৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১২:৩৪

অনুমোদন ছাড়াই চলছে অর্ধেকের বেশি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল

নীতিমালা না থাকায় খরচ লাগামহীন

সরকারের অনুমোদন ছাড়াই চলছে অর্ধেকের বেশি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। ফলে অনেক মানহীন স্কুলে ভর্তি হয়ে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করতেও পারছে না অনেক শিক্ষার্থী। বর্তমানে দেশের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা ও আইন না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থাও নিতে পারছে না শিক্ষা বোর্ডগুলো। ফলে লাগামহীন খরচের বোঝাও চাপছে অভিভাবকদের কাঁধে।

সূত্র মতে, সরকারি হিসেবেই দেশে এখন ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৩৯টি। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডগুলোর অনুমোদনের তোয়াক্কা না করেই পাঠ্যক্রম ও অন্যান্য শিক্ষা এবং সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএমএসএবি) বলছে, দেশে বর্তমানে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৫০ এর বেশি। অর্থাৎ সরকার ও সংশ্লিষ্ট তদারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই চলছে দেশের অর্ধেকের বেশি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষালয়।

এদিকে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর কমিটি থেকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল পরিচালনা সংক্রান্ত একটি আইন ও নীতিমালা করার প্রস্তাব দেয়া হলেও এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতিমালা হয়নি। ফলে এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের ৫ জুন নির্দেশিত ১৯৬২ সালের রেজিস্ট্রেশন অব প্রাইভেট স্কুলস অর্ডিন্যান্সের ক্ষমতাবলে বিদেশী কারিকুলামে পরিচালিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নীতিমালা-২০১৭ মোতাবেক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রাপ্ত অনুমোদনে চলছে এসব প্রতিষ্ঠান। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা অ্যাকাডেমি (নায়েম) থেকে এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা করে তা সর্বশেষ ২০২২ সালে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা থাকলেও তা পাঠানো হয়নি।

অন্যদিকে দেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো আইন ও নীতিমালা না থাকায় সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। এতে টিউশন ফি, পরীক্ষার ফি, ভর্তি ফিসহ নানা ফি ও খরচাদি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো করে ঠিক করে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত অনেক ফি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করে থাকে যা অপ্রয়োজনীয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন খাতে গৃহীত এসব ফি শিক্ষার্থীদের পেছনে কতটুকু খরচ করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তাদের। তবে দেশে এসব নামীদামি প্রতিষ্ঠান শিক্ষা বিস্তার ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে কতটুকু ভূমিকা রাখছে এমন প্রশ্নে কোনো আশার আলো দেখছেন না শিক্ষাবিদ ও দেশের শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

যদিও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা ও আইন না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না শিক্ষা বোর্ডগুলো। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর কমিটি থেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পরিচালনা সংক্রান্ত একটি নীতিমালা করার প্রস্তাব দেয়া হলেও দেশে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ব্যয়বহুল ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভর্তিসহ ন্যূনতম এক বছর পড়াশোনা করতে খরচ হয় সর্বনিম্ন দুই লাখ থেকে শুরু করে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়াও এসব প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের পড়াশোনা করাতে নানা খাতে আরো বিভিন্ন ধরনের অর্থ খরচ করতে হয় অভিভাবকদের। তবে সাম্প্রতিককালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, তারা চেষ্টা করছে খরচের সাথে মানের সমন্বয় করে সেবা দিতে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো আইন বা নীতিমালা না থাকায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো ব্যবস্থা বা কাঠামোয় দাঁড় করাতে পারছে না সরকার। ফলে অনুমোদন ছাড়াই চলছে অর্ধেকেরও বেশি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সর্বশেষ প্রতিষ্ঠিত দু’টিসহ ১৩৯টি। এর মধ্যে ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেলের সংখ্যা যথাক্রমে ৩০ এবং ৯২। এ ছাড়াও জুনিয়র স্কুল রয়েছে ১৫টি। ব্যানবেইসের প্রতিবেদন বলছে, বিগত বছরের তুলনায় দুই হাজার ৬৩১ জন শিক্ষার্থী বেড়ে দেশে বর্তমানে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭১ হাজার ৪৫৬ জন। আর এসব শিক্ষার্থীকে পাঠদানের দায়িত্বে রয়েছেন ৯ হাজার ৬৬৬ জন শিক্ষক। এ ছাড়াও দেশে এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে আরো দু’টি প্রতিষ্ঠান।

সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে ব্রিটিশ কারিকুলামভিত্তিক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ‘অর্ডিনারি লেভেল’, সংক্ষেপে ‘ও’ লেভেল এবং পরবর্তী নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী ‘অ্যাডভান্স’ লেভেল, সংক্ষেপে ‘এ’ লেভেল হিসেবে গণ্য করা হয়। পরবর্তী শিক্ষা-স্তরে এ-১ ও এ-২ শ্রেণীভুক্ত। এর পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন হয় যুক্তরাজ্যের স্কুল-কলেজের আদলে। এ ছাড়াও দেশে ইংরেজি মাধ্যমের পাশাপাশি ‘ইংলিশ ভার্সন’ নামেও শিক্ষাদান হয় মাতৃভাষা ছাপিয়ে। রাজধানীর কয়েকটি নামকরা প্রতিষ্ঠানের ফি তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে বছরে প্লে গ্রুপ কিংবা কেজি ওয়ান অথবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা করতে খরচ করতে হয় সর্বনিম্ন দুই হাজার ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার ডলারের সমান বাংলাদেশী মুদ্রা।

বিভিন্ন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তারা স্কুলের অতিরিক্ত মুনাফার লোভে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অভিভাবকদের আবেগকে পুঁজি করে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো দিনদিন টিউশন ফি বাড়িয়েই চলেছে। সেই সাথে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর এই অতি বাণিজ্যিক আচরণের কারণে অভিভাবকদের অনেকেই এখন দিশেহারা। গত ২৬ আগস্ট ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে করেছেন বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্যারেন্টস ফোরাম। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর রি-অ্যাডমিশন ফি নেয়া অবিলম্বে বন্ধ, মাসিক টিউশন ফি যৌক্তিককরণসহ পাঁচ দফা দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস আজম খান বলেন, আমাদের এই আবেগকে পুঁজি করে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো দিনদিন টিউশন ফি বাড়িয়েই চলেছে। এ ছাড়া বছর বছর রি-অ্যাডমিশন ফি নিচ্ছে আদালতের আদেশ এবং সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে। কিছু কিছু বড় স্কুল আবার রি-অ্যাডমিশন ফিকে বারো মাসের মধ্যে ভাগ করে টিউশন ফি অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিয়েছে।

ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো ১১ সদস্য বিশিষ্ট ম্যানেজিং কমিটি থাকা প্রসঙ্গে সংগঠনটি সভাপতি এ কে এম আশরাফুল বলেন, একটি স্কুলে অধ্যক্ষ, ছয়জন মালিক পক্ষের, দু’জন শিক্ষক প্রতিনিধি ও দু’জন অভিভাবক থাকার কথা। কিন্তু সেটি স্কুলগুলো মানছে না। আমরা চাই নির্বাচিত দু’জন অভিভাবকদের মধ্যে একজন মা ও একজন বাবা থাকুন ওই কমিটিতে। কারণ, এই দুইজন প্রতিনিধি থাকলে নোট অফ ডিসেন্ট থেকে অভিভাবকদের পক্ষে একটি ভূমিকা রাখতে পারবেন। অভিভাবকরা মনে করেন, স্কুলগুলোতে ম্যানেজিং কমিটিতে অভিভাবক প্রতিনিধি না থাকাতে তারা লাগামহীনভাবে স্কুলগুলো পরিচালনা করছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দু’টি প্রতিষ্ঠানের প্রধান বলছেন, তারা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ও সেবা প্রদান করছে। এ সেবার বিপরীতেই তাদের বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এখানে শিক্ষা, সহশিক্ষাসহ আনুষঙ্গিক সব বিষয় জড়িত থাকে। এছাড়াও বর্তমানে প্রযুক্তি, নৈতিকতা এবং সফটস্কিলসহ নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে বলেও দাবি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর।

দেশে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো আইন বা নীতিমালা না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, এর সাথে অনেকগুলো বিষয় জড়িত আছে। এ নিয়ে আমরা শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময় বলেছিলাম। কিন্তু আমরা কোনো নীতিমালা বা আইন করতে পারিনি। এটি কেন হয়নি বা সরকার করেনি তা আমি বলতে পারব না। এ সংক্রান্ত আইন বা নীতিমালা থাকা উচিত। বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন বা কোনো নীতিমালার বাইরে চলা উচিত না। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার নিবন্ধনহীন প্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানদের ভর্তি না করার আহবান জানিয়ে বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন না থাকলে আমরা আমাদের কোনো কার্যক্রমে তাদের অন্তর্ভুক্ত করি না। এখন কোনো প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন না থাকলে আমাদের তো কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নেই যে, শিক্ষা বোর্ড তাদের ধরে এনে নিবন্ধন নিতে বাধ্য করবে। তিনি আরো বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের কাছে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলে আমরা তাদের প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে অনুমোদন দিয়ে থাকি। কাউকে তো আমরা চাইলেই নিবন্ধনের জন্য বাধ্য করতে পারি না। দেশে এ সংক্রান্ত কোনো আইন নেই।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/774727