৩ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:৪৮

প্রায় দুই বছরে রেলে কাটা পড়ে ৫২২ জনের মৃত্যু

বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা জোনের বিভিন্ন রেললাইন থেকে প্রায় দুই বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত ৫২২ জনের লাশ উদ্ধার করেছে রেলওয়ে পুলিশ। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসব লাশ উদ্ধার করা হয়। এই হিসাবে ওই সময়ে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ২২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রেল পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

অপরাধ বিশ্লেষকরা এসব মৃত্যুর জন্য পথচারীদের অসচেতনতাকে দায়ী করেছেন। এর সঙ্গে আছে রেলপথে যথাযথ নিরাপত্তার অভাব। পুলিশের তদন্তেও এসব মৃত্যুর পেছনে আইন না মেনে চলা ও অসচেতনতার বিষয়টি উঠে এসেছে। বিশ্লেষকরা এসব দুর্ঘটনা রোধে রেলবিষয়ক আইনের সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতায় গুরুত্বারোপ করেছেন।

তদন্তের সূত্রে রেল পুলিশ বলছে, রেললাইন পার হওয়ার সময় বা লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় মোবাইল ফোন ও ইয়ারফোন ব্যবহার করা, রেললাইন ধরে অসতর্কভাবে হাঁটা, রেললাইনের পাশ দিয়ে নিরাপদ দূরত্ব না মেনে যাতায়াত করা, না দেখে তাড়াহুড়া করে লেভেলক্রসিং পার হওয়া এবং চলন্ত ট্রেন আসার সময় সেলফি তোলার চেষ্টা, রেললাইনের ওপর বসে বেখেয়াল হয়ে গল্প করার কারণে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

রেল পুলিশের তথ্য মতে, ঢাকা জোনের রেলওয়ে থানার অধীনে পাঁচটি ফাঁড়ি এলাকা থেকে গত বছর ট্রেনে কাটা পড়ে ২৮৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এই ফাঁড়ি এলাকাগুলো হলো টাঙ্গাইল, টঙ্গী, জয়দেবপুর, এয়ারপোর্ট ও নারায়ণগঞ্জ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে হেডফোন বা ইয়ারফোন লাগিয়ে রেললাইন দিয়ে বা পাশ দিয়ে চলার সময়। গত বছর এ কারণে ৯৫ জনের মৃত্যু হয়।

এ বিষয়ে কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌস আলম বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ মানুষের অসচেতনতা। তদন্তে এর বাইরে আরো কিছু কারণ পাওয়া গেছে। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা নিয়মিত ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত রেললাইনের ওপর নজরদারি করি।

চলতি বছর এ পর্যন্ত এসব এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়া ২৩৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগের বছর ২০২২ সালে ট্রেনে কাটা পড়া ২৮৭টি লাশ উদ্ধার করা হয়।’

ওসি বলেন, এসব দুর্ঘটনা রোধে প্রতিবছর বিভিন্ন সুপারিশ তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। সুপারিশে যেসব বিষয় থাকে, এর মধ্যে রয়েছে রেললাইনকে রাস্তা বা হেঁটে চলার পথ হিসেবে যাতে কেউ ব্যবহার না করে, সেই ব্যবস্থা করা; রেললাইনের আশপাশে থাকা বস্তি সরিয়ে ফেলার পাশাপাশি অনৈতিক কর্মকাণ্ড রোধে ব্যবস্থা নেওয়া।

তিনি বলেন, সাধারণ মানুষকে কর্তৃপক্ষ প্রতিনিয়ত সচেতনতামূলক বার্তা দিলেও অনেকে আমলে নেয় না। বিশেষ করে রেললাইনের পার্শ্ববর্তী জমি দখল, কাঁচাবাজার বসানো ও অবৈধ রাস্তা তৈরি করে রেললাইন ঘেঁষে চলাচল করা হচ্ছে। এ কারণেও দুুর্ঘটনা ঘটছে। তাই শুধু আইন দিয়ে নয়, সাধারণ মানুষ সচেতন হলে এমন মর্মান্তিক মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব।

