৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৭:০৮

গণতন্ত্রে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার

মো: হারুন-অর-রশিদ

২০০৮ সালের পর থেকে দেশে গণতান্ত্রিক সঙ্কট ক্রমে আরো গভীর হচ্ছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের অপরিহার্যতা গণতন্ত্রে সবচেয়ে বেশি হলেও আমাদের দেশে তা অগ্রাহ্য হয়েছে। এই সরকারের সময় বিচার বিভাগ ব্যাপক বিতর্কিত হয়েছে। শাসকের কর্তৃত্ববাদী মনোভাব রাষ্ট্রযন্ত্রকে যখন জবাবদিহিহীন জায়গায় নিয়ে যায় তখন রাষ্ট্রের সব অঙ্গ হুকুমের অনুগত হয়। প্রতিপক্ষকে দমনে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ‘বিচার বিভাগকে’ সরকার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এই কারণে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থায় অনেক বিচারক শাসকের খেয়ালখুশিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। অনেকে শপথ ভঙ্গ করে বিচারকাজকে কলুষিত করেন।

গণতন্ত্রকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে আইনের শাসনের বিকল্প নেই। বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রে আইনের শাসন বলতে অবশিষ্ট কোনো কিছু নেই। সব কিছু কর্তৃত্ববাদীর ইশারায় পরিচালিত হয়। যেখানে আইনের শাসন বলছে, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী নয়; বরং স্বাভাবিক আইন অনুযায়ী সরকার ও নাগরিকের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হবে; সেখানে বর্তমান চিত্র হচ্ছে আইন নয়, সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হয় শাসকের ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। ইংল্যান্ডের পণ্ডিত এ ভি ডাইসির দৃষ্টিতে আইনের শাসনের মূলনীতি হলো- ১. কোনো ব্যক্তি স্পষ্টত আইন লঙ্ঘন করেছে বলে দেশের সাধারণ আদালতে সাধারণ আইনগত প্রক্রিয়ায় প্রমাণিত না হলে তাকে শাস্তি দান বা আটক করা যাবে না; ২. আইনের চোখে সবাই সমান অথবা সব শ্রেণীর নাগরিক সমানভাবে সাধারণ আদালতের এখতিয়ারের অধীন। আইনের শাসনের এই নীতির পুরোপুরি বিপরীতে চলছে আজকের বাংলাদেশ। অথচ আইনের শাসন হচ্ছে গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি।

দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, প্রকাশ্য দুর্নীতিতে সয়লাব হয়ে গেছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকে পিয়ন-চাপরাশি পর্যন্ত। এগুলো সব দৃশ্যমান। অপরাধীরা বিচারের আওতায় আসছে না। তবে কোনো অপরাধ না করেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিচারের কাঠগড়ায়। সাজা হচ্ছে নিরপরাধীদের। বিচার বিভাগের প্রতি সঙ্গত কারণেই মানুষের আস্থা শূন্যের কোঠায় যাচ্ছে।

সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই দেশের অনেক ব্যবসায়ী ও এমপি, মন্ত্রী, আমলারা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে ব্যাংক শূন্য করে দিচ্ছেন। গণমাধ্যমে তাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের চিত্র প্রকাশ করা হলেও আইন-আদালত তাদের স্পর্শ করতে পারছে না। অথচ পদ্ধতিগত ভুলে এক অ্যাকাউন্টের টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয়ে তা সুদাসলে দুই কোটির জায়গায় ছয় কোটি টাকা হয়েছে এবং সেই টাকার একটি টাকাও তছরুপ হয়নি, তেমন একটি মামলায় সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী সাজা পেয়ে গেলেন। প্রমাণিত হয়েছে, এই রাষ্ট্রে আইনের চোখে সবাই সমান না। সাংবিধানিক ও বিচারিক আইন সরকারের লোকদের স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখে না। এই দেশের আইন-আদালত কেবল বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমনের হাতিয়ার।

যেখানে বছরের পর বছর ঘুরেও বিচারপ্রার্থী একটি মামলার রায় নিতে পারেন না, সেখানে বিরোধী দলকে দমন করার জন্য খরগোশের গতিতে বিচারকার্য পরিচালনা করা হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্র্মীরা যেনতেনভাবে সাজা পেয়ে যাচ্ছে। এভাবে সরকারের খায়েশ পূরণ করতে গিয়ে বিচারব্যবস্থাকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের মনে সন্দেহ জন্ম নিয়েছে, যখন অনেক দাগি অপরাধী এমনকি নিষ্ঠুর হন্তারককেও মুক্তি দেয়া হচ্ছে সেখানে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে চিকিৎসা করার জন্য বিদেশ পর্যন্ত যেতে দিচ্ছে না। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমন করা হয় পুলিশবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে। গণতান্ত্রিক কাঠামো থেকে রাষ্ট্রকে ফ্যাসিজমের মোড়কে ঢেকে ফেলার কারণে অপশাসনের এই চিত্র জনগণকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

