১ অক্টোবর ২০২৩, রবিবার, ৩:১০

গোশত আমদানি সমাধান নয়

প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্টদের অভিমত

রাজধানীতে হোটেল-রেঁস্তোরায় বিক্রি হচ্ছে মহিষের সিদ্ধ গোশত। কাঁচা গোশত আমদানি করতে না পেরে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী সিদ্ধ গোশত আমদানির ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিদ্ধ করা গোশতের মার্কেট জমে উঠেছে। তবে, এবার হিমায়িত মহিষের গোশত আমদানির অনুমতির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আইবিসিসিআই)। ভারত থেকে আগামী তিন মাসে ৫০ লাখ টন মহিষের গোশত আমদানির অনুমতি চেয়েছে তারা। হিমায়িত মহিষের গোশত আমদানির অনুমতি দিলে দেশে গোশতের দাম কমবে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে, প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিমায়িত গোশত আমদানিতে বাজারে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। বরং গত প্রায় অর্ধযুগ ধরে দেশে প্রাণিসম্পদ খাতে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন হয়েছে তাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। লোকসানে পড়বেন উদ্যোক্তা ও খামারিরা। আমদানি ছাড়াও দেশীয় গবাদিপশু দিয়েও ন্যায্যমূল্যে গরুর গোশত খাওয়ানো সম্ভব বলে মনে করেন বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান হোসেন। গোশত আমদানি করে দাম কমানোতে স্থায়ী সমাধান আসবে না বলে মনে করেন প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্টরা।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে, দেশে চাহিদার চেয়ে গোশত উৎপাদন প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন বেশি রয়েছে। প্রতিজনের দৈনিক ১২০ গ্রাম গোশতের চাহিদা থাকলেও বর্তমানে ১৩৭ দশমিক ৩৮ গ্রাম খাচ্ছে মানুষ। দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩৭ লাখ ধরে এই হিসাব দিয়েছে সরকারি এই সংস্থাটি। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে, প্রতিজনের চাহিদা ১২০ গ্রাম ধরে দেশে এই মুহূর্তে গোশতের চাহিদা (গরুসহ অন্যান্য গবাদিপশু) ৭৬ লাখ আট হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদন হচ্ছে ৮৭ লাখ ১০ হাজার টন। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিচালক (উৎপাদন) ডা: এ বি এম খালেদুজ্জামান জানান, অনেক উন্নত দেশে দৈনিক জনপ্রতি ২০০ গ্রাম গোশত খায়। আমরা এখন ১২০ গ্রাম ধরছি। ২০৩০ সালে হয়তো ১৫০ গ্রাম ধরব। ২০৪১ সালে হয়তো আরো বাড়বে। ন্যূনতম ১২০ গ্রাম চাহিদা ধরে বার্ষিক উৎপাদন বেশি আছে। আমরা গোশত উৎপাদনে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। হিমায়িত গোশত আমদানি নিরুৎসাহিত করি আমরা।

এই কর্মকর্তা বলেন, বিগত চার-পাঁচ বছর ধরে দেশীয় উৎস থেকেই কোরবানির চাহিদা মেটানো হচ্ছে। কয়েক লাখ গবাদিপশু অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। আমরা গোশত (গরু) উৎপাদনের একটা খরচ বের করেছি। প্রতি কেজি উৎপাদন খরচ সাড়ে ৫০০ টাকার কাছাকাছি। এর সাথে ট্রান্সপোর্টসহ অন্যান্য খরচ যোগ হয়। বাজারে গোশতের দাম কমাতে আমাদের চেষ্টা চলছে। এই ব্যয় বাড়ানোর প্রধান কারণ হচ্ছে গো খাদ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি। গো খাদ্যের উপাদান ভুট্টা ও সয়াবিনসহ অন্যান্য উপাদান বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। এখনো আমরা আমদানিকৃত খাদ্যের (গোখাদ্য) ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, ভারত যখন ২০১৫ সালের দিকে বাংলাদেশে গরু রফতানি বন্ধ করে দেয় তখন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর লোকাল যুবক শ্রেণীকে পশু পালনে আগ্রহী করে তুলি, প্রশিক্ষিত করি। ২০১৫ সালের দিকে গরু হৃষ্টপুষ্টের সাথে জড়িত খামারির সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখের মতো। এখন এটা প্রায় সাত লাখ। এরা হচ্ছে সিজনাল। কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে গরু হৃষ্টপুষ্ট করে। আর সারা বছর গরু লালন-পালন করে এ সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ।

