৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১২:২৩

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রসঙ্গে

আশিকুল হামিদ

দেশপ্রেমিক বিভিন্ন দল ও মহলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরাও বলেছিলাম, ‘ভাবিয়া করিও কাজ’। বলতে হয়েছিল সংবিধান নিয়ে সরকারের বাড়াবাড়ির পরিপ্রেক্ষিতে। রাজনৈতিক অর্থে সরকারের এই বাড়াবাড়িকে প্রতারণার চেষ্টা হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছিল। এটা ২০১১ সালের কথা। প্রতারণার চেষ্টা বলার কারণ, আদালতের ‘রায়ের আলোকে’ সংবিধানের খোলনলচে পাল্টে ফেলার জন্য ক্ষমতাসীনরা সে সময় এমনভাবেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, যা দেখে মনে হচ্ছিল যেন তাদের হাতে আর কোনো কাজ নেই! তখন বলা হয়েছিল, ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর, ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার এবং বিনামূল্যে সার দেয়ার মতো অঙ্গীকারগুলোর কথা এখন আর তারা ভুলেও স্মরণ করেন না। কেউ স্মরণ করিয়ে দিতে গেলে পুলিশকে দিয়ে লাঠিপেটা করান। একযোাগে আবার মোবাইল কোর্টের নামে ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে জেলের ভাত খাওয়ানোও শুরু হয়েছিল তখন।

এভাবে নিবন্ধ শুরু করার প্রধান কারণ হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১১ সালের ২০ জুন অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ সংসদীয় কমিটির ৫১ দফা সুপারিশের ভিত্তিতে। ৫১ দফায় সংবিধানের কোন কোন স্থানে সংশোধনী আনার সুপারিশ করা হয়েছিল সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বিশেষ কিছু তথ্যের উল্লেখ করা দরকার। এরকম একটি তথ্য হলো, ২০১১ সালেরই ১৬ মে বিদায় নেয়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সঙ্গে তখন সরকারের ‘গোপন যোগসাজশ ও সমঝোতা’ নিয়ে নতুন করে কথা উঠেছিল। কারণ, সংসদীয় কমিটির পরামর্শে ১০ ফেব্রুয়ারি আইন মন্ত্রণালয় যেভাবে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করেছে ঠিক সেভাবেই ১০ মে রায় দিয়েছিল বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। অর্থাৎ আগে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়েছে, তারও তিন মাস পর পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের নামে ব্যবস্থাটিকে বাতিল ঘোষণা করেছিল পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। অন্য একটি তথ্য হলো, একই বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পুরোটাই বাতিল ঘোষণা করেছিল। আপিল বিভাগও রায়টিকে বহাল রেখেছিল। এর পরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধান পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল ১০ ফেব্রুয়ারি (২০১১)। অথচ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে তখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে শুনানিই শুরু হয়নি। শুনানি শুরু হয়েছিল ১ মার্চ থেকে, ‘সংক্ষিপ্ত আদেশের’ আকারে যার রায় ঘোষিত হয়েছিল ১০ মে। অথচ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছিল ১০ ফেব্রুয়ারি। এর একটি মাত্র ব্যাখ্যাই হতে পারেÑ প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করেছিলেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা একে ‘গুরুতর বিষয়’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছিল, সরকার আদালতের রায়ের আলোকে ব্যবস্থা নিয়েছে, নাকি আদালতই সরকারের ইচ্ছার আলোকে রায় ঘোষণা করেছে?
এ ধরনের প্রশ্ন ওঠাই ছিল স্বাভাবিক। কারণ, এমন এক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করেছিল যিনি সরকারের কাছ থেকে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ২৫০ টাকা ‘ত্রাণ’ নেয়াসহ ব্যক্তিগত কিছু কীর্তির কারণে নিন্দিত হয়েছিলেন। এই ‘ত্রাণ’ নেয়ার মাস খানেক আগে এক রায়ে তিনি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বানিয়ে রায় ঘোষণা করেছিলেন। বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে তিনিই আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বাতিল ঘোষণা করে গেছেন। এ খবরও গোপন থাকেনি যে, পুনর্মুদ্রণের নামে সরকার যেভাবে সংবিধানে সংশোধন করেছে ঠিক সেভাবেই রায় দিয়েছে খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। সরকার অবশ্য বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক তথ্য জনগণকে জানতে দেয়নি। এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে তৎপরতা চালিয়েছিল সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ সংসদীয় কমিটি। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে রাখা দূরে থাকুক, দল দুটির বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন বিশেষ সংসদীয় কমিটির কো-চেয়ারম্যান মিস্টার সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এই কমিটি অখ্যাত ও প্রত্যাখ্যাত এমন কিছু দল ও সংগঠনকে নিয়ে আসর মাতিয়েছিল, যারা শুধু জনবিচ্ছন্ন নয়, যাদের কারো কারো বিরুদ্ধে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে নেয়ার লক্ষ্যে অপতৎপরতা চালানোর অভিযোগও ছিল। এজন্য এবং বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় সংসদীয় বিশেষ কমিটি প্রথম থেকেই বিতর্কিত হয়েছিল।

