৩০ আগস্ট ২০২৩, বুধবার, ১০:২৪

সুন্দরী গাছ কমেছে ৭৯ শতাংশ

পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সুন্দরবনের শত শত বৃক্ষ মারা যাচ্ছে। ছবিটা পশ্চিম সুন্দরবণের কলাগাছি যাওয়ার পথে তোলা।
আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা : উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় অতিমাত্রায় লবণাক্ততার প্রভাব পড়েছে জীববৈচিত্র্যে ভরপুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনে। বনের নদী-খালে মিঠা পানির প্রবাহ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ফারাক্কার কারণে উজানের পানি প্রবাহ কমে যাওয়াতে সুন্দরবনে দিন দিন লবণাক্ততা বাড়ছে। সুন্দরবনের সর্বত্র মাটির লবণাক্ততার পরিমাণ ২-৪ দশমিক ৫ ডিএস/এম। তবে শুষ্ক মৌসুমে মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ছয় ডিএস/এম মধ্যে থাকে। বিশ্বের বৃহত্তম এ শ্বাসমূলীয় বনে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা রয়েছে। অতিমাত্রার লবণাক্ততায় সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী এবং গেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ হুমকির মুখে পড়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ আগে সুন্দরী গাছ দিয়ে নৌকা এবং ঘর নির্মাণ করতো। কারখানায় সুন্দরী গাছ ব্যবহার করে হার্ডবোর্ড বানানো হতো। গবেষণা বলছে, সুন্দরী গাছের বদলে এ বনে অপেক্ষাকৃত খর্বকায় ‘শাকড়া’ জাতীয় উদ্ভিদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) সম্প্রতি এক গবেষণায় বলছে, সুন্দরী গাছের পরিমাণ কমেছে ৭৯ ভাগ, আর কাকড়াজাতীয় গাছের পরিমাণ বেড়েছে ১৩৮১ শতাংশ। এতে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে সুন্দরবনে বড় গাছের জায়গা দখল করছে ছোট গাছ। এতে করে সুন্দবনের প্রাণপ্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক প্রভাব পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অপরদিকে সুন্দরবনের প্রধান গাছ সুন্দরী এবং গেওয়া গাছ ছিল ১৫ হাজার ৯৬৯ হেক্টরে, ২০২২ সালে এসে যা কমে হয়েছে ১২ হাজার ৫৮৩ হেক্টর। অর্থাৎ প্রধান দুই গাছ কমেছে ৭৯ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছে, সুন্দরী এবং গেওয়া মূলত লবণাক্ত এলাকার গাছ। গাছের ফল পরিপক্ব হলে আপনা-আপনি কাদা মাটিতে পড়ে বীজ ফেটে চারা গজায়। কিন্তু পানি এবং কাদায় লবণের পরিমাণ বেশি হলে গাছের শেকড় চারা অবস্থায় মাটির খুব গভীরে যেতে পারে না। এতে চারা গজানোর হার কমে যায়। ফলে প্রতিবছর বনের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে।

চিরসবুজ-নিস্তব্ধ এই বন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে দেশকে রক্ষা করে আসছে। সুন্দরবন বাংলাদেশের ঐতিহ্য এবং বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে পরিচিতিও দিয়েছে। জীববৈচিত্র্য ও নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সুন্দরবনের গুরুত্ব বলাবাহুল্য। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদরাজি বায়ুমন্ডল থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড চুষে নেয়। বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবন ৬৬২ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে রাখে। সুন্দরবনের প্রতিরোধ ও উৎপাদন মূলক ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি সমৃদ্ধি ও মানুষের জীবনের নিরাপত্তা পাচ্ছে।

প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এ বনাঞ্চল সমুদ্র থেকে উঠে আসা প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো মোকাবিলা করে। গত একশ বছরের মধ্যে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ৫০৮টি সাইক্লোনের উৎপত্তি হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৭ শতাংশ সাইক্লোন বাংলাদেশের ভূখন্ডে আঘাত হেনেছে। এসব প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকার মানুষ, কৃষি ও অন্যান্য সম্পদ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখে সুন্দরবনের ঘন সবুজ বেষ্টনী। বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনে দেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান প্রতি বছর প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও বিশ্বঐতিহ্যের অংশ হওয়ায় প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ দেশী-বিদেশী পর্যটক ঘুরতে আসে, যা থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান প্রায় ৪১৪ কোটি টাকা।

বন বিভাগ সূত্র মতে, গত ১৯ বছরে প্রায় ২২ বার আগুন লেগেছে সুন্দরবনে। যার ফলে সুন্দরবনের প্রায় ৭২ একর বনাঞ্চল আগুনে পুড়েছে। সত্তরের দশকে ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে উজান থেকে অভিন্ন নদ-নদীর পানি না দেওয়ায় সুন্দরবনে মিঠাপানির প্রবাহ কমে আসে, এতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ ৪০ শতাংশ কমে যাওয়ায় অধিকাংশ নদ-নদী জৌলুস হারিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে ‘এই পরিস্থিতি এক দিনে তৈরি হয়নি। সুন্দরীসহ সুন্দরবনের প্রধান গাছগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। এদিকে মিঠা পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সুন্দরবনের পুরো ইকোসিস্টেমের ওপরে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এতে করে পুরো সুন্দরবন আজ হুমকির মুখে পড়েছে।’

শ্যামনগর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গাজী নজরুল ইসলাম বলেন,‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনে লবণাক্ততা বেড়ে চলেছে। মিঠা পানির উৎস কমে গেছে। বনের বেশকিছু খাল পলিমাটি জমে ভরাট হয়ে আছে এবং বিভিন্ন এলাকায় চর জেগেছে। বনে লবণ পানির আধিক্য বেশি। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে সুন্দরীসহ বিভিন্ন গাছ নানা রোগে মারা যাচ্ছে। লবণ পানি খেয়ে বন্যপ্রাণী নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র হুমকির মুখে। তিনি বলেন, তারা সুন্দরবন সংরক্ষণ ও বনসংলগ্ন মানুষের জীবন জীবিকার মানোন্নয়নের জন্য সুন্দরবন পরিচালনার ক্ষেত্রে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের দাবি পূরণ হলে বন এবং বনসংলগ্ন মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটবে বলে তিনি আশাবাদী।

https://www.dailysangram.info/post/534099