১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৫:৪২

সরকারি দলের ক্ষমতাপ্রীতি ॥ রাজনৈতিক সংকট ও জাতির প্রত্যাশা

ড. মো. নূরুল আমিন

মূল আলোচনা শুরু করার আগে একটি গল্প বলি। গল্পটি আমার এক আফ্রিকান বন্ধুর মুখে শোনা এবং পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে বহুল প্রচলিত। গল্পটি হচ্ছে এমন : চারদিকে বিশাল জলরাশি বেষ্টিত একটি দ্বীপ; দ্বীপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। একদিন গভীর রাতে দ্বীপটিতে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটলো। দ্বীপবাসীরা লক্ষ্য করলেন যে, আকাশ থেকে একটি আলোকছটা তীব্র গতিতে দ্বীপের দিকে ছুটে আসছে। আলোকছটাটি যতই নীচের দিকে নামছে ততই তার ব্যাপ্তি ও পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ আলোকছটাকে টার্গেট করে দৌড়িয়ে তার দিকে আসতে থাকলো। এক সময় তা জমিনে নেমে এল এবং আলোক রশ্মি থেকে সুদর্শন একজন ফেরেশতা বেরিয়ে এলেন। মানুষ তাকে ঘিরে ধরলো। তিনি সমবেত জনতার সাথে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন এবং এই উদ্দেশে তাদের মধ্য থেকে তিনজন প্রতিনিধি মনোনয়ন দেয়ার অনুরোধ করলেন। তারা তাই করলেন। তাদের একজন ছিলেন অতিবৃদ্ধ, আরেকজন কেতা দুরস্ত প্রৌঢ় এবং তৃতীয় ব্যক্তি একজন সাদাসিধে যুবক ও সংগঠক। ফেরেশতা আলাদা আলাদাভাবে তিনজনের সাথেই কথা বললেন। প্রথমে তিনি বৃদ্ধ লোকটিকে ডাকলেন এবং বললেন, এখন থেকে ২৪ ঘণ্টা পর প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসে এই দ্বীপ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তোমরা কেউ জীবিত থাকবে না। এখন তোমার দায়িত্ব কী? বৃদ্ধ বললেন, আমি জীবনে অনেক গুনাহখাতা করেছি। যে ২৪ ঘণ্টা সময় পাবো তার জন্য আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নেব যাতে পরকালে শাস্তি না পাই। তিনি তাকে বিদায় করে দিলেন এবং দ্বিতীয় ব্যক্তিকে ডেকে একই প্রশ্ন করলেন। প্রৌঢ় ব্যক্তিটি বললেন, আমি জীবনকে অনেক ভোগ করেছি, খাওয়া দাওয়া ভোগস্ফূর্তির আরো অনেক বাকী আছে। এই চৌব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি তার যতটুকু পারি সেরে নেব। ফেরেশতা তাকেও বিদায় করে দিলেন এবং তৃতীয় ব্যক্তিকে ডাকলেন, এই ব্যক্তি ছিল একটি যুবক ও সংগঠক। ফেরেশতা তাকেও একই প্রশ্ন করে তার উত্তর জানতে চাইলেন। যুবক কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন এবং বললেন, আমার দ্বীপে কয়েক কোটি মানুষ আছে। আমার হাতে এখন ২৪ ঘণ্টা তথা ১৪৪০ মিনিট বা ৮৬৪০০ সেকেণ্ড সময় আছে। আমি এই সময়ের মধ্যে আমার সংগঠনগুলোর মাধ্যমে এই কোটি জনতাকে সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করে দ্বীপের চারদিকে এমনভাবে বাঁধ দেয়ার কাজে লাগিয়ে দেব যাতে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের পানি দ্বীপের জনপদে ঢুকতে না পারে এবং দ্বীপবাসীর জীবন ও সম্পদ রক্ষা পায়। ফেরেশতা তার উত্তর শুনে তাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং আশ্বাস দিয়ে বললেন আমি ও আমার আল্লাহ তোমার সাথে আছি। এখন আমাদের আলোচনায় আসি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশের ঈশান কোণে যে মেঘ ঘনীভূত হতে শুরু