৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:৪২

যত্রতত্র কোম্পানির মানহীন কয়েলে সয়লাব দেশ

পিটাকের এক বৈঠকেই লাইসেন্স পেল ৩৩০ কোম্পানি

দেশে বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। এডিস মশা তাড়াতে ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের মশার কয়েল, অ্যারোসেলসহ নানা উপাদান। মশার কামড় থেকে বাঁচতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে কয়েল। ডেঙ্গুতে এবার রেকর্ডসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এখনো হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে কাতরাচ্ছেন। এ অবস্থায় যেন পোয়াবারো কয়েল কোম্পানিগুলোর। দেশে এই মুহূর্তে কয়েল কোম্পানির সংখ্যা ২২৯টি। নতুন করে আরো ৩৩০টি কয়েল কোম্পানির লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ভুক্ত বালাইনাশক কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (পিটাক)। ফলে দেশে অনুমোদিত বৈধ কয়েল কোম্পানির সংখ্যা দাঁড়ালো ৫৫৯ টিতে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে কয়েলের বাজারের পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। তবে, এ বছর এর পরিমাণ আরো বাড়ছে। শুধু যে, এই বৈধ কোম্পানিগুলোর কয়েল বাজারে রয়েছে, তা নয়। অবৈধভাবে আরো অসংখ্য কোম্পানি কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাত করে যাচ্ছে। অনেকে আবার চূড়ান্তভাবে লাইসেন্স পাওয়ার আগেই কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাতে সক্রিয় রয়েছেন। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ কয়েল কোম্পানি, মানহীন কয়েল জব্ধ, জরিমানাসহ কারখানা সিলগালার মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু থেমে থাকছে না অসাধু মানুষের মানহীন কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ কার্যক্রম। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, সাভার, টুঙ্গিসহ নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় মানহীন কয়েল উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে। এর বাইরে কিশোরগঞ্জের ভৈরবসহ দেশের আরো কিছু এলাকাকেন্দ্রিক একটি অসাধুচক্র গড়ে উঠেছে। যারা মানহীন কয়েল উৎপাদন করে বাজারজাত করছে।

বৈধ-অবৈধভাবে সারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা কয়েল কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত বেশির ভাগ কয়েলই মানহীন। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বড় কোম্পানির পাশাপাশি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছোট ছোট কয়েলের কোম্পানি গড়ে উঠেছে। তারা ক্ষতিকর মাত্রায় রাসায়নিক প্রয়োগ করে কয়েল উৎপাদন করছে। উচ্চমাত্রার রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে এসব কয়েল দ্রুত মশা তাড়ালেও তা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। দেশের মানসম্পন্ন কারখানাগুলো ক্ষতিকর মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার করে না। কারণ, তাদের এ-সংক্রান্ত নীতিমালা মেনে চলতে হয়। ফলে নন-ব্র্যান্ডের কয়েলের কাছে ব্র্র্যান্ডের কয়েল বাজার হারায়।
অনেক ক্ষেত্রে মানহীন কয়েলে মশা তো মরেই না, বরং তা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।

পিটাকের একই বৈঠকে ৩৩০ কোম্পানির লাইসেন্স
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং এবং বিএসটিআই যৌথভাবে কয়েল কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স দিয়ে থাকে। পণ্যের মাঠ যাচাই, টেস্টিং রিপোর্ট ও বাস্তব রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে পিটাকের সভা অনুমোদন দিয়ে থাকে। এরপর উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং কোম্পানির নিবন্ধন দেয়। তারপর কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স নিতে হয়।

ডিএই সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং থেকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ব্যবহার্য বা পিএইচপিভুক্ত (পাবলিক হেল্থ পেস্টিসাইড) মশাসহ অন্যান্য পোকামাকড় নিরোধক ৬৪৯টি কোম্পানির নিবন্ধন রয়েছে। যার মধ্যে কয়েল কোম্পানির সংখ্যা ২২৯টি। এর মধ্যে ঢাকা অঞ্চলে মশার কয়েল কোম্পানি ১২৫টি। গত ১৬ জুলাই ৮৬তম পিটাক কমিটির সভায় জনস্বাস্থ্যের জন্য ব্যবহার্য নতুন করে আরো ৩৩৫টি কোম্পানির নিবন্ধন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যার মধ্যে ৩৩০টিই মশার কয়েল কোম্পানি।

পিটাক কমিটির সভাপতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার। সদস্য সচিব ডিএই’র উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ফরিদুল হাসান। পিটাক কমিটির সুপারিশের আলোকে মূলত ডিএই’র উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং নিবন্ধন দিয়ে থাকে।

