১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৩:১৭

কেন কমছে না মূল্যস্ফীতি?

দেশের বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। বেড়েই চলেছে ডিম, আলু, তেল, চাল, মাছ, মাংস ও সবজির দাম। বাজারের প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, চলতি বছরের আগস্ট মাসে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.৯২ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে রেকর্ড ১২.৫৪ শতাংশ। সব মিলিয়ে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অথচ চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৬ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
এদিকে বিশ্ববাজারে প্রতিনিয়ত খাদ্যপণ্যের দাম কমছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য বলছে, বিশ্বে খাদ্য মূল্যসূচক আগস্ট মাসে গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে। সংস্থাটি বলছে, এ সময়ে চাল ও চিনি ছাড়া বিশ্ববাজারে প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দামই কমেছে। তবে পুরো উল্টো চিত্র বাংলাদেশে।

বিশ্বে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছুঁয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া মুদ্রানীতি ব্যর্থ হয়ে পড়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অব্যবস্থাপনার কারণেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যদিও সরকার দাবি করছে নিত্যপণ্যের দাম কমাতে তৎপর। কিন্তু বাজারের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার ব্যবস্থাপনায় যে নজরদারি ও খবরদারি দরকার সেগুলো ঠিকমতো করতে পারছে না। সরকারের ব্যয় মেটাতে ব্যাপক টাকা ছাপানো হয়েছে। এটি বন্ধ করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দুর্বলতার কারণে আমদানিকারকরা এলসি খুলতে পারছেন না। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার এটি একটি বড় কারণ। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে মূল্যস্ফীতি। নিম্নআয়ের মানুষের কাছে এটি আরও বেশি বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা গেছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। গত আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.৫৪ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৭৩ শতাংশে উঠেছিল। এক দশকের মধ্যে গত আগস্ট মাসে হঠাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রথমবারের মতো দুই অঙ্কের ঘরে উঠে যায়। এর মধ্যে গ্রাম এলাকায় আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২.৭১ শতাংশ। আর শহর এলাকায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১২.১১ শতাংশে। উভয়ক্ষেত্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতি জুলাইয়ে ১০ শতাংশের নিচে ছিল।

অন্যদিকে সার্বিক খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি জুলাইয়ের ৯.৪৭ শতাংশ থেকে কমে আগস্টে ৭.৯৫ শতাংশ হয়েছে। এর মধ্যে আগস্টে গ্রাম এলাকায় খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৭.৩৮ শতাংশ ও শহর এলাকায় এটি ৮.৪৮ শতাংশ। এছাড়া গ্রামে এখন সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯.৯৮ শতাংশ, যা জুলাইয়ে ছিল ৯.৭৫ শতাংশ। আর শহরে এখন সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯.৬৩ শতাংশ, যা জুলাইয়ে ছিল ৯.৪৩ শতাংশ।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, হঠাৎ করেই ডিম ও আলুর দাম বেড়েছে। এসব খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে মূল্যস্ফীতিতে।

সরকারের যদিও প্রত্যাশা ছিল আগস্টে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমবে। গত ২৯শে আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভার পর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘মূল্যস্ফীতি জোর করে কমানো যায় না। কার্যকর নীতি নিতে হবে। আমি ঝুঁকি নিয়ে বলতে পারি, আগস্টে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসবে।’ তবে আগস্টে সে হার উল্টো বেড়েছে।

তথ্যমতে, বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বর্তমানে এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি পাকিস্তানে। আগস্টে দেশটির মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ২৭.৪ শতাংশ। নেপাল ও ভারতে জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৪৪ শতাংশ। দেশ দুটির আগস্টের তথ্য এখনো প্রকাশ করা হয়নি। অন্যান্য দেশের মধ্যে ভুটান ও শ্রীলঙ্কায় আগস্টের মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশ এবং মালদ্বীপে জুলাইয়ে ছিল ২.৩৮ শতাংশ। এর বাইরে আফগানিস্তানে কোনো মূল্যস্ফীতি নেই। দেশটিতে জুনে উল্টো মূল্য সংকোচন ছিল। তবে এর পরের তথ্য দেশটি প্রকাশ করেনি।