করেছে তাতে এক মহাবিপর্যয়ের আভাস আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, এই বিপর্যয় ও দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য বাস্তব ও কার্যকর কোনও প্রস্তুতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সরকারের একগুঁয়েমী পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনের কোনও উদ্যোগ নেই। তারা মনে করছেন যে, ২০১৪ সালে ও ২০১৮ সালে বিনা নির্বাচনে ও নির্বাচনের নাটক করে প্রশাসন, আইনশৃংখলা বাহিনী এবং নির্বাচন কমিশনকে বিভিন্নভাবে এধরহ ড়াবৎ করে যেভাবে দেশের মানুষের ভোটাধিকার হরণ করে তারা ক্ষমতা দখল করে আছেন একইভাবে এবারও তারা এই দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখতে পারবেন। এ প্রেক্ষিতে তাদের তরফ থেকে সংকট নিরসনের কোনও উদ্যোগ না নেয়াটাই স্বাভাবিক। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারপন্থী দেশ ও সংস্থাগুলো এই সংকট নিরসন, একনায়কতন্ত্রের অবসান, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছে। গুম হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন পুঁজিপাচার প্রভৃতি মানবাধিকার বিরোধী কর্মকা-ের জন্য এই উপমহাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের ন্যায় বাংলাদেশ সরকারের কিছু মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, আইন ও প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে এবং করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। পাঠকদের স্মরণ থাকতে পারে যে, এর আগে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালেও জাতিসংঘসহ বিদেশী রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে যে সংকট তা নিয়ে সরকার এবং বিরোধীদল উভয় পক্ষকে একটা সমঝোতায় আসার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তারা সংলাপেরও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের অনাগ্রহ ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের কারণে তা ব্যর্থ হয়। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে টেলিফোন সংলাপে এই অনুরোধ করেছিলেন এবং শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়ার সাথে কথা বলার জন্য ঢাকায় তার বিশেষ দূতও পাঠিয়েছেন কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। মহাসচিবের টেলিফোনের আগে সরকারের শীর্ষ নেতারা পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু টেলিফোনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারির মধ্যে পার্লামেন্ট বহাল রেখে, তার মন্ত্রীদের ক্ষমতায় রেখে তার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। তখন প্রশ্ন উঠেছিল পার্লামেন্ট বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যৌক্তিকতা কোথায়? একটি পদ খালি হলেই তা পূরণের জন্য নির্বাচনের প্রশ্ন আসে। পদটি যদি খালিই না হয় এবং সেই পদে আসীন ব্যক্তি সরকারের সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে নির্বাচন করেন তাহলে সুবিধা বঞ্চিত বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তার বিরুদ্ধে নির্বাচন করা কি অর্থহীন নয়? এটি সরকারের একটি অপকৌশল।

