২ অক্টোবর ২০২৩, সোমবার, ১২:৪৯

অপরাধ আদালত এবং মানুষের নিরাপত্তা

-আশিকুল হামিদ

ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে আজকাল এমন অনেক খবরই দেখা ও জানা যায়, যেগুলো টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে সাধারণত দেখা বা জানা সম্ভব হয় না। ধরা যাক, কোনো ঘটনায় দেখা গেলো, একজন বৃদ্ধ সিএনজি চালককে প্রকাশ্য সড়কে কান ধরে উঠ-বোস করাচ্ছে দু’জন যুবক। কারণ সম্পর্কে জানানো হলো, ওই চালকের সিএনজি নাকি যুবক দু’জনের মোটর সাইকেলে ধাক্কা লাগিয়ে লক্ষ টাকার ক্ষতি করেছে! এরই শাস্তি হিসেবে বৃদ্ধ সিএনজি চালককে কান ধরে উঠ-বোস করিয়েছে যুবক দু’জন। দৃশ্যটি অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে এবং উপভোগও করেছে। দু’চারজনকে আবার মোবাইলে ভিডিও করতেও দেখা গেছে। কিন্তু কেউই প্রতিবাদ জানাতে এগিয়ে যায়নি। কারণ, অতি দাপুটে যুবক দু’জন ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জড়িত। সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস পায়নি কেউ।

কল্পিত হলেও এ ধরনের ঘটনা দেশে কিন্তু মাঝে-মধ্যেই ঘটে থাকে। এভাবে নিবন্ধের শুরু করার পেছনে বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও অনেক ঘটনা ঘটছে যেগুলো শুধু বেআইনি নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধও। কিন্তু কোনো ঘটনারই বিচার ও শাস্তি হওয়ার খবর জানা যাচ্ছে না।

উদাহরণ দেয়ার জন্য নিরাপত্তা হেফাজতে ধর্ষণ ও মৃত্যুর তথ্য উল্লেখ করা দরকার। কারণ, যে কোনো রাষ্ট্রে নিরাপত্তা হেফাজত বলতে এমন একটি আইনগত অবস্থানকে বোঝানো হয়, যেখানে নেয়া বা রাখা সব ব্যক্তিকেই সরকারের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হবে এবং যতো ভয়ংকর অপরাধের অভিযোগই থাকুক না কেন, তার ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালানো হবে না। এটাই নিরাপত্তা হেফাজতের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত বিধান। বাংলাদেশের সংবিধানেও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তাছাড়া ২০১৩ সালে নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন চালানো নিষিদ্ধ করে একটি আইন যেমন তৈরি ও বলবৎ করা হয়েছিল, তেমনি সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিরাও কয়েকটি পৃথক রায়ে নির্যাতন চালানোর বিরুদ্ধে নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। এখনও মাঝে মাঝে অমন নির্দেশনা দেয়া হয়।

অন্যদিকে বাংলাদেশের বাস্তব ক্ষেত্রে চলছে সম্পূর্ণ বিপরীত কর্মকান্ড। ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত আসামীরা তো বটেই, নির্যাতনের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছেন না এমনকি গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতারাও। প্রাসঙ্গিক একটি ঘটনা হিসেবে একজন নারীকে পালাক্রমে ধর্ষণের ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে, যে ঘটনাটি সারাদেশেই আলোচনার ঝড় তুলেছিল। পাঠকদেরও মনে পড়তে পারে, ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ২১ বছর বয়সী এক নারী যশোর থেকে ট্রেনে খুলনায় গিয়েছিল। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় ওই নারী তার স্বজনদের খোঁজে রেলস্টেশনের এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল। জিআরপি তথা রেলওয়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পরে জিআরপির ওসি এবং আরো চারজন পুলিশ সদস্য তাকে সারা রাত ভরে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরদিন তার হাতে পাঁচ বোতল ফেন্সিডিল ধরিয়ে দিয়ে মাদক চোরাচালানের অভিযোগে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়।