এ বিষয়ে বিএসটিআই’র সার্টিফিকেশন মার্কস-এর উপপরিচালক (ডিডি) মো: রিয়াজুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, খামার বাড়ির প্লান্ট প্রটেকশনের অনুমোদন না থাকলে আমরা লাইসেন্স দিই না। অবৈধ বা মানহীন কয়েল কোম্পানির বিরুদ্ধে আমরা (বিএসটিআই) নিয়মিত ফ্যাক্টরিতে অভিযান পরিচালনা করি। জরিমানা করি। অবৈধ কয়েল ধ্বংস করে দেই। অনেক সময় কারখানা সিলগালা করে দেই।

পিটাক কমিটির সদস্য ও ডিএই’র উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের উপপরিচালক (বালাইনাশক প্রশাসন) ড. রফিকুল আলম খান নয়া দিগন্তকে বলেন, পিটাকের ৮৬তম সভায় ৩৩৫টি পিএইচপিভুক্ত (পাবলিক হেল্থ পেস্টিসাইড) কোম্পানির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এক সাথে এতোগুলো কোম্পানি অনুমোদন প্রসঙ্গে বলেন, এর আগে পিটাকের সাব কমিটির তিনটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী কোম্পানিগুলোর অনুমোদন হয়েছে। একটা কোম্পানির লাইসেন্স পেতে কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ এবং কত সময় লাগে-জানতে চাইলে ড. রফিকুল আলম খান বলেন, অনেকগুলো টেস্ট করতে হয়। প্র্যাকটিক্যালি দেখতে হয়, মশা মরে কি না। তিন রকম টেস্ট হওয়ার পর বিএসটিআই মান সনদ দেয়। সেই আলোকে আমরা রেজিস্ট্রেশন দেই। এরপর লাইসেন্স দেয়া হয়। আমাদের লাইসেন্স নেয়ার পর বিএসটিআই থেকে মান যাচাই সনদ নিতে হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রথমে আমাদের কাছে (প্লান্ট কোয়ারেন্টাইন) আসেন। এরপর বিএসটিআইতে যায়। একটা কোম্পানির অনুমোদন পেতে এভাবে কমপক্ষে ২-৩ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়।

বিএসটিআই সূত্র জানায়, ঢাকা বিভাগে গত ৫ বছরে ৩টি কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল হয়েছে। সংস্থাটির এক কর্মকর্তা জানান, বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স নিতে গেলে আগে খামারবাড়ির অনুমোদন নিতে হয়। তাদের নিবন্ধন ছাড়া বিএসটিআই দরখাস্তই গ্রহণ করে না। কিন্তু, খামারবাড়িতে নিবন্ধন পেতে সংশ্লিষ্টদের মাসের পর মাস সময় লেগে যায়। অনেকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে একটা ফ্যাক্টরি করে। এখন মশার কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাত করার জন্য তারা কতদিন বসে থাকবেন? তাই অনেকে নিবন্ধন না নিয়েই কয়েল তৈরি করে বাজারজাত করে।

সাংঘর্ষিক নাম নিবন্ধন : জানা যায়, ইতোমধ্যে যেসব কয়েলের ব্র্যান্ড সুনাম অর্জন করেছে তাদের অনেক ব্রান্ডের নামের আগে ও পরে কিছু যুক্ত করে নাম নিবন্ধনের আবেদন অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে পিটাক কমিটি। যেমন কয়েলের ভালো কয়েকটি ব্রান্ডের মধ্যে নাইস অন্যতম। এই নামের সাথে মিল রেখে নাইস কোয়ালিটি মশার কয়েল, ‘বস’ ব্রান্ডের সাথে মিল রেখে ‘বিগ বস’, নিউ পাওয়ারের সাথে মিল রেখে ‘পাওয়ার কিং’, পাওয়ার ফেমিস, সুপার পাওয়ার’, ‘ম্যাক্স পাওয়ার’। ‘ড্রাগন’ ব্যান্ডের সাথে মিল রেখে ‘পাওয়ার ড্রাগন’, ‘নাইট ড্রাগন সুপার’, ‘ফাইটিং কিং’ এর সাথে মিল রেখে ‘নাইট ফাইটার প্লাস’-এভাবে মূল নাম ঠিক রেখে সামনে ও পেছনে কিছু যোগ করে নতুন লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি পিটাক সাব কমিটির ১১৯, ১২০ ও ১২১তম সভায় সুপারিশপ্রাপ্ত অনেক কোম্পানির ব্র্যান্ড আগের অনেক নামিদামি ব্রান্ডের সাথে মিল থাকা সত্ত্বেও অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এর প্রতিকার চেয়ে পিটাক কমিটির চেয়ারম্যান বিএআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের বরাবর অনেক কোম্পানি ও মশার কয়েল কোম্পানিগুলোর সংগঠনের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/774943