পণ্যবাজারের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের নিয়মিত মাসিক প্রতিবেদনের (পিংকশিট) সেপ্টেম্বর সংস্করণের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১ হাজার ৮৮৭ ডলার। কিন্তু গত আগস্টে তা ১ হাজার ১২৭ ডলারে নামে। ২০২২ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে প্রতি টন ভুট্টার দাম ছিল ৩৪২ ডলার। যদিও গত আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ২০৭ ডলারে। গত বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে প্রতি টন গমের দাম ছিল ৪৯২ ডলার। গত মাসে তা ৩১৫ ডলারে নেমেছে।

বাংলাদেশের বাজারে অবশ্য এর প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। উল্টো বেড়েই চলেছে সব নিত্যপণ্যের দাম। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৪৮-৫০ টাকা। এছাড়া প্রতি কেজি খোলা আটা ৪৫-৫০ টাকা, দেশি পিয়াজ ৮০-৯০, আলু ৪২-৪৫, চিনি ১৩০-১৩৫, সয়াবিন তেলের লিটার ১৫৫-১৬০, ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৭৫-১৮০ এবং গরুর মাংস ৭৫০-৭৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর এক হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৩ টাকায়। অথচ ২০২১ সালের আগস্টে প্রতি কেজি চাল ৪৫-৫০ টাকা, প্রতি কেজি খোলা আটা ৩০-৩৩, দেশি পিয়াজ ৪২-৪৫, আলু ১৮-২২, চিনি ৭৫-৮০, সয়াবিন তেল ১২৬-১৩০, ব্রয়লার মুরগি ১৩০-১৪০ এবং গরুর মাংসের দাম ছিল ৫৮০-৬০০ টাকা। প্রতি হালি ডিম বিক্রি হয়েছে ৩৫-৩৭ টাকায়। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ।

কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, বিবিএসের প্রকাশিত খাদ্যপণ্য সহ সার্বিক মূল্যস্ফীতির হিসাবে প্রকৃত বাস্তবতা উঠে আসেনি। এখন খাদ্যপণ্যের প্রকৃত মূল্যস্ফীতি গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ার কথা। কারণ কয়েক মাস ধরে কখনো কাঁচা মরিচ, কখনো আদা, রসুন, পিয়াজ কিংবা ডিমের বাজারে অরাজকতা লেগেই ছিল। ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার ফাঁদে পড়তে হয়েছে সাধারণ ভোক্তাদের। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশের বাজারে সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায়। কিন্তু দাম কমলে দেশের বাজারে তা আর কমে না। সরকারি সংস্থাগুলোর এক্ষেত্রে তদারকির অভাব রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের সংকট মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দিচ্ছে। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাও এজন্য দায়ী। সরকারি হিসাবের চেয়ে বাস্তবে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ আরও বেশি। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে এই সময়ে টিসিবি’র মাধ্যমে পণ্য বিক্রি বাড়িয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।

স্কুল শিক্ষক কামরুন্নেছা বলেন, সব জিনিসের দাম বেড়েছে। কিন্তু ব্যাংকে যে টাকা রেখেছি, সেখান থেকে আমার আয় একই রয়ে গেছে। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে ৫ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করেছেন। সেখান থেকে প্রায় ৬ শতাংশ হারে সুদ পান। তিনি বলেন, সম্প্রতি জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে, সে হিসাবে ব্যাংক থেকে যা পাচ্ছি তা খুবেই কম। কিন্তু আমার আর কোনো উপায়ও নেই।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মামুন। মাসে মোট বেতন পান ৪০ হাজার টাকার মতো। দুই ছেলেমেয়ে, স্ত্রী সহ ৪ জনের সংসার। বাজারে নিত্যপণ্যের দামের উত্তাপে মাসের আয় দিয়ে চলা তার জন্য কঠিন। মাছ-মাংস খাওয়া প্রায় বন্ধ। এরপর বাসাভাড়া, সন্তানের স্কুলের বেতন দেয়ার পর হাতে তেমন কিছু থাকে না। ধার করতে হয় অন্য সব খরচ চালাতে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন গণমাধ্যমকে বলেন, মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশ সুদহারকে কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু, মূল্যস্ফীতি হ্রাসের প্রাথমিক এই ব্যবস্থা না নেয়ায়, বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম। যেমন শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের অনেক বিষয়ের নীতিনির্ধারণে স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রভাব থাকায় বাংলাদেশ এসব পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে খুবই উদাসীন ছিল।

https://mzamin.com/news.php?news=73783