৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১২:৪৫

ডেঙ্গু পরিস্থিতি : ১০ জেলায় ৭১ শতাংশ সংক্রমণ

দেশে গত এক দিনে ডেঙ্গুতে আরো ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দুই হাজার ৬০৮ জন। গতকাল রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টার দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির এমন তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত শনিবার এক দিনে মৃত্যু হয়েছিল ২১ জনের, হাসপাতালে ভতি হয়েছিল দুই হাজার ৩৫২ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, নতুন রোগীদের নিয়ে চলতি বছরে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার ৩০২ জন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরে ৬০ হাজার ৪৮৪ জন, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ৬৯ হাজার ৮১৮ জন। এই সময়ে মারা যাওয়া ৬৩৪ জনে মধ্যে ঢাকার হাসপাতালে ৪৬৪ ও ঢাকার বাইরে ১৭০ জন।

চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে গত ৩১ আগস্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) সাপ্তাহিক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, আক্রান্তদের ৭১ শতাংশ ১০ জেলায়।

এর মধ্যে ঢাকায় ৪৮.৫৮ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৪.৭৫ শতাংশ, বরিশালে ৪.৩২ শতাংশ, পটুয়াখালীতে ২.৩৭ শতাংশ, ফরিদপুরে ১.৯৮ শতাংশ, চাঁদপুরে ১.৮৯ শতাংশ, লক্ষ্মীপুরে ১.৪৪ শতাংশ, পিরোজপুরে ১.৮০ শতাংশ, কুমিল্লায় ১.৭২ শতাংশ ও ময়মনসিংহে ১.৬০ শতাংশ।

ঢাকায় সংক্রমণের ১৭.৮ শতাংশ ঘটেছে যাত্রাবাড়ীতে। ১২.৭ শতাংশ সবুুজবাগে, ৮.২৯ শতাংশ কদমতলীতে, ৪.০৩ শতাংশ মোহাম্মদপুরে, ৩.৭২ শতাংশ খিলগাঁও, ৩.৭১ শতাংশ কেরানীগঞ্জ, ৩.৫৪ শতাংশ ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়, ২.৯২ শতাংশ উত্তরায়, ২.৬৭ শতাংশ ধানমণ্ডি ও ২.৬০ শতাংশ পল্লবীতে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকার যেসব এলাকায় সংক্রমণ বেশি, সেখানে এডিস মশার প্রজনন বেশি হচ্ছে।

এর কারণ সেখানে বিভিন্নভাবে পানি জমে থাকছে। ঘরবাড়িগুলো রাস্তার চেয়ে নিচু। এ অবস্থা এডিস মশা প্রজননে সহায়ক হচ্ছে। এখন এই এলাকায় যদি আমরা ব্যাপক ব্যবস্থা না নেই, তাহলে এর পরে যখন সংক্রমণ হবে তখন শুধু আক্রান্তই হবে না, ওখানে বহু মৃত্যু হবে সামনের দিনগুলোতে।’

তিনি বলেন, ‘রোগতাত্ত্বিক তথ্য যখনই আমরা পাই তখনই আমাদের উচিত হলো কীটতাত্ত্বিক জরিপ করা, কীটতাত্ত্বিক অবস্থা পরিমাপ করা।

জরিপ হওয়ার পর সেখানে ব্যবস্থা নিয়ে মশা কমিয়ে আনা। এগুলো না হলে মশা বাড়তে থাকবে এবং আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, কোনো একটা জায়গায় যখন ডেঙ্গু বাড়তে থাকে, সেটা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে সেখানে বাড়তেই থাকে। এ জন্য এসব জায়গায় বেড়েছে। এসব জায়গায় বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গু বেশি ছিল। ধীরে ধীরে এর প্রকোপ ঘনীভূত হয়ে অনেক বেশি হয়ে গেছে।

ঢাকার বাইরে গ্রামে ডেঙ্গু বাড়ছে। সেটি নিয়ন্ত্রণে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে উপজেলা পরিষদ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সব অঙ্গপ্রতিষ্ঠানকে মশা নিয়ন্ত্রণে সরঞ্জাম, কীটনাশক এবং প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কারণ ভবিষ্যতে গ্রামগুলোতে মশা আরো বাড়বে। গ্রামে এ বছর হয়তো কম হয়েছে। সামনে অন্যান্য শহর ও গ্রামগুলোতে আরো বাড়বে।

৮১ শতাংশের মৃত্যু হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মধ্যে
ডাব্লিউএইচওর সাপ্তাহিক পর্যালোচনায় আরো বলা হয়েছে, ডেঙ্গুতে মৃত ব্যক্তিদের ৫৫ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছে। দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে ২৬ শতাংশ, চার থেকে পাঁচ দিনে মধ্যে ৭ শতাংশ, ছয় থেকে ১০ দিনে ৯ শতাংশ ও ১০ দিনের বেশি সময় হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর মারা গেছে ৩ শতাংশ।

ওই পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, যারা মারা গেছে তাদের ৬৪ শতাংশের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম দেখা গেছে। ২৪ শতাংশের এক্সপানডেড ডেঙ্গু। ৮ শতাংশের ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার। আর মৃত ব্যক্তির ৪ শতাংশের অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের সঙ্গে ডেঙ্গুও ছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আক্রান্তদের এ পরিসংখ্যান শুধু হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ওপর। এর বাইরে কয়েক গুণ রোগী কমিউনিটিতেও আছে। গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। অনেকে পরীক্ষা করেছে কিন্তু ডকুমেন্টেড হয়নি অথবা অনেকে আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু পরীক্ষা করেনি অথবা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে যে তা জানেও না। এসব রোগী আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।’

তিনি বলেন, বিশেষ করে যারা দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে জটিলতাগুলো বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে অনেকে মৌসুমি জ্বরের সঙ্গে ডেঙ্গু মিলিয়ে ফেলে বিভ্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে যখন আসবার কথা তখন আসছে না।
গুরুত্বপূর্ণ সময়টি অবহেলা করে হাসপাতালে আসছে একেবারে শক নিয়ে। যারা মারা গেছে তাদের বেশির ভাগ ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে মারা গেছে।

ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘শক সিনড্রোম, এক্সপানডেড ডেঙ্গু, হেমোরেজিক ফিভার যাই হোক, এটি হতে কিন্তু সময় লাগে। কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ সময় রোগী হাসপাতালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। সেই জন্য আমরা বারবার বলছি, জ্বর হলে প্রথম দিনই হাসপাতালে যেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরীক্ষা করতে হবে। যারা বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে তাদের বিপদ চিহ্নগুলো দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে আসতে হবে।’

ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্ত বাড়ছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে এক হাজার ৭১৬ জন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলার। ঢাকায় ৮৯২ জন। গত ২০ দিনের বেশি সময় ধরে ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক প্রধান কীটতত্ত্ববিদ মো. খলিলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকার বাইরে যশোর ও সাতক্ষীরা এলাকায় শতভাগ এডিস এলবোপিটাস মশা, এ ছাড়া অনেক জায়গায় ৩৫ শতাংশ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত এডিস মশা পাওয়া যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে যদি এলবোপিটাস মশা দ্বারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন হবে। কারণ সেখানে মশা নিধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার ইত্যাদি রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে এডিস মশা। এ মশার যে দুটি প্রজাতি আমাদের দেশে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের ভাইরাস বহন করে, সেগুলো হলো এডিস এজিপ্টি ও এডিস এলবোপিটাস।’

https://www.kalerkantho.com/online/national/2023/09/04/1314835