সেখানে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ওই নারী রাতের গণধর্ষণের কথা ফাঁস করে দেয়। বিচারক তাৎক্ষণিকভাবে তার ডাক্তারি পরীক্ষার নির্দেশ দেন। পরীক্ষায় গণধর্ষণের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে বিচারক ওই ওসিসহ জিআরপি সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। পরদিন প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছিল, কুষ্টিয়া সার্কেলের এএসপির নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশে জিআরপির ওসি এবং একজন এসআইকে ক্লোজড তথা চাকরিচ্যুত করেছে সরকার। ধর্ষণের শিকার নারী এবং তার আত্মীয়-স্বজনদের বক্তব্য ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন তদন্ত কমিটির প্রধান। বাস্তবে ঠিক কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল অথবা আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কি নাÑ সে সম্পর্কে অবশ্য কিছুই জানা সম্ভব হয়নি। কারণ, এটাই এখন বাংলাদেশের নিয়ম এবং আইনে পরিণত হয়েছে!

বলার অপেক্ষা রাখে না, বিষয়টি শুধু গুরুতর নয়, সকল বিবেচনায় আপত্তিজনকও বটে। কারণ, ওই সময়ের আগে পর্যন্ত বাস ও ট্রেনসহ যানবাহনে নারী ধর্ষণের, এমনকি ধর্ষণের পর ধর্ষিতা নারীকে হত্যা করার খবরও শোনা গেছে। কিন্তু সেবার পুলিশের নিরাপত্তা হেফাজতে নারী ধর্ষণের খবর জানা গিয়েছিল। ধর্ষণও করেছিল জিআরপির ওসিসহ অন্য চারজন সদস্য। এই অপরাধ নিঃসন্দেহে ভয়ংকর তো বটেই, ক্ষমারও অযোগ্য। কারণ, প্রথমত, কোনো অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও একজন নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল; দ্বিতীয়ত জিআরপির ওসি তার চার সঙ্গিসহ সারারাত ভরে ওই নারীকে ধর্ষণ করেছিল; এবং তৃতীয়ত, নিজেদের অপরাধ আড়াল করার জন্য ফেন্সিডিলের পাঁচটি বোতল হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা চালানো হয়েছিল। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের যদি সন্দেহ না হতো এবং তিনি যদি ওই নারীর ডাক্তারি পরীক্ষার ব্যবস্থা না করাতেন তাহলে একজন নিরীহ নারীকে কারাগারে যেতে হতো। সাজানো মামলায় তার সাজাও হতে পারতো।

এখানে একটিমাত্র ঘটনার উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়মিতভাবেই নানামুখী নির্যাতন চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় শত শত মানুষের মৃত্যুও ঘটেছে। অথচ জাতিসংঘের বিধানে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু সম্পূর্ণরূপে বেআইনি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধানেও বলা আছে, দেশে যদি যুদ্ধাবস্থাও বিদ্যমান থাকে এবং আটক ব্যক্তি যদি একজন সন্ত্রাসীও হয় তবু নিরপত্তা হেফাজতে তার ওপর কোনো নির্যাতন চালানো যাবে না। স্মরণ করা দরকার, খুলনার নারী ধর্ষণের ওই ঘটনা নিয়ে সে সময় বিবিসিহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। এসবের প্রতিটিতেই নিন্দিত ও সমালোচিত হয়েছিল সরকার।

বলা দরকার, এ ধরনের কোনো রিপোর্টই বাংলাদেশ এবং সরকারের পক্ষে যায় না। থানার ভেতরে গণধর্ষণ থেকে বন্দিদের ওপর বেআইনিভাবে নির্যাতন চালানো পর্যন্ত সব ধরনের বেআইনি কর্মকান্ড অবশ্যই বন্ধ করা দরকার। সেই সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া দরকারÑ তা তারা যতো বড়ো অফিসারই হোন না কেন। না হলে বাংলাদেশ একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পাবে এবং নিন্দিত হবে।

