৩ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:৩৯

হতদরিদ্রদের প্রশিক্ষণের টাকাও ভাগবাঁটোয়ারা

ঘুস নিয়ে এনজিওকে কাজ দেওয়ার অভিযোগ মহিলা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে

গ্রামের হতদরিদ্র মহিলাদের জীবনমান উন্নয়ন ও আয়বর্ধক প্রশিক্ষণের জন্য বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে বিশেষ সুবিধা নিয়ে এনজিওকে তাদের প্রশিক্ষণের জন্য নিয়োগ দেওয়া। একজন হতদরিদ্র মহিলাকে প্রশিক্ষণের জন্য এনজিওকে সার্ভিস চার্জ হিসাবে ৪৬৫ টাকা দিচ্ছে সরকার। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তাদের সুবিধা দিয়ে প্রশিক্ষণের কাজ নেওয়ার পর এনজিওগুলো অতিদরিদ্র নারীদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে না। ইতোমধ্যে প্রতিমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিবকে (এপিএস) আর্থিক অনিয়মের কারণে অপসারণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই প্রকল্পের আওতায় ভালনারেবল উইম্যান বেনিফিট (ভিডব্লিউবি) সুবিধা পাওয়ার যোগ্য দরিদ্র মহিলাদের প্রশিক্ষণের নামে সরকারি অর্থ লোপাট হচ্ছে।

মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সিলেকশন করা এনজিও দরিদ্র মহিলাদের স্থায়ীভাবে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা প্রদানসহ জীবনঘনিষ্ঠ উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এনজিও’র মাঠ পর্যায়ের প্রশিক্ষকদের এসব বিষয়ে জ্ঞান নেই বলেও জানা গেছে। অন্যদিকে এনজিওগুলো অনিয়মের জন্য অভিযোগ তুলছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের দিকে। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের বেশকিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে আবেদন করেছে একাধিক এনজিও। ঘুস দিতে না পারায় ওই এনজিওগুলোকে প্রশিক্ষণের কাজ দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে ‘পাথেয়’ নামে একটি এনজিও লিখিতভাবে অভিযোগ করেছে। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে চলতি বছরের মার্চের দিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল তদন্তের উদ্যোগ নেন। এর অংশ হিসাবে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন, পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান) রওশন আরা বেগমকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন-যুগ্মসচিব (উন্নয়ন) নাহিদা মঞ্জুরা আফরোজ এবং উন্নয়ন শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব হালিমা খাতুন। তবে এখনো তদন্ত শেষ হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমা মোবারেক যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এমনকি তদন্ত কমিটি হয়েছে কিনা তাও তিনি অবগত নন। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মুহাম্মদ ওয়াহেদুজ্জামান এনডিসি যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত চলছে। এখনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক পদস্থ কর্মকর্তা জানান, সচিব স্যার নতুন এসেছেন। বিষয়টি তাকে জানানো হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রামের অতিদরিদ্র মহিলাদের সরকার ভিডব্লিউবি প্রকল্পের আওতায় প্রতি মাসে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বিনামূল্যে ৩০ কেজি চাল দিচ্ছে। দেশে ১০ লাখ ৪০ হাজার অতিদরিদ্র মহিলা এই প্রকল্পের উপকারভোগী। দেশের সব উপজেলা আগে ভার্নারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) নামে চালু ছিল। বর্তমানে এই প্রকল্পের নামকরণ করা হয়েছে ভার্নারেবল ইউম্যান বেনিফিট (ভিডব্লিউবি)। এই প্রকল্পের অওতায় সুবিধা পাওয়ার জন্য উপকারভোগীদের বিশেষ কার্ড প্রদান করা হয়। কয়েক বছর যাবৎ ভিডব্লিউবির উপকারভোগী মহিলাদের এনজিওর মাধ্যমে জীবন দক্ষতা ও আয় বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সরকার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রশিক্ষণে মহিলাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, খাবার স্যালাইন তৈরি, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহার, সন্তান লালন-পালন, জন্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতামূলক জীবন দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। এছাড়া হাঁস ও মুরগি পালন, বাড়ির আঙিনায় পরিত্যক্ত জমিতে ফলমূলের চাষ, হাতে তৈরি গেরস্তালিসংক্রান্ত যাবতীয় পণ্য তৈরি ও বিপণন, প্রতিদিনের রান্নার চাল থেকে কিছুটা সংরক্ষণ, ফলমূল চাষের মাধ্যমে পরিবারের আয় বৃদ্ধির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। প্রত্যেক উপকারভোগীকে জীবন দক্ষতা ও আয় বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ দিতে এনজিওকে সরকার সার্ভিস চার্জ হিসাবে ৪৬৫ টাকা করে দিচ্ছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, কোন এনজিও কোন উপজেলায় কাজ করতে আগ্রহী সে বিষয়ে দরখাস্ত আহ্বান করে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। পরে বাছাই করে এনজিও নির্ধারণ করা হয়। একটি উপজেলায় এক বছরের প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিটি এনজিওকে দেওয়া হয় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। দুই উপজেলায় প্রশিক্ষণ কাজ পরিচালনার জন্য একটি এনজিওকে দেওয়া হয় ২০ থেকে ২৪ লাখ টাকা। সেক্ষেত্রে এনজিও নির্বাচনে মোটা অঙ্কের ঘুস লেনদেন হচ্ছে।