আইনের শাসন নাগরিককে সুরক্ষা দেয়। অর্থাৎ বিনাবিচারে কাউকে আটক করা যাবে না। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে গায়েবি মামলা দিয়ে একজন ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে দিনের পর দিন কারাগারে আটক রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। আদালতের কাছে জামিন চাইলে সরকারের ইশারা ব্যতীত আদালতও জামিন দেন না। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে- ২০১৮ সালে রাতের আঁধারে মৃত ব্যক্তি যেমন ভোট দিতে এসেছিল; তেমনি তারা গায়েবি মামলার আসামি থেকেও বাদ যাচ্ছে না। আসামির খোঁজে মৃত ব্যক্তির পরিবারকেও নির্যাতন করা হয়। প্রহসনের এ ব্যবস্থা কেবল বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশলমাত্র। এভাবে একটি রাষ্ট্রের জনগণকে রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ রাষ্ট্রের পুলিশবাহিনী মানছে না। কারণ তাদের গোড়ার শক্তি হচ্ছে স্বয়ং সরকারের মদদ। যার কারণে বর্তমান সময়ের প্রকৃত চিত্র হলো- দেশে চলছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। রাজনৈতিক বিবেচনায় অপরাধীকে মুক্তি আর নিরপরাধ মানুষকে সাজা দিতে সহযোগিতা দেয়ার কারণে প্রশাসন ও পুলিশ আস্থাহীন হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের শাসক, বিচার বিভাগের বিচারক, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী, সবাইকে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ন্যায়সঙ্গত পালন না করলে এর যে একটা দায়বদ্ধতা আছে তার কোনো তাগিদ দেখা যায় না। এছাড়া তাদের যে পরকালীন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এব্যাপারে তাদের একেবারেই কোনো বোধ নেই। মহান আল্লাহ বলেন- ‘হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, তাই তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার করো এবং খেয়ালখুশির অনুসরণ করো না, করলে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করব; আল্লøাহর পথচ্যুতদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি, কারণ তারা বিচার দিনকে ভুলে থাকে।’ (সূরা সোয়াদ-২৬)

অনেক বিচারক আছেন যারা লোভের বশবর্তী হয়ে একটি অপশক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে বশীভূত হচ্ছেন তাদের ইহকালীন পরিণতিও আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে আছে। যাদের খেয়ালখুশির দাসত্ব স্বীকার করে বিচারকের আসনে বসে মানুষের ওপর জুলুম করেছেন, অন্যায়ভাবে শাস্তি দিয়েছেন, সেই অপশক্তি দ্বারাই অপমানিত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। দার্শনিক সক্রেটিসকে যারা অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল, সক্রেটিসের মৃত্যুর পর জনরোষে সেই বিচারকদের করুণ পরিণতি সম্পর্কে আমাদের অনেকে সম্ভবত জানেন না।
অধিকার হরণকারী শক্তি সবসময়ই দাম্ভিকতার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এরপর প্রাকৃতিক নিয়মে তাদের ওপর ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসে। ফেরাউন-নমরুদ থেকে শুরু করে আধুনিককালের হিটলার, মুসোলিনিসহ বহু জনের শেষ পরিণতি দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের সামনে আছে।

কাজেই আজকে যারা বিচারকের আসনে বসে বিচার করছেন তাদের মনে রাখা দরকার, কর্তৃত্ববাদের ইশারায় তারা যে রায় দিচ্ছেন, কোনো একদিন সেই রায় আজকের রায়ের বিপরীত হতে পারে। যেমন মৃত্যুদণ্ড দেয়ার দুই হাজার ৪১৫ বছর পর অ্যাথেন্সের আদালত রায় দিয়েছে যে, দার্শনিক সক্রেটিস ছিলেন নিরপরাধ, নির্দোষ। তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ ছিল মিথ্যে ও সাজানো। সক্রেটিসের প্রহসনের বিচারে মৃত্যুদণ্ডের এত শত বছর পর মরণোত্তর বিচারে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলেন। প্রশ্নবিদ্ধ হলো সে দিনের শাসন ও বিচারব্যবস্থা।
পরিশেষে বলতে চাই,গণতন্ত্রকে ফুলে-ফলে প্রস্ফুটিত করার জন্য বিচার বিভাগ অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ, গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান ন্যায়বিচার। এর ফলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই বিচারকদের উচিত শপথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। তাতে দেশ ও জনগণ উভয়ই উপকৃত হবে।
harun_980@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/780612