১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১২:১১

ডেঙ্গু কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না?

ইতিহাসে ভয়াবহতম ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে লড়ছে বাংলাদেশ। ডেঙ্গুর থাবা এখন ৬৪ জেলাতেই। মৃত্যু ও শনাক্তে গড়েছে নতুন রেকর্ড। এডিস মশাবাহিত এই রোগে প্রতিদিনই দু’ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৭শ’র বেশি মানুষ মারা গেছেন। আক্রান্ত সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা এবং সংস্থাটির সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে জনসম্পৃক্ততার বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন এই জনস্বাস্থ্যবিদ। তিনি বলেন, আমাদের কমিউনিটি এনগেজমেন্টের ব্যাপারটা হচ্ছে না। এমনিতে এই কাজে লজিস্টিকস সাপোর্ট লাগে, আরও অনেক কিছু লাগে। কিন্তু কমিউনিটি এনগেজমেন্টটাকে একটি বিষয় ধরে নিয়ে কিছু করার কাজটি এখানে হয় না। এখানে কমিউনিটি এনগেজমেন্টকে একটা এক্সট্রা জিনিস হিসেবে ধরা হয়।

ডেঙ্গুর সোর্স হচ্ছে এডিস মশা এবং রোগী। ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে দুটো সোর্সকেই আটকাতে হয়। সেই কাজটা এখানে হয় না। এটা কমিউনিটি এনগেজমেন্ট ছাড়া অসম্ভব।

২০১৯ সালের ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে একটি জাতীয় নির্দেশিকা তৈরি করেছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ। ওই নির্দেশিকা বা গাইডলাইন সম্পর্কে ডা. মুশতাক বলেন, সেখানে বলা আছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোন কোন পর্যায়ের কমিটিগুলো কেমন হবে, কে কে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকবেন, ভলান্টিয়ারদের কীভাবে কাজে লাগাতে হবে। একটা ওয়ার্ডে কীভাবে কাজ হবে সেটার নির্দেশনাও আছে সেখানে। প্রত্যেকটা পাড়া, মহল্লা বা গলিভিত্তিক ডেঙ্গু প্রতিরোধ কমিটি তৈরি এবং তাদের কার্যপরিধির কথাও বলা আছে সেখানে। সেটা কার্যকরী হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু যেহেতু কীটবাহিত একটা রোগ এবং কীটকে নিয়ন্ত্রণে আনা এই রোগ নিয়ন্ত্রণের মূল উপজীব্য, সেখানে যদি এন্টোমলজিক্যাল (কীটতত্ত্ব) ক্যাপাসিটি না থাকে, টেকনিক্যাল গাইডেন্সটা না থাকে তাহলে আমরা যে কাজগুলো করছি সেই কাজগুলো কখনোই কার্যকরী হবে না। ফলে গত ২৩ বছর ধরে আমরা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। ঢাকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি ইতিমধ্যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যদি রোগটা না ছড়াতে পারে তাহলে ভবিষ্যতেও এই রোগটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আর রোগটাকে যদি ছড়াতে দেয়া হয়, তাহলে শুধু এটা ঢাকায় না; সবখানেই ছড়াবে।

কীটতত্ত্ববিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা পরিচিত শত্রু এডিস মশা এবং তার দ্বারা সংক্রমিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছরই কমবেশি অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। ডেঙ্গু এবং এর বাহক মশা সম্বন্ধে আমরা সবাই অবগত এবং এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও আমাদের জানা। তারপরেও আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কেন ব্যর্থ হচ্ছি?

তিনি বলেন, আমরা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, এডিস মশার ঘনত্ব, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এই কয়েকটি বিষয় নিয়ে মাল্টিভেরিয়েট অ্যানালাইসিস করে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করি। যার মাধ্যমে ডেঙ্গু সম্বন্ধে আগাম ধারণা দিতে পারি। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০০টিরও বেশি দেশে এই রোগটি এখন স্থানীয়। আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলো ডেঙ্গুর সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। তিনি জানান, আমি আগেই বলেছিলাম ২০২৩ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। ডেঙ্গু সংক্রমণ শুধুমাত্র বাংলাদেশে হচ্ছে ব্যাপারটি এমন নয়। এই বছর ইতিমধ্যে লক্ষাধিক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু এবং আর্জেন্টিনায়। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে মালয়েশিয়া, ফিলিপিন, শ্রীলঙ্কায়ও আক্রান্তের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি।

অপরিকল্পিত নগরায়ন, বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশগত কারণ ডেঙ্গু সংক্রমণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জনসংখ্যার ঘনত্ব, মানুষের যাতায়াত, ব্যবহারযোগ্য পানির স্বল্পতা, বিভিন্ন পাত্রে পানি সংরক্ষণ এডিস মশার ঘনত্ব ও ডেঙ্গু বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণ।

ডব্লিউএইচও বিশেষজ্ঞদের মত: বাংলাদেশে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ বিস্তারের জন্য জলবায়ু সংকট এবং এল নিনো আবহাওয়া পরিস্থিতি দায়ী বলে মনে করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিশেষজ্ঞরা। এটিকে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদের হাতছানি বলে মন্তব্য করেন তারা। ডব্লিউএইচও’র তথ্যমতে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবে ভয়াবহ চাপের মুখে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়ছে রোগী, দেখা দিয়েছে বেডের তীব্র সংকট। রোগীদের সেবা-শুশ্রুষার জন্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদেরও।

ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গ্যাব্রিয়েসুস গত ৬ই সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বাংলাদেশে প্রাদুর্ভাবের সময় নজরদারি, ল্যাবের সক্ষমতা, ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট, মশা নিয়ন্ত্রণ, যোগাযোগ এবং সম্প্রদায় সংযোগের কাজে বাংলাদেশ সরকার এবং কর্তৃপক্ষগুলোকে সহায়তা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তিনি বলেন, আমরা চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং মাঠপর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের মোতায়েন করেছি। আমরা ডেঙ্গু পরীক্ষা এবং রোগীদের সেবাযত্নের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও সরবরাহ করেছি। সংস্থাটি বলছে, এ বছর বাংলাদেশের ৬৪টি জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। তবে রাজধানী ঢাকায় এর প্রকোপ ছিল সবচেয়ে বেশি। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে একটি ঢাকা। এ শহরে দ্রুত অপরিকল্পিত নগরায়ন ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে রেকর্ডসংখ্যক আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনার কারণ দেশটি উচ্চ তাপমাত্রা এবং উচ্চ আর্দ্রতার মধ্যে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত দেখেছে, যার ফলে সারা দেশে মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উষ্ণ, আর্দ্র পরিস্থিতি রোগবাহী মশার জন্য নিখুঁত প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বিগত দুই দশকে বিশ্বে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আটগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু সংকট আরও খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়া এবং হলুদ জ্বরের মতো মশাবাহিত রোগগুলো আরও বেশি ছড়িয়ে পড়তে থাকবে এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।

https://mzamin.com/news.php?news=73496