৩১ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৯:০৬

মানসিক স্বাস্থ্যেও ডেঙ্গুর প্রভাব

আরও ৭ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ২৩৬৭

চলতি বছর দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর সংক্রমণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি হিসাবে আট মাসে ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে ১ লাখ ২১ হাজার ৫০০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৫৭৬ জন। মশা নিধনে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তাও অপরিকল্পিত। ফলে এডিস মশার দাপট কমছে না। এমন বাস্তবতায় ডেঙ্গু সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যেও। ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ছয় দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা সীমান্ত সীমা (৩০)। পরে তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু মানসিক সমস্যা এখনো কাটছে না। তার স্বামী আহমেদ হাসান জানান, সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ায় নিজের চেয়েও গর্ভের সন্তান নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন। অনেকেই বলেছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত গর্ভবতী নারীর পরিস্থিতি বেশি খারাপ হলে গর্ভের সন্তানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। চিকিৎসকরাও এমন তথ্য দিয়েছিলেন। তাই ডেঙ্গু শনাক্তের পর থেকেই স্ত্রীসহ পরিবারের সবাই মানসিকভাবে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে যাই। কিছুদিন ধরে আমার স্ত্রীও মানসিক ট্রমায় ভোগছেন।

দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের চন্দ্রিমা মডেল টাউন এলাকায় থাকেন আনোয়ার হোসেন। তিনি জানান, ওই এলাকায় প্রায় প্রতিটি ঘরে ডেঙ্গু ও ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত রোগী রয়েছে। মশার উৎপাতে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বিকালের পর মশার কামড়ের যন্ত্রণায় ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে রাখতে হয়। তিনি বলেন, প্রতিদিন বিকালে ছেলে-মেয়েরা বাইরে যাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। তখন বাধ্য হয়ে টেলিভিশন ও মোবাইল ফোনে কার্টুন বা গেম দেখিয়ে বাইরে যাওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করি। এরপরও বাচ্চারা অস্থির হয়ে পড়ে। বাইরে যেতে না পেরে কান্নাকাটি করে। মেজাজ খিটখেটে হয়ে থাকে।

ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে তিন দিন ধরে ভর্তি রয়েছে ১০ বছরের শিশু অরূপ। বুধবার শিশুটির মা আনোয়ারা বেগম যুগান্তরকে জানান, তার ছেলে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে পড়ে। ওই স্কুলের তিন শিক্ষার্থী ডেঙ্গুতে মারা গেছে। ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে তিনিও সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন থাকেন। তিনি জানান, গত সপ্তাহে যাত্রাবাড়ীতে বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়ে ছেলের জ্বর আসে। পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ ধরা পড়েছে। দেরি না করে এখানে ভর্তি করেছেন।

