৩০ আগস্ট ২০২৩, বুধবার, ১০:৩০

সন্তানহারা মায়ের যন্ত্রণা কেউ বুঝবে না

নিজাম উদ্দিন মুন্না। ঢাকার বিমানবন্দর থানা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১৩ সালের ৬ই ডিসেম্বর নিখোঁজ হন তিনি। ২০১৬ সালে ছেলের শোকে বাবা সামছুদ্দিন স্ট্রোক করে মারা যান। ঘটনার দিন রাত দশটার দিকে সাদা পোশাকে র‌্যাব পরিচয়ে মোল্লারটেক এলাকা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় তাকে। নিখোঁজ ছেলের সন্ধানে দিন-রাত হন্যে হয়ে ঘুরেছেন পরিবারের সদস্যরা। দশ বছরে কোনো সন্ধান মেলেনি সন্তানের। স্বামী এবং সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ ময়ূরী বেগম। সন্তান ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছেন তিনি। নিখোঁজ মুন্নার মা ময়ূরী বেগম মানবজমিনকে বলেন, ২০১৩ সালের ৬ই ডিসেম্বর রাত দশটার সময় আমার ছেলেকে সাদা পোশাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

এই দশ বছর বুকে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছি। ছেলেকে খুঁজতে খুঁজতে তার বাবা ১০১৬ সালের নভেম্বরে স্ট্রোক করে মারা যায়। মুন্না একটি গ্লাস হাউজে চাকরি করতো। ঘটনার দিন দোকান বন্ধ করে বাসায় আসছিল। আসার পথে র‌্যাব পরিচয় দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যায়। তখন ওর বাবা দেখতে পেয়ে চিৎকার দিলে তারা বলে আপনার ছেলের নামে অভিযোগ আছে, তাকে আমরা থানায় নিয়ে যাচ্ছি। এরপর রাত ১১টার দিকে আমার স্বামী বিমানবন্দর থানায় যান। থানা থেকে বলা হয় মুন্না নামে আমাদের থানায় কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তখন মুন্নার বয়স ছিল ২২ বছর। এরপর ডিবি অফিসে যান, সেখান থেকেও বলা হয় এই নামে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এরপর থেকে খুঁজতে খুঁজতে ১০ বছর কেটে গেল। প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত ওর বাবা শুধু প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। প্রথম কয়েকদিন তারা বলেন, আপনার ছেলে আছে, তখন ওর বাবা বলে তাহলে আমাদের একটু দেখান। এরপর তাদের কাছে গেলে কেউ কিছুই জানে না বলে জানায়। প্রতিদিন ছেলেকে খুঁজতে সকালে বের হলে অনেক রাতে বাসায় আসতেন। যখন আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে যায় তখন তারা সাদা পোশাকে ছিল এবং সঙ্গে ছিল কালো গাড়ি। ওই এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকি আমরা। আমার তিন মেয়ে ও তিন ছেলে। এই ছেলে দ্বিতীয়।

তিনি বলেন, ওইদিন থেকে এখন পর্যন্ত আমরা নিরিবিলি থাকতে পারছি না। পথেঘাটে হয়রানি, পুলিশের হয়রানির শেষ নেই। দেশে যেকোনো দিবস আসলে বাসায় পুলিশ আসতো। এখনো আমরা অনেক চাপের মুখে আছি। কয়েক মাস ধরে একটু কম আসছে প্রশাসনের লোক। তারা আগে আমাকে ফোনেও বলতো যে, আপনারা আপনার ছেলেকে মনে হয় বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি বলি আমার সন্তান যদি আজ বেঁচে থাকতো অন্তত মায়ের কাছে একবারের জন্য হলেও ফোন দিতো। সে তো আর ছোট বাচ্চা নয়। সে কেন বিএনপি করে এটাই তার বড় অপরাধ। ওর বাবা সারা বাংলাদেশে এমন কোনো থানা বা এমন কোনো কারাগার নেই যে সেখানে খোঁজেনি। ২০১৬ সালে মনে করেছিল সে ইন্ডিয়া যেতে পারে। সেজন্য পাসপোর্ট করিয়েছিল। এরই মধ্যে সে স্ট্রোক করে। সাতদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা যায়। এখন ছোট ছেলেটা একটা অনলাইনে কাজ করে আর বড় ছেলে কোম্পানিতে আছে। তাদের আয় দিয়ে কোনোরকম সংসার চলছে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে ময়ূরী বেগম বলেন, আমি তো শেষ হয়ে গিয়েছি। ছেলে আমার কোল থেকে দশটি বছর হারিয়ে গেছে। সামনের দিনগুলোতে যে ভালো থাকবো সেটি আর সম্ভব নয়। ছেলেহারা মায়ের কষ্ট কে বুঝবে? কেউ যদি ফোন করে- দৌড়ে আসি, এই বুঝি আমার ছেলে মা বলে ডাকবে। একটা সন্তানহারা মায়ের যে কতো যন্ত্রণা, কতো কষ্ট, সেইটা মা ছাড়া কেউ বুঝবে না। আমার মতো দুঃখিনী মা যেন আর কেউ না হয়। আমার স্বামী নেই, ছেলে নেই, মা-বাবা নেই। তাদের ছাড়া বুকে পাথর চাপা দিয়ে থাকি। নিজের বাড়ি, মাথার উপর ছাদ নেই, পায়ের নিচে মাটি নেই, আমিও আমার নেই। আমার ছেলের নামে ব্যাংকে কিছু টাকা-পয়সা ছিল, তার বাবা দিয়েছিল ব্যবসা করার জন্য সেটিও বন্ধ। আমরা কোথাও গিয়ে দাঁড়াইতে পারি না। আমরা গুম পরিবার। কতো কষ্ট আছে বুঝাতে পারবো না। সামাজিক ভাবে কেউ কিছু না বললেও প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের লোকেরা আমার ক্ষতি করে। ছেলেগুলো চলাফেরা করলে তারা কু-নজরে তাকায়, সমালোচনা করে। পুলিশের হয়রানিতে বাসা পর্যন্ত পাল্টিয়েছি। বাসা ভাড়াও কেউ দিতে চায় না আমাদের। আমরা যে কতো কষ্টে আছি এইটা কাউকে বুঝাতে পারবো না।

তিনি আরও বলেন, আমাদের মতো এই পরিবারগুলোর বিচারটা যেন আমরা পাই। এটাই আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা।
তিনি বলেন, এখন কাঁদতেও পারি না। নির্বাচন আসলেই আমাদের উপরে নজরদারি বেড়ে যায়। গত নির্বাচনের আগেও বাসায় পুলিশ এসেছিল। এমন না করে আমাকেও মেরে ফেলে দিক। এই দশ বছর লড়াই করতে করতে এখন মৃত্যুর আর কোনো ভয় নেই। কোনো কথা বলতে পারি না এক ছেলেকে হারিয়েছি আবার যদি আমার এই দুই ছেলেকে হারাতে হয়। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’র সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমরা শুধু গুম প্রতিরোধ দিবস পালন করি সেটা নয়। গুমের শিকার ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে গত ১২ বছর বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছি। আমাদের একটাই চাওয়া- গুম হওয়া স্বজনদের ফেরত পাওয়া। এই গুমের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনা। তিনি বলেন, জাতীয়-আন্তর্জাতিক এজেন্সির সংগ্রহকৃত তথ্য অনুযায়ী এই পর্যন্ত নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা ৬৪৫ জন।

https://mzamin.com/news.php?news=71612