তা সত্ত্বেও কমিটি যে ৫১ দফা সুপারিশ তৈরি করেছিল তার মধ্যে জনগণের আশা-আকাংক্ষার প্রতিফলন তো ঘটেইনি, উল্টো বিপরীত অনেক কিছু ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই ৫১ দফা সুপারিশ নিয়ে কমিটি ৩০ মে (২০১১) প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিল। উল্লেখ্য, সুপারিশগুলো নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যেও মতপার্থক্য প্রকাশ্যে এসেছিল। যেমন কমিটির দুই সদস্য রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের প্রশ্নে কঠোরভাবে আপত্তি জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংসদে বলেছিলেন, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া রায়টি ‘পরিপূর্ণ’ নয় এবং এর মধ্যে ‘বৈপরীত্য’ রয়েছে। পাশাপাশি প্রকাশিত খবরে জানা গিয়েছিল, সংসদীয় বিশেষ কমিটির পক্ষ থেকেও নাকি রায়টির ব্যাখ্যা ও পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়া সাপেক্ষে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবটিকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। মূলত শেখ হাসিনার জেদের কারণেই কমিটি নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার সুপারিশ করতে বাধ্য হয়েছিল।

অন্যদিকে ২০১১ সালের ৫ এবং ১২-১৩ জুন হরতাল পালনের মধ্য দিয়ে জনগণ কিন্তু সংবিধানের ব্যাপারে নিজেদের আকাংক্ষা ও অভিমতের স্পষ্ট প্রকাশ ঘটিয়েছিল। প্রমাণিত হয়েছিল, আদালতের দোহাই দিয়ে সংবিধান সংশোধনের যে চেষ্টা সরকার করছে জনগণ সে চেষ্টাকে সমর্থন করে না। ক্ষমতাসীনরা যে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যই আদালতের রায়কে অজুহাত বানিয়েছেন সে কথাও বুঝতে পেরেছিল জনগণ। প্রসঙ্গক্রমে আলোচনার প্রাধান্যে এসেছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। কারণ, চাকরিতে থাকাকালে এমন কিছু রায় তিনি দিয়েছিলেন যেগুলো দেশের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করেছে। বিদায়ের প্রাক্কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া রায়ের মাধ্যমেও তিনি তিনি রাজনৈতিক সংকট ও সংঘাতকেই অনিবার্য করে গেছেন।

এদিকে সংবিধানকে লন্ডভন্ড করে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বিতর্কিত ও জনগণের পর্যায়ে প্রত্যাখ্যাত যে কয়েকটি রায় জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে রেখে গেছেন সেগুলোর ‘আলোকেই’ সরকার সংবিধান সংশাধন করতে সচেষ্ট হয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে প্রথমে ৫১ দফা সুপারিশ তৈরি করেছিল সংসদীয় বিশেষ কমিটি। মন্ত্রিসভার বৈঠকে সেসব সুপারিশই গ্রহণ করা হয়েছে। সেগুলোকেই অনির্বাচিত আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ জাতীয় সংসদে বিল আকারে উত্থাপন করেছিলেন। আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতে এর ভিত্তিতে রচিত ৫১ দফার যাচাই-বাছাই করা হয়েছিল। সেখানে অনুমোদন দেয়ার পরই বিলটি আবারও সংসদে উত্থাপ করেছিলেন সংশ্লিষ্টজনেরা। তারপর এসেছিল ৫১ দফার প্রস্তাবনা। সংবিধানের এই প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ রাখা হলেও ব্র্যাকেটে দুটি অনুবাদ দেয়া হয়েছিল। এ দুটির মধ্যে দ্বিতীয়টি ছিল অশুদ্ধÑ ‘পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’। কারণ, রাহমান বা রাহীমের অর্থ ‘করুণাময় সৃষ্টিকর্তা’ নয়। তাছাড়া সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ কথাগুলো বাদ দেয়া হয়েছিল। ৫১ দফায় সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা। রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত ২(ক) অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে তারা বলেছিলেন, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম। তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সম-অধিকার নিশ্চিত করবে।

