৩০ আগস্ট ২০২৩, বুধবার, ১০:১১

মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট চাই না

মুজতাহিদ ফারুকী

৬৪ বছর আগে ১৯৫৯ সালে একটি বই লেখা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। পলিটিক্যাল থ্রিলার বা রাজনৈতিক গোয়েন্দা কাহিনী। কাহিনীটি ছিল অভিনব।

কোরীয় যুদ্ধে গিয়ে মার্কিন সেনা রেমন্ড শ বন্দী হন শত্রুর হাতে। চীনা ও সোভিয়েত এজেন্টরা তার মগজ ধোলাই করে। ধোলাই করা মগজ নিয়ে শ কমিউনিস্টদের পক্ষে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন প্রার্থীকে হত্যার চেষ্টায় নেতৃত্ব দেন। কেন সেই প্রার্থীকে হত্যা করা হবে? কারণ সেটি করতে পারলে তারই রানিং মেট সিনেটর আইসেলিন প্রেসিডেন্ট হতে পারেন অপ্রতিরোধ্য জনসমর্থন নিয়ে। আইসেলিন চীনপন্থী এবং তিনি নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা স্টাইলের একনায়কতন্ত্র কায়েম হবে। আইসেলিন হলেন খোদ শ-এর বাবা এবং ক্ষমতার কলকাঠি নাড়তে ওস্তাদ তার স্ত্রী (শ-এর মা), আইসেলিনকে নির্বাচনে নিয়ে আসেন।
ষড়যন্ত্রটি তখনকার সময়ের জন্য ছিল অভিনব এবং দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রীতিমতো চাঞ্চল্যকর। যদিও অত্যন্ত জটিল আখ্যানভাগের কারণে টাইমের রিভিউকার বইটিকে ‘শ্রেষ্ঠ বাজে বই’য়ের তালিকায় ফেলে দেবার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তবু নিউ ইয়র্কের লেখক, অভিনেতা রিচার্ড কন্ডন-এর ‘দ্য মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট’ (The Manchurian Candidate) ১৯৬২ সালে চলচ্চিত্রে রূপ দেন জন ফ্রাঙ্কেনহাইমার। এতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেন বিখ্যাত অভিনেতা ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা। বিশ^রাজনীতির ওইরকম এক ঝিম ধরা সময়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কায় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড আর্টিস্টস দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল। কিন্তু কন্ডনের বই কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মন জয় করেছিল যাদের অন্যতম খোদ প্রেসিডেন্ট কেনেডি। প্রেসিডেন্টের সবুজসঙ্কেত পেয়ে চলচ্চিত্রটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে। ছবিটি, ফ্লপ হয়, কিন্তু এটি দেশবাসীকে সতর্ক করতে অনন্য ভূমিকা রাখে। আর সেই থেকে মার্কিন রাজনীতিতে একটি নতুন বাগধারা চালু হয়- ‘মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট’। মাঞ্চুরিয়া কোরিয়া সংলগ্ন চীনা অঞ্চল।

অনেকেই হয়তো এই শব্দবন্ধ্যের সাথে পরিচিত। তবে সাধারণ পাঠক না-ও জানতে পারেন। কাকে বলে ‘মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট’? বইয়ের যেটুকু বিবরণ দিয়েছি, তা থেকে বিজ্ঞ পাঠক হয়তো কিছুটা ধারণা পাবেন। তবু সামান্য ব্যাখ্যা দেয়ার দরকার মনে করছি। বলা হয়েছে, মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট হলেন সেই ব্যক্তি, বিশেষ করে সেই রাজনীতিক যিনি শত্রুপক্ষের হাতের পুতুল। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় শত্রুর অনুগত এবং তাদেরই আঙুলে নাচেন, নিজের দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে শত্রুপক্ষের স্বার্থ রক্ষায় রাজনীতির কলকাঠি নাড়েন।
আমেরিকার রাজনীতিকরা প্রায়শ প্রতিপক্ষকে মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট বলে অভিহিত করেন তাকে বিদেশি চর বা বিদেশের স্বার্থে তৎপর বোঝাতে। এমনকি প্রেসিডেন্টরাও এমন অভিযোগ থেকে রেহাই পান না। জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং বারাক ওবামাকে পর্যন্ত কেউ কেউ মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট বলতে চেয়েছেন বা বলেছেন।