প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিমায়িত মহিষের গোশত প্রতিবেশী দেশ থেকে নানা পন্থায় দেশে ঢুকছে। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশির ভাগ হোটেল-রেস্তোর্রায় এই গোশত রান্না হচ্ছে। এ অবস্থায় ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আইবিসিসিআই) ‘হিমায়িত হালাল মহিষের গোশত’ আমদানির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে। হিমায়িত এই গোশত সাধারণ জনগণ ওইভাবে গ্রহণ করবে না। এরপরও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা বিগত কয়েক বছর ধরে হিমায়িত এই গোশত আমদানিতে নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা: মোহাম্মদ রেয়াজুল হক চট্টগ্রামে কর্মরত থাকা অবস্থায় কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ফাইটোস্যানিটেশন সার্টিফিকেট প্রদানের মাধ্যমে আমদানিকারকদের গোশত আমদানির সুযোগ করে দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তার পদে (চট্টগ্রাম ডিএলও) আসা ডা: দেলোয়ার হোসেনও একই পথে হেঁটে ওএসডি হন বলে জানা যায়। যদিও ডা: মোহাম্মদ রেয়াজুল হক এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।

বাংলাদেশ মিট ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমআইটিএ) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফ্রোজেন মিটের প্রধান গ্রাহক প্রান্তিক শ্রেণীর ক্রেতারা। এ ছাড়া বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্ট ফ্রোজেন মিটগুলোর ক্রেতা। গার্মেন্টে একসময় সপ্তাহে দু’দিন আমদানি গোশত খাওয়ানো হতো। অথচ এখন আমদানি বন্ধ থাকার ফলে দাম যেমন বাড়ছে, আবার দেশের পুষ্টি নিরাপত্তাও হুমকিতে পড়েছে। গ্লোবাল প্রোডাক্ট প্রাইজ নামের একটি ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, দাম বৃদ্ধির দিক থেকে ৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম। দেশের বাজারে গরুর গোশতের সঙ্কট নেই। তবে গত এক বছরে পশুখাদ্যের দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। এ ছাড়া সার্বিক উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও বেশি গোশত উৎপাদনকারী উন্নত প্রজাতির গরু না থাকায় বাজারে গরুর গোশতের দাম কমছে না। তারপরও আমাদের খামারিরা গত জুলাই থেকে বাজারের চেয়ে ৫০ টাকা কমে গোশত বিক্রি করছেন।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, বর্তমানে ঢাকায় গরুর গোশত বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৭৮০ টাকা কেজি দরে। খামারি এবং উদ্যোক্তারা বলছেন, দুই বছর বয়সী একটা দেশী গরু আরসিসি, নর্থ বেঙ্গল, গ্রে, শাহীওয়াল থেকে সর্বোচ্চ ১২০-১৫০ কেজি পর্যন্ত গোশত পাওয়া যায়। যেখানে গোশতের জাত হিসেবে পরিচিত ব্রাহমাতে যেতে পারলে একই সময়ে ২৫০-৩০০ কেজি পর্যন্ত গোশত পাওয়া সম্ভব, যেটা উৎপাদন খরচকেও কমিয়ে আনবে। কারণ দেশী জাতের এক কেজি গোশত উৎপাদনে ১২-১৩ কেজি খাবার দরকার, যেখানে ব্রাহমার এক কেজি গোশত উৎপাদনে পাঁচ-ছয় কেজি খাবার প্রয়োজন। তারা বলছেন, প্রসেস ফিডের ইনগ্রেডিয়েন্ট বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আমদানির নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে স্থানীয়ভাবে উন্নতজাতের ঘাস চাষ ও সাইলেজ তৈরির মাধ্যমে বিকল্প খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারলে দাম কমিয়ে আনা সম্ভব।

ফসলের উচ্ছৃষ্টাংশ যেমন ধানের খড়, ভৃট্টাগাছের কাণ্ড, বিভিন্ন ডালের গাছ, কলাগাছসহ অন্য সবধরনের ফসলের বাইপ্রোডাক্ট প্রকৃয়িজাতের মাধ্যমে উচ্চমানের গো-খাদ্য তৈরি করা সম্ভব। দানাদার খাদ্যের পরিবর্তে চাষিরা কিভাবে এই খাবার কম খরচে প্রস্তুত করা যায় সে বিষয়ে খামারিদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে পারলে কম দামে বিকল্প খাদ্য পাওয়া সম্ভব, যা গোশতের দামে প্রভাব ফেলবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলে আসছে, দেশে পর্যাপ্ত গরু-ছাগল রয়েছে। কোনো সঙ্কট নেই। গোশত আমদানিতে বরাবরই তারা নিরুৎসাহিত করে আসছেন।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/780904