রেলের প্রচলিত আইনে রেললাইন ধরে হাঁটা অবৈধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ। শুধু লাইন নয়, লাইনের দুই পাশ (১০ ফুট করে) ১৪৪ ধারা জারি সর্বদা বহাল রয়েছে।

রেলওয়ে সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, রেল এখনো ১৮৬১ সালের ব্রিটিশ শাসনামলের পুরনো আইনে চলছে। এ আইনের ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী, রেললাইনের দুই পাশে ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট লোক ছাড়া কোনো মানুষ, এমনকি গবাদি পশুর প্রবেশ নিষিদ্ধ। লাইনের দুই পাশের ২০ ফুট এলাকায় সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। ওই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা যায়।
সরেজমিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মহাখালী ও মগবাজার গিয়ে দেখা যায়, লেভেলক্রসিংয়ের দুই পাশে মানুষ আড্ডার পাশাপাশি নানা কাজে ব্যস্ত। কেউ কেউ রেললাইনের ওপর দিয়ে যেতে যেতে মোবাইল ফোনে কথা বলছে, আশপাশের দিকে কোনো খেয়াল নেই। দু-চারজন ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা রেললাইনের ওপর বসে চা, পান-সিগারেট বিক্রি করছেন। রেললাইনের আশপাশে মাদকদ্রব্য কেনাবেচা ও সেবনের দৃশ্যও চোখে পড়ে। এ ছাড়া অনেকে রেললাইন ধরে হাঁটছিল। ট্রেন আসার সংকেত বাজালেও সেভাবে সতর্ক হতে কাউকে দেখা যায়নি। এমনকি ট্রেন অতি নিকটে আসার পরও কয়েকজনকে দৌড়ে রেললাইন পার হতে দেখা যায়।

সন্ধ্যার পর কারওয়ান বাজারে মাছের পাইকারি আড়তসংলগ্ন রেললাইনের আশপাশে নানা বয়সী একদল নারী-পুরুষকে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করতে দেখা যায়। এ সময় আরমান নামের এক মাদক ব্যবসায়ী দাবি করেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু সদস্যকে ম্যানেজ করেই তাঁরা এখানে মাদক বিক্রি করছেন। এ কারণে এখানে সব সময় একটা জটলা লেগে থাকে। এই জটলাও ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে।

এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন—জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশের নজরদারি রয়েছে। এর আগেও মাদক বিক্রির অভিযোগে অনেক বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা জামিনে বের হয়ে আবার একই অপকর্মে লিপ্ত হয়।’

তিন শিশুর আলোচিত মৃত্যু
সম্প্রতি ট্রেনে কাটা পড়ে তিন শিশুর মৃত্যুর ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর মহাখালী এলাকায় ঢাকা থেকে জামালপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া দেওয়ানগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়ে ওই তিন শিশুর মৃত্যু হয়।

মহাখালী এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন পথশিশু ওই এলাকায় ঘোরাঘুরি করত। এলাকার কয়েকজনের ভাষ্য, তারা নেশার উপকরণ (ড্যান্ডি) সেবন করত। ঘটনার সময় তারা নেশাগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে। ট্রেন তাদের খুব কাছে আসার পরও তারা টের পায়নি। এ সময় আশপাশের লোকজন চিৎকার করে তাদের সতর্ক করলেও তারা কান দেয়নি। তিনজনের বয়স ১১ থেকে ১৫ বছর। তাদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

পুলিশ জানায়, রেলওয়ে পুলিশ তিন শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। গতকাল সোমবার রাত সাড়ে ৯টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিন শিশুর লাশ মর্গেই ছিল।

কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি জানান, এই শিশুদের স্বজনদের খোঁজে গতকালও মহাখালীসহ বিভিন্ন স্থানে প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়েছে।

https://www.kalerkantho.com/online/national/2023/10/03/1323442