পাশে থাকা তার বোন আক্ষেপ করে বলেন, মশার আতঙ্কে মশারি কেটে ঘরের প্রতিটি জানালায় লাগিয়েছি। যাতে ঘরে মশা প্রবেশ করতে না পারে। এরপরও বোনের ছেলে ও তার ছেলে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরও সন্তানদের ডেঙ্গু হওয়ায় পুরো পরিবার মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, মশার কামড়ে ডেঙ্গু বা একে অপরের থেকে করোনা সংক্রমণের ভয়ে অনেকেই তাদের সন্তানদের বাইরে বের হতে দিচ্ছে না। সামাজিকভাবে একে-অপরের সঙ্গে খেলাধুলা বা মিশতে পারছে না। এতে সময় কাটানোর মাধ্যম হিসাবে তাদের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস যেমন: মোবাইল বা টেলিভিশনে গেম খেলা বা কার্টুন দেখার প্রতি ঝুঁকে পড়া স্বাভাবিক। তাদের মধ্যে ডিভাইস আসক্তি বেড়ে যেতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে এমনটা হলে বয়সভেদে তাদের বিদ্যালয়ে, কাজে, সামাজিকতায় বা বিভিন্ন জায়গায় সমস্যা তৈরি হবে। এতে শিশুর শারীরিক ও মনাসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব পড়তে পারে। এজন্য পরিবার, সমাজে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে গুরত্ব দেওয়া উচিত।
ওই চিকিৎসক আরও জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে পরিবারের কারও মৃত্যু হয়েছে বা কেউ নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন-এমন অনেকে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা নিয়ে আমাদের কাছে আসছেন। অনেক অভিভাবক জানান, সন্তানের জ্বরের কারণে বিদ্যালয়ে যাওয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় পরবর্তী সময়ে সহপাঠীদের সঙ্গে সহজে অ্যাডজাস্ট করতে পারছে না। বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের মধ্যে স্কুল ফেবিয়া দেখা দিয়েছে। বড় বাচ্চাদের মধ্যে বিষণ্নতা কাজ করছে। বড়দের ক্ষেত্রে পোস্ট ভাইরাল ডিপ্রেশন দেখা দিচ্ছে। এজন্য তাদের নিয়মিত সময় দেওয়া, ডেঙ্গুতে আতঙ্কিত না হয়ে প্রয়োজনে কাউন্সেলিং বা বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।

শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউিট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আহমেদ হেলাল যুগান্তরকে বলেন, কোনো বিষয় যখন প্রাণঘাতী হয়ে যায়, তখন সেটি মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলে। যেমন: করোনার সময় হয়েছে। এখন ডেঙ্গুতে প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। গড়ে ১২ থেকে ১৪ জন মারা যাচ্ছে। ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যুর হার বেশি। এতে ডেঙ্গু সংক্রমণের জন্য এডিস মশা নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্কিত হওয়াটা স্বাভাবিক। এটি মনোজগতের ওপর প্রভাব ফেলছে, উদ্বিগ্নতা বাড়াচ্ছে। স্ট্রেস কাজ করছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, উদ্বিগ্ন-আতঙ্কিত হলেও ডেঙ্গু থেকে মুক্তি মিলবে না। কারণ, এডিস মশা কখন কামড়াবে, কামড়ালে ডেঙ্গু হবে কি না, সেটি আমাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই।

তার পরামর্শ, মশার ভয়ে গৃহবন্দি না করে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা ও সহপাঠীদের সঙ্গে মিশতে দিতে হবে। এজন্য এডিস মশার জন্ম ও প্রজননস্থল নির্মূল করতে হবে। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আঙিনা পরিষ্কারে মনোযোগী হতে হবে। বাড়ির চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ঘুমানোর আগে মশারি টানাতে হবে। স্কুলে শিশুদের ফুলহাতা শার্ট বা ফুল প্যান্ট পরাতে হবে। এছাড়া মসজিদ, মন্দির, কর্মস্থল মশামুক্ত রাখতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। না হলে এডিস মশা বা ডেঙ্গু আতঙ্কে সমাজের সব বয়সিরই শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

হাসপাতালে আরও ২৩৬৭ রোগী, ৭ মৃত্যু : এদিকে এডিস মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৩৬৭ জন, যা আগের দিনের চেয়ে ৭৬ জন বেশি। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়লেও ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। ২৪ ঘণ্টায় ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, এর আগের দিন ছিল ১৩। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গলবার বুধবার সকাল পর্যন্ত একদিনে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে এ বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ৫০০ জনে। আর মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭৬ জন। হাসপাতালে ভর্তি রোগী এবং মৃত্যুর এই সংখ্যা অতীতের যে কোনো বছরের চেয়ে বেশি। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে-এমন আশঙ্কা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে বর্তমানে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৮ হাজার ৪৪৬ জন রোগী ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৩ হাজার ৯০৮ এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় ৪৫৩৮ জন। একদিনে মৃতদের মধ্যে ৫ জন ঢাকায় এবং ২ জন অন্য জেলায়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/712751