১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৩:১৮

পুলিশ ও ছাত্রলীগ : ক্ষমতাসীনরা আক্রান্ত বলেই কি দ্রুত ব্যবস্থা?

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ ও পুলিশের এক কর্মকর্তার মারামারির ঘটনায় তোলপাড় চলছে। এরই মধ্যে পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে আইন শৃংখলা বাহিনী ও ছাত্রলীগের মধ্যে অসন্তোষ, চাপান উতোন চলছে। এই ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি বাংলা ‘পুলিশ ও ছাত্রলীগ : ক্ষমতাসীনরা আক্রান্ত বলেই কি দ্রুত ব্যবস্থা?’ শীর্ষক এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ইনকিলাব পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো।

বিবিসির খবরে বলা হয়, বাংলাদেশে সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দুই নেতাকে পেটানোর ঘটনা নিয়ে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত আছে। যদিও সেই পুলিশ কর্মকতা হারুন অর রশিদকে ইতোমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন এই ঘটনার একটি ভিন্ন দিক আছে। সেটি হচ্ছে- শুধু ক্ষমতাসীন দলের সাথে সংশ্লিস্ট কেউ নির্যাতনের শিকার হলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়।

পুলিশ অবশ্য বলছে, ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন বা সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন ধরণের বিভেদ করা হয় না। বরং নির্যাতনের শিকার মানুষের পক্ষেই কাজ করে পুলিশ।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার-এডিসি হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে গত ৯ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদকে ‘থানায় নিয়ে’ ব্যাপক মারধরের অভিযোগ ওঠে। এর জের ধরে গত ১১ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, হারুন অর রশিদকে জনস্বার্থে সরকারি কাজ থেকে বিরত রাখা আবশ্যক ও সমীচীন। তবে সম্প্রতি ছাত্রলীগ নেতাদের মারধর করার এই অভিযোগ ছাড়াও মি. রশিদের বিরুদ্ধে এর আগে মারধরের আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, গত ৭ অগাস্ট জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে শাহবাগে একটি প্রতিবাদ কর্মসূচিতে লাঠিপেটা করে পুলিশ। যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এডিসি হারুন। ২০২২ সালের ১৮ এপ্রিল নিজের সহকর্মীকে চড় মেরে সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সাথে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে তিনি রাবার বুলেট ছোড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেময় তার সহকর্মী এক পুলিশ কনস্টেবল ‘গুলি শেষ হয়ে গেছে’ বলায় তাকে চড় মারলে সমালোচনা তৈরি হয়। ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুতে বিচার চেয়ে কয়েকটি বাম সংগঠনের আয়োজিত মশাল মিছিলে লাঠিপেটা করে পুলিশ। সেটিরও নেতৃত্বে ছিলেন এডিসি হারুন অর রশিদ। এছাড়া তিনি নিজেই বিক্ষোভকারীদের লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছেন এমন ভিডিও এবং ছবি বিভিন্ন সময় স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তবে সেসব ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ ঘটনা (ছাত্রলীগকে পেটানোর ঘটনা) প্রথম উল্লেখযোগ্যভাবে এসেছে। আমরা এটা দেখে নিই। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি, অবশ্যই তিনি যতখানি অন্যায় করেছেন, ততখানি শাস্তি তিনি পাবেন।’

বিভিন্ন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নির্যাতনের নানা অভিযোগ এবং নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ক্ষমতাধর না হলে সেগুলোতে পার পেয়ে যাওয়ার ঘটনা আসলে নতুন কিছু নয়।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। বহুল আলোচিত এই হত্যাকা-ের দায়ে পুলিশের বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ দুজনকে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি মৃত্যুদ-ের সাজা দেয়া হয়। তবে মেজর সিনহাকে হত্যাকা-ের আগে থেকেই একাধিক ক্রস ফায়ার আর কঠোরতার জন্য আলোচনায় এসেছিলেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। কিন্তু সেগুলোর কোনটিতেই তার বিরুদ্ধে তেমন কোন বড় ব্যবস্থা নেয়ার ঘটনা ঘটেনি। এ বিষয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে করা বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয়রা তখন বলেছিলেন, সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের আশীর্বাদ আর স্থানীয় কিছু রাজনীতিকের অন্ধ সমর্থন তাকে ওই এলাকায় বেপরোয়া করে তুলেছিলো।

