২ অক্টোবর ২০২৩, সোমবার, ১:১৩

ঘটা করে উদ্বোধন, এখন বাসে ই-টিকিটের অস্তিত্ব নেই

রবিবার বিকেল সাড়ে ৪টা। ঘটনাস্থল রাজধানীর রামপুরা। সেখানকার সড়ক দিয়ে পার হচ্ছিল রাইদা পরিবহনের একটি বাস। ওই বাসে চলছিল চালকের সহকারী ও যাত্রীর তর্ক।

চালকের সহকারী মো. জামিল তর্ক করছিলেন যাত্রী জুবায়ের হাওলাদারের সঙ্গে। বিতর্কের মূলে ভাড়ার পাঁচ টাকা। জুবায়ের বলছিলেন ভাড়া ২৫ টাকা। জামিল বলছিলেন, তিনি ৩০ টাকার নিচে নেবেন না।

কিছুক্ষণ তর্ক চলার পর মীমাংসার জন্য ভাড়ার তালিকা দেখতে চাইলেন জুবায়ের। কিন্তু বাসে তালিকা খুঁজে পাওয়া গেল না।
মীমাংসার আরেকটা উপায় হতে পারত পজ মেশিনে কাটা ই-টিকিট। কিন্তু টিকিট কাটার মেশিনও জামিলের হাতে ছিল না।
ভাড়ার বিপরীতে তিনি যাত্রীদের টিকিট দিচ্ছিলেন না। খিলগাঁও থেকে বাসে ওঠা জুবায়ের যাবেন নদ্দা। তাঁর ভাষ্য, ‘নিয়মিত ভাড়া দেন ২৫ টাকা।’ জামিল বলছেন, তিনি প্রতিদিন এই পথে ভাড়া কাটেন ৩০ টাকা। শেষে তর্কের শেষ টানেন জামিল।
২৫ টাকা ভাড়া নিয়ে গেটের দিকে যেতে যেতে অন্য যাত্রীদের কাছে বিচার দেন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) রাজধানীর বিভিন্ন পথে চলাচলকারী বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ ভাগে ভাড়ার তালিকাও প্রকাশ করা হয়। রাইদা পরিবহনের বাস যাত্রাবাড়ীর পোস্তগোলা থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ী পর্যন্ত পথে চলাচল করে। মাঝখানে সায়েদাবাদ-খিলগাঁও-বাড্ডা-বিমানবন্দর এলাকা পড়ে। বিআরটিএর ভাড়ার তালিকায় সুনির্দিষ্ট এই পথই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আজিমপুর থেকে মিরপুর ১০ নম্বর পথে যাচ্ছিল মিরপুর সুপার লিংক পরিবহনের একটি বাস। কলাবাগান থেকে মিরপুর যেতে ওই বাসে ওঠেন যাত্রী ইমরান হোসেন। আসাদগেট পৌঁছলে আসেন ভাড়া আদায়কারী। ভাড়া চাইলেন ২৫ টাকা। কিন্তু বাসে ছিল না কোনো ভাড়ার তালিকা। তালিকা না থাকায় ২৫ টাকা দিতে চাইছিলেন না ইমরান। সেখানেও কিছুক্ষণ চলে কথা-কাটাকাটি।

বিআরটিএর ভাড়ার তালিকার প্রথম ভাগে ঢাকেশ্বরী থেকে পল্লবী পর্যন্ত চলাচলকারী বাসের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কলাবাগানে কোনো স্টপেজ নেই। ফলে কলাবাগান থেকে বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়নি। স্টপেজ আছে ধানমণ্ডিতে। ধানমণ্ডি থেকে মিরপুর ১০ নম্বরের ভাড়া ১৮ টাকা। কিন্তু আদায় করা হচ্ছে ২৫ টাকা।

যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে গত বছর ২২ সেপ্টেম্বর ই-টিকেটিং ব্যবস্থা চালু করে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। এরই মধ্যে পার হয়েছে এক বছর। কিন্তু এখন আর কোনো বাসেই ই-টিকিটের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু যেসব বাস কাউন্টারভিত্তিক চলাচল করে, সেগুলোর কাউন্টার থেকে টিকিট নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ই-টিকেটিং ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়ায় যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাস খাতকে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে। না হলে এমন উদ্যোগ টিকবে না। এই খাতে নেই কার্যকর কোনো পদ্ধতি। নেই ব্যবসার পরিবেশ কিংবা পর্যাপ্ত বিনিয়োগ। ক্ষতে ভরা এই খাতে মলমে কাজ হবে না।’

কাগজে-কলমে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। গতকাল সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে বাসে চলে দেখা গেছে, কোনো ভাড়া আদায়কারীর হাতে নেই ভাড়া আদায়ের পজ মেশিন। ভাড়া আদায়ে মানা হচ্ছে না বিআরটিএর নির্ধারিত তালিকা। ওয়েবিল প্রথা বাতিল করা হলেও তা অব্যাহত রাখা হয়েছে। ওয়েবিলের কারণেই যাত্রীদের বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাসে যে সহকারীরা থাকে তারা সবাইকে টিকিট দিতে চায় না। পিক টাইমে (ব্যস্ত সময়) টিকিট দেওয়া সম্ভবও হয় না। শতভাগ টিকিট নিশ্চিত করতে হলে নিচে কাউন্টার বসিয়ে টিকিট দিতে হবে।’

২০১২-১৩ সালে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) বাসে প্রথম ই-টিকেটিং ব্যবস্থার প্রচলন করে। তখন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাসে যাত্রীদের কাছ থেকে র‌্যাপিড পাসের মাধ্যমে ই-টিকিটে ভাড়া আদায় শুরু হয়। যদিও দীর্ঘ মেয়াদে এই ব্যবস্থা সফলতার মুখ দেখেনি। নতুন করে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা সড়ক পরিবহন বাস মালিক সমিতি ই-টিকেটিং প্রথার প্রচলন করে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সূত্র বলছে, বর্তমানে মিরপুরকেন্দ্রিক ৩০টি প্রতিষ্ঠান এবং উত্তরা ও আজিমপুরকেন্দ্রিক আরো ১০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় আড়াই হাজার বাসে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে বাসে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা রয়েছে এমন তথ্য জানেন না অনেক যাত্রী। বাড্ডায় ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের একটি বাসে ভ্রমণকারী সুব্রত সাহা বলেন, ‘চাকরির কারণে তিন মাস ধরে এই পথে নিয়মিত যাতায়াত করি। এই বাসে যে ই-টিকিট রয়েছে সেটাই তো জানি না। আর আমি কোনো দিন এই বাসে টিকিট দিতেও দেখিনি। জানতাম না তাই কখনো টিকিট চাইনি।’

রাজধানীর গণপরিবহনে ওয়েবিল ও বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধে গত বছর ২২ সেপ্টেম্বর আটটি কম্পানির বাসে পরীক্ষামূলক ই-টিকেটিং ব্যবস্থা চালু করা হয়। বাস মালিক সমিতির কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী রাজধানীর ৬০টি প্রতিষ্ঠানের সব বাস ই-টিকিটের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া আশপাশের জেলায় পাঁচ হাজার ৬৫০টি বাস চলাচল করে। শুধু রাজধানীর মেট্রো এলাকায় চলাচল করে তিন হাজার ১৪টি বাস।

বাসে ই-টিকিটের কার্যকারিতা প্রসঙ্গে কথা বলতে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের সঙ্গে একাধিকবার টেলিফোনে চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি।

https://www.kalerkantho.com/online/national/2023/10/02/1323093