৫১ দফায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে ঘোষণা করে তার ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত বিতর্কিত টেলিগ্রাম এবং ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। দেশে-বিদেশে সকল সরকারি অফিস, দূতাবাস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ঝোলানো ও প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক করারও প্রস্তাব করা হয়েছিল । ৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে ‘বাঙালি’ এবং নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে পরিচিত হবে। ৫১ দফায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত ৫৮ ২-ক পরিচ্ছেদ (অনুচ্ছেদ ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ, ও ৫৮ ঙ) বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এর অর্থ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাবে। ৭(খ) অনুচ্ছেদে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত বিধানগুলোকে সংশোধনের অযোগ্য ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়েছিলÑ যার অর্থ ভবিষ্যতে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর কোনো সংশোধন করা যাবে না।

সংসদীয় বিশেষ কমিটির সুপারিশ গ্রহণের আড়ালে এভাবেই সংবিধানকে একশ’ভাগ আওয়ামীকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মন্ত্রিসভা। অন্য কিছু বিষয়ের সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছিল বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে। কারণ, এর পেছনে রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ ইতিহাস। একটি রিট আবেদনের শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট হাই কোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল। সে রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের ১ মার্চ। ১৬ মে বিদায় নেয়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চকে সহায়তা করার জন্য ১০ জন সিনিয়র আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্তি দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ড. এম জহির, ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি প্রমুখ শুনানিতে বক্তব্য রেখেছিলেন। কিছু সংস্কার ও পরিবর্তনের সুপারিশ করলেও ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ছাড়া অ্যামিকাস কিউরিদের প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন।

কিন্তু দিনের পর দিন ধরে সংবিধানসম্মত ব্যাখ্যা ও বক্তব্য শোনার পরও একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়েছিল, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরাও আদালতের এই ফরমায়েসী রায় বাস্তবায়নের জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। অথচ অজুহাত হিসেবে যে রায়কে অবলম্বন করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে চিহ্নিত সে রায়টি একই সঙ্গে স্ববিরোধিতাপূর্ণ হিসেবেও বিতর্কিত হয়েছিল। কারণ, রায়ে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়নি, একথাও বলা হয়েছিল যে, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া এটা ছিল একটি বিভক্ত রায়। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সাত সদস্যের মধ্যে কতজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন এবং তারা ঠিক কী অভিমত দিয়েছিলেন সেকথা এখনও অপ্রকাশিত রয়েছে। বড় কথা, রায়ের নামে যা ঘোষণা করা হয়েছিল তা আসলে ছিল একটি ‘সংক্ষিপ্ত আদেশ’, পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সাংবিধানিক বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু সরকার সে পদক্ষেপই নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলে বসেছিলেন, আদালত অবৈধ ঘোষণা করায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার নাকি ‘আর কোনো সুযোগ নেই’! প্রধানমন্ত্রী সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়া অভিমতটুকুর উল্লেখ পর্যন্ত করেননিÑ যেখানে বলা হয়েছিল, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।

এভাবে সব মিলিয়েই আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সংবিধানের নাড়ি ধরে টান মারার এবং সংবিধানের খোলনলচে পাল্টানোর পদক্ষেপ নিয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা এমন এক সাবেক প্রধান বিচারপতির তৈরি করা পথে পা বাড়িয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ‘প্রতিনিধিত্ব’ করার অভিনয় করে যিনি দেশের সংবিধানকেই ‘লন্ডভন্ড’ করে ফেলেছেন বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতাসীনরা ওই বিচারপতির প্রকৃত উদ্দেশ্যসহ অন্য কোনো সম্ভাবনাকে বিবেচনায় পর্যন্ত নেননি। তারা ভাবতেই চাননি, খায়রুল হক আসলে অন্য কোনো গোষ্ঠির জন্য ‘পথ পরিস্কার’ করে গেছেন কি না। কারণ, তখন একথাও বলা হয়েছিল যে, এই বিচারপতির দেয়া রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধন করতে গেলে রাজনৈতিক সংকট তো ঘনীভূত হবেই, বিঘিœত হবে ‘দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা’ও। আর এ ধরনের পরিস্থিতির সুযোগই সাধারণত ‘উদ্দিন’ সাহেবরা নিয়ে থাকেন। তাই বলে প্রত্যেকবারই তারা আওয়ামী লীগের ‘আন্দোলনের ফসল’ হিসেবে দেশের একই বিশেষ এলাকা থেকে এসে হাজির হন না। আসেন বিভিন্ন এলাকা খেকে এবং যুক্তিও হাজির করেন নানা রকমের। এজন্যই সংবিধান এবং নির্বাচনের প্রশ্নে দেশপ্রেমিক পর্যবেক্ষকরা সম্প্রতি আবারও সতর্ক করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ভাবিয়া করিও কাজ’।

https://www.dailysangram.info/post/534482