১ অক্টোবর ২০২৩, রবিবার, ৩:১৫

রিজার্ভের পতন কেন থামছে না

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় ধারাবাহিকভাবে কমছে দেশের রিজার্ভ। রিজার্ভের পতন ঠেকাতে বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বহুমুখী সিদ্ধান্ত সহ নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করছে। কিন্তু বাস্তবে এর সুফল মিলছে না। উল্টো ডলারের সংকটকে আরও প্রকট করে তুলছে। এতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়াচ্ছে।

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ সামলাতে হচ্ছে সরকারকে। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে ঋণ শোধ করার ধারা অব্যাহত থাকায় রিজার্ভের ক্ষয় মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ রাখার শর্ত দিয়েছিল। বর্তমানে তারচেয়ে কম রিজার্ভ রয়েছে। বর্তমানে যে গ্রস রিজার্ভ রয়েছে, তা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
রেমিট্যান্সের নিম্নমুখী প্রবাহ এ পতনকে আরও বেগবান করেছে। এতে চলতি মাসে ২৬ দিনেই রিজার্ভ কমেছে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রিজার্ভের পতন শিগগিরই কমার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সুত্র মতে, বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক অনুদান থেকে। এই ৪ খাতেই আয়ের ধারা নিম্নমুখী। দেশে গত বছরের এপ্রিল থেকে ডলারের সংকট শুরু হয়। ফলে ডলারের দাম ৮৮ টাকা থেকে বেড়ে ১১০.৫০ টাকা হয়েছে। ব্যাংকের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম প্রায় ৭ থেকে ৮ টাকা বেশি। ফলে রেমিট্যান্সের বড় অংশ চলে যাচ্ছে হুন্ডিতে। মানি চেঞ্জার্স ও কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু করলে ওখানে ডলার লেনদেনে স্থবিরতা নেমে আসে। এখন কিছু লেনদেন হলেও দাম ১১৮ থেকে ১১৯ টাকা। এতে ডলারের প্রবাহ তো বাড়েইনি। বরং কমে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করেন, বর্তমানে যে পদ্ধতিতে ডলারের দাম বাড়তে না দিয়ে স্থানীয় মুদ্রা টাকাকে শক্তিশালী করে রাখা হয়েছে, তাতে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। এই নীতি কোনোভাবেই কার্যকর হচ্ছে না। শীর্ষ কর্মকর্তারা বিষয়টি মানতে চাইছেন না, ফলে রিজার্ভেরও পতন ঠেকানো যাচ্ছে না।

ডলারের প্রবাহ বাড়ছে না যে কারণে: ডলারের প্রবাহ বাড়াতে হলে রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে। সেটি সম্ভব হচ্ছে না। রপ্তানি আয় কমছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়েছিল ৩৪.৩৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে বৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬.৬৭ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ।

গত ৩ মাসের হিসাবে রেমিট্যান্স এসেছে ৫৭৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে বেড়েছিল ১২.২৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বাড়ার পরিবর্তে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৩.৫৬ শতাংশ।

বৈদেশিক অনুদানের গতিও নিম্নমুখী: ২০২১-২২ অর্থবছরে অনুদান বেড়েছিল ৫১.৭৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে বাড়ার পরিবর্তে বরং কমেছে সাড়ে ১১ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাইয়ে বেড়েছিল ৮৪.৩৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমেছে ৩৩.১৩ শতাংশ। জুন ও জুলাইয়ে অনুদান এসেছে মাত্র ৩২ কোটি ডলার।

বৈদেশিক বিনিয়োগ ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ১৮৩ কোটি ডলার, গত অর্থবছরে এসেছে ১৬১ কোটি ডলার। তবে জুলাইয়ে বিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছে। গত বছরের ওই সময়ে ১৭ কোটি ও চলতি বছরের একই সময়ে এসেছে ১৮ কোটি ডলার। বিপরীতে শেয়ারবাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগ তুলে নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে।

এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচের মধ্যে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার পরও তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে শুরু করেছে। ফলে এ খাতে ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রায় আরও চাপে পড়বে।
এ ছাড়া বিদেশি কোম্পানিগুলোর মুনাফা নেয়া, রয়্যালটি পরিশোধ, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের অর্থ নেয়া বাবদ আরও ডলার খরচ হচ্ছে। এর বাইরে স্থগিত ঋণ ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আরও কমপক্ষে ৬০০ কোটি ডলার শোধ করতে হবে। এসব মিলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণও কমে গেছে। এ কারণেও ডলারের প্রবাহ বাড়ছে না। আগে বৈদেশিক ঋণের সুদের হার ছিল কম। এখন বেড়ে যাওয়ায় চড়া সুদে কেউ ঋণ নিতে চাচ্ছে না।

ইআরডি সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসেই (জুলাই) কমেছে বৈদেশিক সহায়তা অর্থ ছাড়ের পরিমাণ। এ মাসে উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ৪০ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছাড় হয়েছিল ৪৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার। পাশাপাশি জুলাইয়ে বাংলাদেশ সুদ-আসলে পরিশোধ করেছে ২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে একই সময় বাংলাদেশ পরিশোধ করেছে ১৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরের এক মাসে বেশি পরিশোধ করা হয়েছে ৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বছরে এখন প্রায় ৩৫০ কোটি ডলারের মতো পরিশোধ করা হচ্ছে। কিন্তু ২০২৬ সালের পর এটি বেড়ে গিয়ে দাঁড়াতে পারে সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলারে। কিন্তু সেই তুলনায় যদি বৈদেশিক মুদ্রার আয় না বাড়ে তাহলে জটিলতা সৃষ্টি হবে।

২০২১ সালের আগস্টে করোনাকালীন সময়ে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, আমদানি হ্রাস ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমে গেলে রিজার্ভ সর্বোচ্চ গ্রস ৪৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে ওঠেছিল। এখন তা কমে গ্রস হিসাবে ২ হাজার ৭০৬ কোটি ডলার ও নিট হিসাবে ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলারে নেমেছে। যা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় ৩ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। রিজার্ভের নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থাকায় আমদানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে।

মূলত গত জুন থেকে আইএমএফের প্রেসক্রিপশন মেনে গ্রসের পাশাপাশি ব্যালেন্স অব পেমেন্ট-৬ বা বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে মোট (গ্রস) রিজার্ভ থেকে ইডিএফ (রপ্তানি বহুমুখীকরণ তহবিল), আইডিএফ (অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল) ও শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশকে দেয়া ঋণ বাদ দিয়ে নিট রিজার্ভের হিসাব করা হয়।
২৬শে সেপ্টেম্বর দেশে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় গ্রস ২৭.০৬ বিলিয়ন ডলার ও নিট ২১.১৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও গত কয়েক মাসে

শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেশটি সুদসহ পরিশোধ করেছে, যা রিজার্ভের নিট হিসাবে যোগ করা হয়েছে। এরপরও সেপ্টেম্বর শেষে আইএমএফ শর্ত মেনে রিজার্ভ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফের ঋণের শর্ত অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে প্রকৃত রিজার্ভ ২৫.৩২ বিলিয়ন ডলার রাখার কথা ছিল। তবে রয়েছে তার চেয়ে ৪.১৭ বিলিয়ন ডলার কম।

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের গতি ভালো নয়। প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতেই হবে। এতে করে রিজার্ভ আরও হ্রাস হবে। তবে রিজার্ভ বাড়ানোর তেমন কোনো উদ্দ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ডলারে আয় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উৎস খুঁজে বের করতে হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=76492