এবার অন্য ধরনের এক ভয়ংকর অপরাধের ঘটনা। পাঠকদের মনে পড়তে পারে, খুনের এই অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল কুমিল্লা আদালতের এজলাসে এবং একজন বিচারকের সামনে। গণমাধ্যমের খবরে জানা গিয়েছিল, ২০২১ সালের আগস্ট মাসের একদিন কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ও তৃতীয় দায়রা জজ আদালতে একটি হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলার সময় ওই মামলার হাসান নামের এক আসামী হঠাৎ একই মামলার অন্য আসামী ফারুকের ওপর ছুরি দিয়ে হামলা চালায়। ধাওয়া খেয়ে আসামী ফারুক দৌড়ে গিয়ে বিচারকের খাস কামরায় ঢুকে পড়ে। সেখানে তখন নারী বিচারক তার চেয়ারে উপবিষ্ট ছিলেন। কিন্তু হামলাকারী হাসান সেই বিচারকের সামনেই আসামী ফারুককে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। আক্রান্ত ফারুক প্রথমে বিচারকের টেবিলের ওপর এবং পরে কক্ষের মেঝেতে পড়ে যায়। পুলিশ এসে হামলাকারীকে নিবৃত্ত ও গ্রেফতার করলেও আক্রান্ত ফারুককে বাঁচানো যায়নি। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেছিলেন।

উল্লেখ্য, হামলাকারী হাসান এবং আক্রান্ত ও পরে নিহত ফারুক দু’জনই ২০১৩ সালে কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জের একটি হত্যা মামলার আসামী ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিল, উপস্থিত সকলের মনোযোগ যখন অন্য এক মামলার চলমান শুনানির প্রতি ঠিক তখনই মামলার চার নম্বর আসামী হাসান হঠাৎ আট নম্বর আসামী ফারুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। ভয়ে বিচারকের খাস কামরায় পালিয়ে গেলেও আসামী ফারুক তার জীবন বাঁচাতে পারেনি।

আদালতের এজলাসে একজন বিচারকের খাস কামরায় সংঘটিত এ হত্যাকান্ডটি নিয়ে জনমনে একই সঙ্গে বিস্ময় ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। একাধিক হত্যা মামলা উপলক্ষে যথেষ্ট সংখ্যক পুলিশ উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও একজন খুনের মামলার আসামী কিভাবে আদালতে ছুরি নিয়ে প্রবেশ করতে এবং অন্য এক আসামীর ওপর হামলা চালাতে পারলো সে প্রশ্নই বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছিল। বিচারক বেগম ফাতেমা ফেরদৌস সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমার সামনে একজন আসামীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হলো। তাহলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়?’

একই ধরনের প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনেও ঘুরে-ফিরে উঠেছিল। আদালতের ভীত ও ক্ষুব্ধ আইনজীবীরা বলেছিলেন, পৃথিবীর আর কোনো দেশের আদালত প্রাঙ্গনে এত দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে বলে তাদের জানা নেই।

বলার অপেক্ষা রাখে না, কুমিল্লার আদালতের এজলাসে সংঘটিত হত্যাকান্ডটিকে হাল্কাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ঘাতক হাসান শুধু একই মামলার অন্য এক আসামীকে হত্যা করেনি, করেছেও আদালতের এজলাসে। বড়কথা, নিহত আসামী বিচারকের খাস কামরায় ঢুকে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল। বিচারকের সামনেই তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেছিল ঘাতক হাসান। এর মধ্য দিয়ে সে শুধু আদালতই আবমাননা করেনি, মাননীয় বিচারকের জীবনকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল। সেজন্যই নারী বিচারক জানতে চেয়েছিলেন, তাদের নিরাপত্তা কোথায়?

গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি পর্যবেক্ষকরা সে সময় বলেছিলেন, এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। কারণ, আদালত যে কোনো দেশে জননিরাপত্তার প্রধান স্থান। সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল। অন্যদিকে সে আদালতের এজলাসেই সকলের চোখের সামনে একটি ভয়ংকর হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল। আক্রান্ত হতে হতে বেঁচে গিয়েছিলেন এমনকি বিচারক নিজেও!

সে সময় পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন, সরকারের উচিত আদালতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যাপারে তৎপর হয়ে ওঠা এবং বাদী, আসামী, সাক্ষী, আইনজীবী ও বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

সরকারকে একই সঙ্গে পুলিশের গাফিলতির ব্যপারেও তদন্তসাপেক্ষে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে দেশের আর কোনো আদালতে কুমিল্লার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে না পারে।

এই নিবন্ধে তিনটি পৃথক ঘটনার উল্লেখ করা হলেও এসবের মধ্য দিয়ে দেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আসলে ভয়ংকর নৈরাজ্য চলছে। মানুষের জীবন হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। এজন্যই সরকারের পক্ষ থেকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

https://www.dailysangram.info/post/536888