ক্ষমতাধরদের ক্ষেত্রেই পদক্ষেপ : মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ কর্তৃক সাধারণ নাগরিক, বিরোধী দল, বিরোধী মতের উপর নির্যাতন এবং হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতনের অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা যায়। কিন্তু এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া বা পদক্ষেপ পুলিশ বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেখা যায় না। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘শাহবাগে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দু’জন নেতা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং পরবর্তীতে অল্প সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যখন সরকারি দলের কেউ, ক্ষমতাসীনদের কেউ নির্যাতনের শিকার হয় সেক্ষেত্রে আমরা খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে দেখি। অথবা যেসমস্ত ঘটনায় মানুষের ভিতর মারাত্মক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়, তখন আমরা কিছু পদক্ষেপ নিতে দেখি। কিন্তু এর বাইরে শত শত ঘটনা যে ঘটে, সেটি নিয়ে কিন্তু তাৎক্ষণিক কোন পদক্ষেপ নিতে দেখি না...। ভবিষ্যতে এ ধরণের ঘটনা আর ঘটবে না- কিছু পদক্ষেপ নিয়ে এরকম একটি বার্তা দিবে, তা কিন্তু আমরা দেখি না।’ তার মতে, সাময়িক বরখাস্তের মতো যে পদক্ষেপটি এসেছে সেটিও পর্যাপ্ত নয়। কারণ নির্যাতনের ঘটনাটি ফৌজদারি অপরাধ, যে বিষয়টিতে কোন পদক্ষেপ আসেনি।

ছাত্রলীগের নেতাদের পেটানোর ঘটনায় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে একটি দল গত ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করবে না ছাত্রলীগ কারণ তারা এ ঘটনায় ডিএমপির বিভাগীয় তদন্তের প্রতি আস্থা রাখতে চায়। এ সম্পর্কিত ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই শেয়ার করেন।

এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘এ ধরণের ঘটনা যখন ঘটে, তখন মানবাধিকার সংগঠনও যখন চেষ্টা করে তখনও কিন্তু এ ধরণের বৈঠক আমরা দেখি না। বরং এ ধরণের বৈঠক, ঘটনার গুরুত্ব অনুযায়ী, সব ধরণের মানুষের সাথে হওয়া উচিত।’

মামলা দায়েরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক ঘটনায় মীমাংসা সম্ভব হলেও অপরাধের ধরণ ভেদে কোন কোন ঘটনায় মীমাংসা সম্ভব না। এ ধরণের নির্যাতন ফৌজদারি অপরাধ হওয়ায় সেখানে পুলিশের স্ব-প্রণোদিত হয়ে মামলা দায়েরের সুযোগ ছিল যেটি করা হয়নি।’ তিনি মনে করেন, শুধুমাত্র সাময়িক বরখাস্তের মধ্য দিয়ে এ ধরণের ঘটনার নিরসন করা বা এ ধরণের ঘটনায় কঠোর বার্তা দেয়ার সুযোগ নেই।

যা বলছে পুলিশ : ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র মোঃ ফারুক হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, পুলিশ যেকোন ঘটনাতেই নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির পক্ষেই অবস্থান নেয়। ডিএমপিতে প্রতি মাসে প্রায় তিন হাজার মামলা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসবই সাধারণ মানুষের মামলা এবং তাদের পক্ষ হয়েই আসামীদের ধরা হয়। এই যে শত শত ওয়ারেন্ট নিয়ে আমরা আসামী গ্রেফতার করতেছি, সাধারণ মানুষের ইস্যু নিয়েই তো আমরা গ্রেফতার করতেছি।

এর আগে এডিসি হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে পেটানোর নানা অভিযোগ থাকলেও সেগুলোতে কেন তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? সে বিষয়ে ডিএমপির মুখপাত্র ফারুক হোসেন বলেন, তখন এ ধরণের সিচুয়েশন ডিটিরিওরেট (পরিস্থিতি খারাপ হয়নি) করে নাই, তাই।
ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধেই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয় বলে মানবাধিকার কর্মীরা যে অভিযোগ তুলেছেন সেটিকে ‘উদ্দেশ্যমূলক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশ এখানে নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে। তারা (মানবাধিকার কর্মী) যেটা বলতেছে, সেটা তাদের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে বলতেছে। আমরা মনে করি পুলিশ নিরপেক্ষভাবে এখানে কাজ করছে।

বৈঠকের ছবির বিষয়ে মি. হোসেন বলেন, বৈঠকের বিষয়টিকে তারা কোনভাবেই নেতিবাচকভাবে দেখছেন না। বরং প্রতিদিন শত শত মানুষ পুলিশ কমিশনারের সাথে দেখা করেন জানিয়ে তিনি বলেন, আপনি প্রত্যেকটা থানায় যান, প্রত্যেকটা ডিসি অফিসে যান, দেখেন সেখানে ভিকটিমের পরিবারের লোকজন কী পরিমাণ এসে আলোচনা করতেছে কিভাবে আইনগত প্রক্রিয়া নেয়া যায়, আইনি সুবিধা নেয়া যায়। এটা তো নতুন কিছু নয়। এখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু করা হয়নি

 

https://dailyinqilab.com/national/article/602192