এনজিও নির্বাচনে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের এক উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালকের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এক উপজেলায় এক বছরের প্রশিক্ষণের কাজ করা প্রতিটি এনজিওর কাছ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে অগ্রিম নিয়ে এনজিওর তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। আবার দুই উপজেলায় এক বছরের জন্য প্রশিক্ষণের কাজ করা এনজিওকে দিতে হয় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। টাকা দিতে পারবে না সেই এনজিওকে প্রশিক্ষণের কাজ দেওয়া হয় না। মন্ত্রণালয়ের একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা এই অপকর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের পরিচালক মনোয়ার ইশরাত যুগান্তরকে বলেন, যে এনজিও কাজ পায় না তারা সব সময় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ করে। এখানেও তাই ঘটেছে। সবাই তো কাজ পাবে না। তাই তারা অভিযোগ করেছে।
উপপরিচালক আবুল কাশেম এসব কাজে তার সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, আমি ওই ডেস্কে কাজ করি না। আমার সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই।

তবে একাধিক এনজিও মালিক জানান, আবুল কাশেম দীর্ঘদিন এনজিও সেলেকশনের কাজ করায় মালিকদের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সে ওই শাখায় কাজ না করলেও বিশ্বস্ত হওয়ায় এনজিও মালিকরা কাজ পাওয়ার জন্য তার কাছে ধরনা দেয়। তারা আরও জানান, আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে এর আগেও অভিযোগ হয়েছে। তবে সে অভিযোগ গায়েব করে ফেলে। অভিযোগের বিষয়ে সহকারী পরিচালক মো. সাইদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। আপনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলুন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ফরহাদ হোসেন বেশ কিছু এনজিওর কাছ থেকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠার পর প্রতিমন্ত্রী এপিএসকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন।

সূত্র জানায়, ঘুস দিয়ে প্রশিক্ষণের কাজ পাওয়ায় এনজিওগুলো উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণের বিষয়ে সম্পূর্ণ অমনোযোগী থাকে। তারা কাগজে-কলমে প্রশিক্ষণ দেখিয়ে ওই খাতের অর্থ তুলে নিচ্ছে। অথচ উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার প্রতিবেদনে যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ না দেওয়ার বিষয়টি গোপন করা হয়। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. ওয়াহেদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তারা তো সুবিধাভোগী। তারা এনজিওর কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে সবকিছু গোপন করছে। অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়ে সঠিক তথ্য পাঠিয়ে কি তারা উপরি আয়ের রাস্তা বন্ধ করবে নাকি? তারা অত বোকা নয়। তিনি আরও বলেন, আমরা এখন থেকে এসব কাজের তদারকি উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জেলা প্রশাসকরাও এসব কাজ তদারকি করবেন।
অধিদপ্তরের পরিচালক মনোয়ারা ইশরাত যুগান্তরকে বলেন, আমরা বিল দেওয়ার আগে উপজেলা ও জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বিল পরিশোধ করি। সেখানে ভালো মানের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে বলে উল্লেখ থাকে। প্রতিবেদন ছাড়া তো বিল পরিশোধ করা হয় না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/724423