তাদের আরেকটি আপকৌশল ছিল সংসদকে বহাল রেখে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বাতিল করে বর্তমান সংসদের মেয়াদ আরো পাঁচ বছর বাড়িয়ে দেয়া। এই কাজে আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা রয়েছে। আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রধান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে নির্বাচন পিছিয়ে সংসদের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং নিজেকে আজীবন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছিলেন। সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা এবং চারটি দৈনিক পত্রিকা বাদে বাকী সকল পত্রিকা বন্ধ করার বিষয়টিতো সকলেরই জানা। তার কন্যা শেখ হাসিনা অনেক দিক থেকেই তাকে ডিঙ্গিয়ে গেছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অভিযোগ করেছেন এবং এ প্রেক্ষিতে তিনি আরো অগ্রসর হলে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচন স্থগিত করে বিদ্যমান সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং নিজেকে আজীবন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে মনে হয়।

প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্যে তার দলকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়ে দেশব্যাপী সফর করছেন এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। নিজের সরকারের সাফল্য গাঁথা প্রচার করছেন। তার বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ উঠেছে। একজন প্রধানমন্ত্রী হয়ে সিডিউল ঘোষণার আগে, সরকারি পয়সায় ভ্রমণ করে দলের জন্য ভোট চাওয়া সভ্য দেশে কল্পনা করা যায় না। ২০১৪ সালে সামাজিক মাধ্যমে আরেকটি অশোভনীয় ভোট প্রার্থনার সচিত্র রিপোর্ট এসেছে এবং সেটা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী গোয়ালন্দের পতিতালয়ে গিয়ে পতিতাদের কাছে ভোট ভিক্ষা করছেন। একটি দেশের নারী প্রধানমন্ত্রীর জন্য এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছুই হতে পারে না।

নিউএজ সম্পাদক জনাব নুরুল কবির কিছুকাল আগে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে একটি মূল্যবান কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন ১৯৯৬ সালে বিএনপিকে যেভাবে রাজপথের আন্দোলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছিল বিএনপিও এবার আওয়ামী লীগকে যদি সেভাবে বাধ্য করতে পারে তবে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটের একটা সমাধান হতে পারে। আর না পারলে ইতিহাস তার আপন গতিতে চলবে। এখানে একটি কথা পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন এবং সেটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের অবস্থান।
তারা সংবিধানের কথা বলেন, কিন্তু সংবিধানের বর্তমান অবস্থা তারাই এককভাবে তৈরি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে ইতোপূর্বে একটি ক্লারিফিকেশন দিয়েছেন। সংবিধান সংশোধন তথা কেয়ারটেকার সরকার বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধি অন্তর্ভুক্ত করার আগে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তার মতে সেই কমিটি বিরোধী দল, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে পরামর্শ করে কেয়ারটেকার পদ্ধতি বিলোপের সুপারিশ করেছিলেন। তার এই কথাটি যে ডাহা অসত্য প্রধানমন্ত্রী নিজে অবশ্যই তা জানার কথা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে এই ব্যাপারে যে কমিটি হয়েছিল সেই কমিটি বিভিন্ন শ্রেণী পেশার লোকের সাথে মতিবিনিময় করেছিলেন এটা সত্য। কিন্তু তাদের শতকরা ১১ ভাগ আরো দুটি জাতীয় নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছিল। তাদের পরামর্শ নিয়ে সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার একদিন আগেও বলেছিলেন যে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি সংবিধানে থাকছে। কিন্তু দেখা করার পরের দিনই তার অবস্থান পাল্টে যায়। এর অর্থ কী? প্রধানমন্ত্রী সকল জনমতকে উপেক্ষা করে নিজেই কেয়ার টেকার পদ্ধতি উঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সংবিধান সংশোধন করেছেন। অবশ্য অনেকে বলেন, কেয়ারটেকার ব্যবস্থা সম্পর্কে ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হবার পরই শেখ হাসিনার মোহমুক্তি ঘটেছিল। নির্বাচনে হেরে তিনি তার পছন্দের প্রেসিডেন্ট কেয়ারটেকার সরকার প্রধান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সেনাপ্রধানকে বিশ্বাসঘাতক ও বেঈমান বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ঐ সময়েই তার নির্দেশে কেয়ারটেকার সরকারের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল এবং এই মামলা তিনি ক্ষমতায় আসার পর সুবিধা অনুযায়ী মুভ করে বিচারপতি খায়রুল হককে প্রায় দশ লাখ টাকার অবৈধ সুবিধা দিয়ে রায় তার অভিলাষ অনুযায়ী আদায় করেছিলেন। যদিও সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশের পর বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে গিয়ে ১৬ মাসের মাথায় সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন। এই রায়ে সংক্ষিপ্ত রায়ের অনেক কিছু বাদ দিয়ে শেখ হাসিনার অনেক রাজনৈতিক বক্তব্য স্থান পেয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের কথা বলেন, তার উন্নয়নের ফিরিস্তি প্রকাশের জন্যে একবার দেখা গেলো রাজধানীর প্রায় সকল বিলবোর্ডগুলো রাতারাতি তার দল দখল করে নিয়েছে। দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠলো। কিভাবে বিলবোর্ডগুলো কারা দখল করলো সরকার বা আওয়ামী লীগ অথবা মহাজোট কেউ তা স্বীকার করলেন না। তারপর হঠাৎ এক রাতে সুড়সুড় করে বিলবোর্ডগুলো নেমে গেলো। এখন দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রাম আর রাজশাহীর বিলবোর্ডগুলো দখল হয়ে গেছে এবং সেখানে সরকারের উন্নয়নের ডুগডুগি বাজানো হচ্ছে। উন্নয়ন মানুষ বিলবোর্ডে দেখে না।

সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করে ও উপলব্ধি করে। দেশের মানুষ তাদের উন্নয়ন উপলব্ধি করতে পারছেন না। আর উন্নয়নের অর্থ ৬৪টি জেলার ৫ শতাধিক উপজেলার পাঁচ সহ¯্রাধিক ইউনিয়নকে বাদ দিয়ে রাজধানীসহ গোটা কয়েক বিভাগীয় শহরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়/অপব্যয় করে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা নয়। তিনি বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়নের কথা বলেন কিন্তু দৈনিক যখন ৪/৫ বার কমপক্ষে ১ ঘন্টা করে লোডশেডিং-এর নির্যাতন আমরা ভোগ করি তখন লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা পায় না। শহর নগর গ্রামগঞ্জে রাস্তাঘাটে হাঁটা যায় না, যানবাহন চলতে পারে না। উন্নয়নের এত অর্থ গেল কোথায় তার এই উন্নয়ন মোল্লা নাসিরুদ্দীনের গোশত চুরির ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। একদিন বাজারে গিয়ে মোল্লা নাসির ভাল গোশত পেয়ে খুশী হয়ে একসের গোশত কিনে বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে ভাল করে রান্নার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মোল্লার স্ত্রী গোশত রান্না করলেন, কিন্তু রান্না করা গোশত তার এতই ভাল লাগল যে তিনি পুরো গোশতই খেয়ে ফেললেন। মোল্লা খেতে বসে যখন গোশত চাইলেন তখন স্ত্রী বললেন, তা বিড়ালে খেয়ে ফেলেছে। মোল্লা জিজ্ঞাসা করলেন বিড়াল কি পুরো গোশতই খেয়ে ফেলেছে? মোল্লার স্ত্রী হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন। বিড়ালটি কাছেই ছিল। মোল্লা নাসিরুদ্দীন বিড়ালটিকে দাঁড়িপাল্লায় চড়িয়ে দেখলেন যে বিড়ালটির ওজন একসের। মোল্লা বললেন, এটিই যদি সেই বিড়াল হয় তাহলে গোশত কোথায়, আর এটিই যদি সেই গোশত হয় তাহলে বিড়াল কোথায়? আওয়ামী লীগের গত পনেরো বছরের যদি এটিই উন্নয়ন হয় তবে বিনিয়োগের অর্থ গেল কোথায়? আর যদি এটিই বিনিয়োগ হয় তাহলে উন্নয়ন গেল কোথায়? কেন না গ্রামেগঞ্জে, রাস্তাঘাটে, শহরের কোন অলিতে গলিতে এই উন্নয়নের লক্ষণ আমরা দেখি না। তবে একটি ক্ষেত্রে তারা সফল এবং সেটি হচ্ছে বিরোধী দল ও মতের দমন, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, চুরি ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, গুম, খুন, টেন্ডারবাজি, দখল বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, সরকারি সম্পত্তি গ্রাস, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, ব্যাপক দুর্নীতি ও দলীয়করণ, বিদেশে পুঁজিপাচার।

