৩ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:৩২

বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার জরুরি

ব্যাংক খাতে নিয়ন্ত্রণহীন খেলাপি ঋণের লাগাম কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। তাদের বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও আসছে না কোনো সুফল। আগের ঋণ তো পরিশোধ করছেই না, বরং বিদ্যমান আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে নতুন ঋণ বের করে নিচ্ছেন খেলাপিরা। সরকারের সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে খেলাপির খাতা থেকে নাম মুছে ফেলেন তারা।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাগিয়ে নেন নগদ সহায়তা। থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। নানা উপায়ে তাদের ওপর অকার্যকর থাকে বিদ্যমান সব আইন, বিধিবিধান ও নির্দেশনা। আর এসব কারণেই এ মুহূর্তে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যদিও কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে, প্রকৃত খেলাপির অঙ্ক সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার কম হবে না।

কারণ ঋণ পুনঃতফশিল, পুনর্গঠন, অবলোপন ও আদালতে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া ঋণের হিসাব বর্তমান খেলাপির অঙ্কে দেখানো হয় না। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রথমেই ব্যাংকগুলোকে নির্মোহভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে-এমন মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া খেলাপি কমানো সম্ভব নয়। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ পর্যন্ত যত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে সব কেড়ে নিতে হবে। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তাদের বিচার করতে হবে। এ ট্রাইব্যুনালে কোনো আপিলের সুযোগ রাখা যাবে না।

উল্লেখ্য, ব্যাংক কোম্পানির সংশোধিত আইনে বলা হয়, কেউ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে প্রমাণিত হলে তার বিদেশ ভ্রমণ এবং ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যাবে। এছাড়া তার কোম্পানির অনুমোদন বাতিল করা যাবে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ একেবারে নেই বললেই চলে-এমন অভিমত সংশ্লিষ্টদের।

বিশেষ ছাড় বন্ধ না হলে ঋণখেলাপি কমবে না বলে জানিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, খাতা-কলমে দেখানো হচ্ছে এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে এই অঙ্ক অনেক বেশি। কারণ এখানে পুনঃতফশিল ও পুনর্গঠন করা ঋণের হিসাব নেই, এগুলো যোগ করলে খেলাপি আরও বাড়বে। তিনি জানান, খেলাপি ঋণ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা মানে ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে।

করণীয় জানতে চাইলে সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করছে। এখন সুবিধা বন্ধ করে খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে হবে। যদিও এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, যেন আইনে গিয়ে বছরের পর বছর ঝুলে না থাকে। এছাড়া খেলাপিদের সম্পদ নিতে হবে। কঠোর অবস্থায় যাওয়া ছাড়া এখন আর কোনো বিকল্প নেই বলে জানান এ অর্থনীতিবিদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ঋণখেলাপিদের তো কিছুই হচ্ছে না। তারা উলটো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। তাহলে তারা ঋণ ফেরত দেবেন কেন? বিদেশে ঋণখেলাপিদের সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়। আর এখানে কিছুই করা হয় না। এতে ব্যাংক খাত ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে খাতটি শেষ হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেওয়া খেলাপি ঋণের এ তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। ঋণ পুনঃতফশিল, ঋণ পুনর্গঠন, ঋণ অবলোপন এবং অর্থঋণ আদালতে মামলায় ঝুলে থাকা-এসব ঋণ হিসাবে নিলে প্রকৃত খেলাপি সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার কম হবে না। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক দেখাচ্ছে মাত্র ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা।

এটা সঠিক নয়। উচ্চ ঋণখেলাপি থেকে বাঁচার উপায় একটাই-সেটা হচ্ছে একটা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। সে ট্রাইব্যুনালে প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির বিচার করতে হবে। খেলাপিদের সব সম্পদ ক্রোক করতে হবে। জেলে পাঠাতে হবে। জেলের ভাত না খাওয়ালে হবে না। এ ট্রাইব্যুনালের বিচারে কোনো আপিলের সুযোগ রাখা যাবে না। এছাড়া খেলাপি থেকে বাঁচার আর কোনো উপায় নেই বলে জানান তিনি।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে বছরের পর বছর ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতাদের জন্য যে উদারতা দেখানো হয়েছে, তারই কুফল খেলাপি ঋণের ধারাবাহিক বৃদ্ধি। যখন কাউকে কোনো সুবিধা দেওয়া হয়, তখন তিনি ওই সুযোগ নেবেন এটাই স্বাভাবিক। এজন্য যিনি সুযোগ নিচ্ছেন, তার চেয়ে যারা সুযোগ দিচ্ছেন, তারাই বেশি দায়ী।

সুযোগ নেওয়ার পর সুযোগসন্ধানীরা আরও বেশি সুযোগ নিতে ঋণের অপব্যবহার করেছেন। ফলে খেলাপি ঋণের বিষয়টি অর্থনীতির জন্য ক্যানসারে রূপ নিয়েছে। ক্যানসার এমন একটা রোগ, যা প্যারাসিটামল দিয়ে সারানো সম্ভব নয়। তাই এখন সময় এসেছে সর্বোচ্চ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ নামক অর্থনীতির এ ক্যানসার থেকে মুক্তির পথ খোঁজার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের এ অঙ্ক দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের ২০ জুন জানায়, যদি কোনো গ্রাহক চলতি বছরের জুনের মধ্যে ঋণের কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দেয় সে খেলাপি হবে না। ফলে যারা ঋণ নিয়ে কিস্তি শোধ না করে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছিলেন, তারা কিস্তির অর্ধেক টাকা জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হওয়ার সুযোগ পান। তবে শুধু মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দেওয়া হয়। সাধারণত ব্যবসা শুরু বা শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে মেয়াদি ঋণই নেওয়া হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/724413