৩১ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৯:১৯

সিন্ডিকেটের ‘লম্বা হাত’

দিন দশেক আগে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপের খবরে বাংলাদেশের বাজারে পণ্যটির দাম বাড়ে কেজিতে ২০ টাকা। অথচ দেশে বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকের ঘরে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। তুলকালাম কাণ্ড ঘটে কাঁচামরিচের বাজারেও। সরবরাহে ঘাটতির অজুহাতে প্রতি কেজি কাঁচামরিচের দাম ১০০ টাকা থেকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে হাজার টাকায় পৌঁছে।

এদিকে, গত এপ্রিল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দর নিম্নমুখী। কিন্তু দেশের বাজারে পণ্যটির দাম ঊর্ধ্বমুখী। সরকার বারবার দাম বেঁধে দিলেও তা কার্যকর হয়নি। একইভাবে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেল ও গুঁড়া দুধের দাম কমলেও দেশের বাজারে কমেনি।

কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতি? বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডলার সংকট, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন কম ইত্যাদি অজুহাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মুষ্টিমেয় করপোরেট প্রতিষ্ঠান। নানা কায়দায় সিন্ডিকেট গড়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় তারা। ভোক্তারা বাড়তি দামের চাপে পড়লেও সরকারের মন্ত্রী-সচিবরা বলছেন, ‘সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়’ তারা।

অর্থনীতিবিদ ও ভোক্তা অধিকার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে সিন্ডিকেট প্রতিরোধ করতে হবে। কারা সিন্ডিকেটে জড়িত, তা সরকারের নীতিনির্ধারকরাও জানেন। তবে সিন্ডিকেটে জড়িতদের হাত এতই লম্বা যে, তা ভাঙা দুরূহ। রাজনীতির ঊর্ধ্বে এসে ব্যবস্থা না নিলে সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয়। তবে রাষ্ট্র চাইলে যে কোনো সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

গত ২৬ জুন সংসদে বিরোধী দলের তোপের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বড় গ্রুপগুলোকে জেল-জরিমানা করা যায়; কিন্তু তাতে হঠাৎ যে সংকট তৈরি হবে, তা সইতে কষ্ট হবে। তাই আলোচনার মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হয়।’ গত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘শুধু জেল-জরিমানা ও পুলিশ দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কোনো সমাধান নয়।’ অনেকেই মনে করেন, মন্ত্রী-সচিবদের এসব বক্তব্যের সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করেন এক সাংবাদিক। উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সিন্ডিকেট থাকলে তা ভাঙা যাবে না– এটা হতে পারে না। সিন্ডিকেট কত শক্তিশালী, তা দেখব।’ এ ব্যাপারে তিনি বাণিজ্যমন্ত্রীকে ‘ধরবেন’ বলে জানান। তবে গতকাল বুধবার এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, ওই সংবাদ সম্মেলনের পর প্রায় দুই ঘণ্টা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন; কিন্তু এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে কিছু বলেননি, তিনিও তাঁকে কিছু বলেননি।

সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর ঘটনা বেশি ঘটে নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে। তবে কারা ওই সিন্ডিকেটে জড়িত, তা থেকে যায় আড়ালে। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে চিনির বাজার মূলত সিটি, মেঘনা, এস আলম, দেশবন্ধু ও আবদুল মোনেম গ্রুপের হাতে। ভোজ্যতেলের বাজারে আধিপত্য এস আলম, সিটি, মেঘনা, টি কে, বসুন্ধরা, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলসহ কয়েকটি কোম্পানির। এসব কোম্পানির মালিকরা সবাই কমবেশি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। নানা সময়ে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে বাজারে কারসাজির অভিযোগ উঠলেও দৃশত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

কারসাজির অভিযোগ ওঠার পর চাল, তেল, ডিম, মুরগি, লবণ, কাগজ, টয়লেট্রিজ, রড, সিমেন্টসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম নিয়ে সমীক্ষা শুরু করে ‘বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন’। এর মধ্যে গত বছর এসব পণ্যের ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ৪৫টি মামলাও করে তারা। এর মধ্যে চাল ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ২১টি, ডিম-মুরগি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ছয়টি ও ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আটটি মামলা বেশ আলোচনায় আসে। তবে এখন পর্যন্ত ওই সব মামলার কোনো সুরাহা হয়নি।

ভারতের শুল্ক আরোপের প্রভাব
সপ্তাহ দুয়েক আগেও আমদানি করা দেশি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়; কিন্তু এখন ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। আমদানি পেঁয়াজের দামও কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়ে হয়েছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকা। সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য বলছে, এক বছরে পণ্যটির দাম বেড়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। একইভাবে রসুনের দামও বেড়েছে ২২৮ শতাংশ।

দেশে কমেনি তেল-চিনির দাম
গত মাসে বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমলেও দেশে সেই হারে কমেনি; বরং দু’দিন ধরে পণ্যটির দাম বাড়ছে। টিসিবির হিসাবে এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। একইভাবে কয়েক মাস ধরে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমলেও দেশের ব্যবসায়ীরা সেই হারে দাম কমাননি।

