা এই যথার্থ ভূমিকার সহায়ক নয়। বাংলাদেশে দলীয় মনোভাব এতটা তীব্রতা অর্জন করেছে যে, সমাজ আর ‘শত ফুল ফুটতে দেয়া’ এর পরিবেশে নেই। তবে অব্যাহত প্রয়াস, প্রচারণা ও জনমতের মাধ্যমে একটি কাক্সিক্ষত অবস্থান নির্ণয়ে হয়তো বা অদূর ভবিষ্যতে এটি প্রায়োগিক হতে পারে।

রাষ্ট্র তার জনশক্তিকে প্রত্যাশিত, পরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট উপায়ে উদ্দিষ্ট লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসেবে গড়ে তুলবে, এটিই স্বাভাবিক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় এর নাম হচ্ছে ‘জাতি গঠন’ (Nation Building)। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভবিষ্যৎ নাগরিক সাধারণের মানস গঠনের পরিবর্তে আইয়ুবীয় কায়দায় রাষ্ট্র নির্মাণ (State Building) করে জাতিকে বিভ্রান্ত করতে চায়। জাতীয় পর্যায়ে নৈতিক অবক্ষয়ের যে প্লাবন লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা এই অসম নীতিগত সিদ্ধান্তের কুফল। উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের সুদীর্ঘ ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার আলোকে জনশক্তিকে সেভাবেই বিন্যস্ত করে। শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে কাক্সিক্ষত জাতিগঠনের প্রধান মাধ্যম। প্রাথমিক অবস্থা থেকে উচ্চতর শিক্ষা পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মাধ্যমে সুনাগরিকের দীক্ষা দান সম্ভব। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাথমিক ধাপ পৌরনীতি। বর্তমানে এর সাথে সংযুক্ত হয়েছে ‘সুশাসন অধ্যয়ন’ পরিভাষাটি। সব পর্যায়ে পৌরনীতি তথা সুশাসন অধ্যয়নের মাধ্যমে সামান্য হলেও দেশপ্রেমের চেতনা জাগ্রত হতে পারে। এই অধ্যয়ন আমাদেরকে- ১. ভালো নাগরিক উপহার দেবে; ২. অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে নাগরিকদের সচেতনতা তৈরি করবে; ৩. জনকল্যাণের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হবে; ৪. গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দীক্ষা দেবে; ৫. স্থিতিশীল সমাজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা প্রতিষ্ঠিত হবে; ৬. আস্থা ও বিশ^াস সুদৃঢ় করবে; ৭. সঠিক ইতিহাস অধ্যয়নে সহায়ক হবে; ৮. জাতীয় সমস্যা চিহ্নিত করতে পারবে; ৯. স্বকীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করবে এবং অবশেষে সুশাসনের (Good Governance) ধারণাটি টেকসই হবে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা বাংলাদেশের চলমান সঙ্কট এবং কাক্সিক্ষত ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত। দৃশ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট ও সঙ্ঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ নাগরিকদের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরাও উদ্বিগ্ন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উচিত একাডেমিকভাবে, নৈর্ব্যক্তিকভাবে ও জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বর্তমান সঙ্কটের নিয়মতান্ত্রিক সমাধানের প্রচেষ্টা চালানো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, বর্তমান সঙ্কটের মূল উৎস নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলকরণ।

আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রবল আন্দোলনের সুফল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আবার কুফল হচ্ছে তাদের দ্বারা বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বর্তমান সঙ্কট। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়েছে। সুতরাং ব্যবস্থাটি উভয় দলীয় প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন। তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে সৃষ্ট জাতীয় ঐকমত্য এখনো অটুট ও অনিবার্য। অবশেষে বাংলাদেশের রাজনৈতিক এলিটদের জেমস ফ্রিম্যান ক্লার্কের সেই বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ‘A politician thinks of the next election; a statesman thinks of the next generation.’
লেখক : প্রফেসর (অব:), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা
Email : mal55ju@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/783476