৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১২:২১

রিজার্ভ সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে

আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ কমতে কমতে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। পরিস্থিতি আবারো স্বাভাবিক পর্যায়ে আসবে বলে সরকার পক্ষ জোরালো প্রচার-প্রচারণা চালালেও বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বরং পরিস্থিতির ধারাবাহিকভাবেই অবনতি হচ্ছে। দেশে তীব্র ডলার সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ায় কোন কোন ক্ষেত্রে রিজার্ভ থেকে অর্থের যোগান দিতে হচ্ছে। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি আগামী দিনে আরও অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, চলতি সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এবার জুলাই-আগস্ট সময়ের জন্য সুদসহ ১১০-১২০ কোটি ডলার আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে। গত বুধবার আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৩০৬ কোটি ডলার। ফলে আকু বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে আসবে। আর এই ঘাটতি পূরুণ কোনভাবেই সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। যা রীতিমত উদ্বেগজনকই মনে করা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত মাসে মে-জুন সময়ের জন্য ১১০ কোটি ডলারের আকু বিল পরিশোধ করা হয়। জুলাই-আগস্ট সময়ে আমদানি এর সমপরিমাণ ছিল। ফলে এবারও প্রায় সমপরিমাণ দায় শোধ করতে হচ্ছে। এ দায়ের জন্য ৫ শতাংশের বেশি হারে সুদ পরিশোধ করার আবশ্যকতাও রয়েছে।

মূলত, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি আন্ত-আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিব্যবস্থা। এর মাধ্যমে এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়। তবে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়। আকুর সদস্যদেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রতি এ তালিকা থেকে বাদ পড়েছে শ্রীলঙ্কা। আকুর বাকি দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে দুই মাস পরপর লেনদেনের অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এসব দেশের মধ্যে ভারত পরিশোধ করা অর্থের তুলনায় অন্য দেশ থেকে বেশি ডলার আয় করে। বাকি বেশির ভাগ দেশকে আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত ডলার খরচ করতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, আকু দেশগুলো থেকে যে পণ্য আমদানি হয়, ব্যাংকগুলো তার মূল্য হিসেবে প্রতি সপ্তাহেই ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়। প্রতি দুই মাস শেষে ব্যাংকগুলোর পক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ দায় পরিশোধ করে থাকে। তখন রিজার্ভ হঠাৎ কমে যায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৪৩২ কোটি ডলারের ঋণপত্র খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। গত বছরের একই মাসে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৬৩৫ কোটি ডলারের। সে হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত জুলাইয়ে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৩১ দশমিক ১৯ শতাংশ।

২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ওই অর্থবছরে আমদানিতে খরচ হয় ৭ হাজার ৫০৬ কোটি ডলার। তার আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানিতে খরচ হয়েছিল ৮ হাজার ৯১৬ কোটি ডলার। গত বছরের ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পায় এবং ডলারের সঙ্কট তীব্র হয়ে ওঠে। এরপর আমদানি কমাতে নানা শর্ত ও কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক বসায়। এরপর কমতে শুরু করে আমদানি ব্যয়। কিন্তু দেশে আমদানিনির্ভর পণ্যের তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়।

নানাবিধ কারণেই আমাদের রিজার্ভ পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক পর্যায়েই অগ্রসর হচ্ছে। মূলত, চলমান তীব্র ডলার সঙ্কট মোকাবেলা করতেই পরিস্থিতির আশঙ্কাজনকভাবে অবনতি হয়েছে। এমতাবস্থায় আকুর দায় পরিশোধ করতে গেলে রিজার্ভ পরিস্থিতিতে আরেক দফা অবনতি হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এবস্থাবস্থায় সার্বিক সামাল দিতে রাষ্ট্রে সকল ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতা সাধনের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। একই সাথে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণেও গতি আনা দরকার। অন্যথায় আগামী দিনে রিজার্ভ সঙ্কট আরো তীব্রতা পাবে।

https://www.dailysangram.info/post/534481