প্যাকেট চাল পকেট কাটছে ক্রেতার
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত ৫০ বছরে দেশে চালের উৎপাদন চার গুণ বেড়েছে। তবুও স্থির নয় চালের বাজার। ভরা মৌসুমেও চালের দামে নাকাল হচ্ছে ভোক্তা। নতুন করে ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশে চালের দাম বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অনেকের ধারণা, এ ক্ষেত্রেও বাজার কারসাজি বা সিন্ডিকেট হতে পারে।

চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্যটির ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও মৌসুমি ব্যবসায়ী। তারা ধান কিনে চাল মজুত করে এবং চাহিদা বাড়লে বাড়তি দামে তা বিক্রি করে। এতে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাদের হাতে।
চলতি বছর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি.) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করপোরেট প্রতিষ্ঠান চালের বাজারে ঢুকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। ধান-চালের বাজারে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে পাঁচবার তা হাতবদল হয়। প্রতিবার হাতবদলের সময় যোগ হয় খরচ ও মুনাফা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেন চালকল মালিকরা। তারা প্রতি কেজি চাল ও এর উপজাত বিক্রি করে ৮ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করেন।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গত বছর এক অনুষ্ঠানে চালের দাম বাড়ার পেছনে ছয় করপোরেট প্রতিষ্ঠান– এসিআই, আকিজ, বসুন্ধরা, প্রাণ, সিটি ও স্কয়ার গ্রুপকে দায়ী করেন।

কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের তদারকি প্রতিষ্ঠান চালের বাজার কারসাজিতে জড়িতদের পরিচয় জেনেও নিশ্চুপ থাকছে। ফলে বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না।

হাতবদলে বাড়ছে ডিম-মুরগির দাম
ডিম-মুরগির দাম এখন বেশি চড়া। সরকারের হুঁশিয়ারির পরও দাম কমার লক্ষণ নেই। ব্যবসায়ীরা জানান, খামারি থেকে খুচরা পর্যায়ে আসা পর্যন্ত চার হাত ঘোরে ডিম। উৎপাদক, ডিলার, পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ীরা তাদের খরচ ও মুনাফা যুক্ত করে ভোক্তা পর্যায়ে ডিম বিক্রি করেন। ঢাকার কাপ্তানবাজার, কারওয়ান বাজার ও তেজগাঁওয়ের ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন মোবাইল ফোনে মেসেজ দিয়ে ডিমের দাম জানিয়ে দেন। ওই দামে ডিম বিক্রি করতে চাইলে স্থানীয় মধ্যস্থতাকারী খামারে গাড়ি নিয়ে আসেন। তবে ডিমের বাজারে সমন্বয়ের অভাবকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি শামসুল আরেফিন।
গরুর মাংসের বাজারও এখন বেশ চড়া। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। খামারিদের অভিযোগ, মহিষের মাংস আমদানি বন্ধের পর থেকে একটি গ্রুপ গরুর মাংসের বাজার অস্থিতিশীল করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এই চক্রের মধ্যে আছে আমদানিকারক, মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ও রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি।

যেভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কয়েকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ নিত্যপণ্যের ব্যবসা মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে। এরা অলিগোপলি বাজার সৃষ্টি করে রাখে। একজন দাম বাড়ালে অন্যরা তা অনুসরণ করে। তারা ঝোপ বুঝে কোপ মারে। এভাবে ভোক্তার পকেট কাটা হচ্ছে বছরের পর বছর। বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় এমন কারসাজি।

গোলাম রহমান বলেন, দাম যে শুধু বড়রা বাড়ায়, তা নয়। সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীর মধ্যে অতি মুনাফার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। খুচরা থেকে উৎপাদনকারী– সবাই এখন সুযোগসন্ধানী। এ ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণে দুর্বলতা লক্ষণীয়।

সিন্ডিকেট সৃষ্টিকারীরা রাজনীতিতে সক্রিয়
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে সিন্ডিকেট চক্রকে কোনোভাবে রোখা যায় না বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান। সমকালকে তিনি বলেন, ‘যারা বাজার ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেট করছেন, তারা রাজনীতিতেও সক্রিয়। কারা সিন্ডিকেশনের সঙ্গে জড়িত, তা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরাও জানেন। তাই রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে তাদের আইনের আওতায় আনা হয় না।’

অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘শর্ষের ভেতরে ভূত আছে। সেই ভূত না তাড়ালে সমস্যার সমাধান হবে না। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ জেল-জরিমানা ছাড়াও সামাজিকভাবে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’ তাঁর মতে, প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা না গেলে বাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা কমিশন নখদন্তহীন। এ কারণে সিন্ডিকেট তাদের তোয়াক্কা করে না।

প্রতিযোগিতা কমিশনে অনেক চলমান মামলার প্রসঙ্গে ক্যাবের সভাপতি বলেন, ‘আইনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়; হয়ে ওঠে আরও বেপরোয়া। এতে উৎসাহিত হয় অন্যরা। তবে রাষ্ট্রের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নয়। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী সিন্ডিকেট ভাঙার বিষয়ে সম্মত, ভোক্তারা তাতে আশাবাদী।’

https://samakal.com/bangladesh/article/2308193149