বিরোধী দলের সামনে এখন অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ। তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ও তাকে ঢেলে সাজানো জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের সংস্কার, জামায়াতের নিবন্ধন পুনর্বহাল, রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় প্রভাবমুক্তকরণ, ভোটার তালিকা সংশোধন ও ভুয়া ভোটার মুক্তকরণ শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ জামায়াত-শিবির, বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদলের নেতা-কর্মীকে বিনা শর্তে কারামুক্তি। তাদের বিরুদ্ধে আনীত সকল মামলা প্রত্যাহার এবং সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও বিরোধীদল নির্যাতনের অবসান। এই ন্যূনতম দাবিগুলো মেনে নেয়া না হলে এই দেশে নির্বাচনী পরিবেশ ফিরে আসতে পারে না। সরকারের যে আচরণ, তাতে তারা জনদাবির প্রতি কোন রকম সম্মান প্রদর্শনে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিদেশী রাষ্ট্রদূতরা সংলাপের তাগিদ দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু সংলাপ কিসের জন্য? গেরো দিয়েছেন সরকারি দল, তা খুলবার দায়িত্বও সরকারি দলের। এখানে বিদেশী কোন রাষ্ট্র বা সংস্থার ভূমিকা নগণ্য। তারা যা করতে পারেন তা হচ্ছে নৈতিক চাপ। কিন্তু শেখ হাসিনা এই চাপের থোড়াই তোয়াক্কা করেন। এই অবস্থায় নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবিরের মন্তব্যই আমার সঠিক বলে মনে হয়। বিরোধীদলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে যদি দুর্বার আন্দোলন করতে পারে তাহলেই সঙ্কটের সমাধান সম্ভব। জামায়াত মাঠে আছে এবং সরকারি নির্যাতন ভোগ করছে। বিএনপি যদি অভ্যন্তরীণ সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এবং এজেন্সিগুলোর প্ররোচনা উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে মাঠে নামতে পারে তাহলেই শুধু একটি দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে এবং দেশবাসী এখন তাই চায়।

আমি একটা গল্প দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। আমরা এখন প্রলয়ংকারী জলোচ্ছ্বাসের চেয়ে বেশি ভয়াবহ সমস্যার মধ্যে আটকে আছি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের দানবীয় দুঃশাসন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, মানবাধিকার হরণ, সরকারের আশীর্বাদপ্রাপ্ত সিন্ডিকেট ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠা, দুর্গত মানুষের কান্না, উন্নয়নের নামে সরকারি অর্থের অপচয়, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সমূহের ধ্বংসপ্রাপ্তি, ভোটাধিকার হরণ, পুঁজি পাচার, স্বনামে বেনামে লোনের নামে ব্যাংকসমূহের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার অর্থ লোপাট, ধর্ষণ ব্যভিচারের প্রসার, শিক্ষা ব্যবস্থার অধোগতি এবং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে জলাজঞ্জলি দিয়ে বিদেশী রাষ্ট্রের পদলেহন ও তাদের আজ্ঞাবহ হিসেবে দেশের মানুষের উপর নির্যাতন প্রভৃতি আমাদের এবং আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের স্বাধীন নাগরিক সত্ত্বা নিয়ে বেঁচে থাকার পথে প্রধান অন্তরায়। এগুলো তীব্র জলোচ্ছ্বাস হয়ে আমাদের নির্মূল করতে উদ্যত। দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হলে নেতৃত্বের প্রয়োজন। বিরোধীদলগুলো দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতিকে এই জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলার কাজে লাগাতে পারেন। তারা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারেন এবং বিদেশীদের উপর ভরসা করে নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান ফাটল অব্যাহত রাখেন তাহলে আগামী পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত এই জাতিকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ থাকতে হবে বলে রাজনৈতিক কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের আশংকা। বিরোধীদলগুলো সক্রিয় হবেন দেশ ও জাতিকে জালেমের জুলুম মুক্ত করে তাদের সামগ্রিক অধিকারসমূহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন এটাই বিরোধীদলসমূহের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বলে আমি মনে করি।

https://www.dailysangram.info/post/535184