এরকম মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট আমাদের দেশে বিরল নয়। শুধুই ক্ষমতার লোভে বাইরের শক্তির সাথে মিলে তাদেরই হাতে দেশের সব স্বার্থ তুলে দিয়েছেন এমন উদাহরণ যে কেউ সমকালীন রাজনীতিকদের মধ্যেই খুঁজে পাবেন।
দেশে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচন কেমন হতে পারে তা নিয়ে আছে সংশয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের গুটিকয় মিত্র ছাড়া দেশের সব রাজনৈতিক দল, জোট এবং বিশ্লেষক পর্যবেক্ষক একমত যে, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেটি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো প্রহসন ছাড়া কিছু হবে না। আবার এর বিকল্প অর্থাৎ একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ধারণা ক্ষমতাসীনদের কাছে বিষবৎ পরিত্যাজ্য। তারা এর কথা শুনলেই কানে আঙুল চাপছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের প্রতিশ্রুতি বিশ^াস করবে এমন কোনো মানুষ বাংলাদেশে আছে বলে মনে হয় না- এমনকি তাদের দলের মধ্যেও।

এতটা সংশয় সন্দেহের কারণ কী? কারণটা সবার জানা। ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম নির্বাচন থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো একটি নির্বাচনেও মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারেনি। আর গত তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড সারা বিশে^ দেশের মুখে কালি মাখিয়েছে। এই তিনটি নির্বাচনের মধ্যে প্রথমটি (২০০৮) আওয়ামী লীগের অধীনে হয়নি। হয়েছে আওয়ামী লীগের ‘আন্দোলনের ফসল’ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সেটি যে, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আওয়ামী লীগ ও প্রতিবেশী দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতির মধ্যে একটি পাতানো নির্বাচন ছিল তার যাবতীয় প্রামাণ্য দলিলপত্র দেশবাসীর মুখস্থ। পরের দু’টির কথা আগেই বলেছি।

২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা অনেকেরই মনে আছে। জাতীয় পার্টির নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে সিএমএইচ-এ ভর্তি করা এবং নির্বাচনে অংশ নিতে ভারতের পরামর্শের প্রায়োগিক উপযোগিতার কাহিনী সবারই জানা। আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা তখন ঘরোয়া আলোচনায় মন্তব্য করেছেন, ঠিকই আছে, নাচতে নেমে নেত্রী ঘোমটা দেননি। এই ঘোমটা দেয়া অথবা না দেয়ার নোংরামিই রাজনীতিতে এখন মুখ্য। ২০১৪-এর নির্বাচনের আগে নেত্রী বলেন, এটি অন্তর্বর্তী নির্বাচন। কিন্তু কথা রাখেননি। ক্ষমতায় থাকেন পুরো মেয়াদ। ২০১৮- তে বলেন, আমার ওপর আস্থা রাখুন। আস্থা রেখে বিরোধী দল নির্বাচনে যায়। সেই আস্থার ফল নির্বাচনের আগের রাতেই সব ব্যালটে সিল। তাই দলটিকে কেউ আর বিশ^াস করে না।

কিন্তু আসন্ন নির্বাচন ঘিরে আবারও প্রতিবেশী দেশটি নতুন চাল দিতে শুরু করেছে বলে মনে হয়। গত তিনটি নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্সক্ষার বিপরীতে প্রকাশ্য ভূমিকা রাখায় দেশটি সমালোচিত হয়েছে। এবার ঘোষণা দিয়েছে তারা প্রতিবেশী দেশের ব্যাপারে জড়িত হতে চায় না। কিন্তু এই ভূমিকা তারা সর্বাবস্থায় অনুসরণ করবে না। তারা জানে, বাংলাদেশে এমন কোনো দল নেই যারা ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতকে আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি কিছু দিতে পারে। এ জন্যেই দেশটি এখন আওয়ামী লীগকে একটু শাসনে রাখার ব্যবস্থা করেছে, যাতে তারা অন্য কোনো শক্তির দিকে ঝুঁকে না পড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ বৈঠকের ফলাফল তার প্রমাণ। আবার বাংলাদেশী কিছু রাজনীতিককে ডেকে নিয়ে বলে দিচ্ছে, নির্বাচনে তাদের ভূমিকা কী হবে।
শুরুতে মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট নিয়ে অতো কথা বলার কারণ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদেরের সাম্প্রতিক ভারত সফর (২০-২৩ আগস্ট) নিয়ে ঢাক গুড়গুড়। ওই সফরে ভারতের কোন কোন কর্মকর্তার সাথে দেখা বা কথা হয়েছে তা বলেননি মি. কাদের। তবে মিডিয়াকে বলেছেন: ‘বাংলাদেশে সময়মতো একটি সুন্দর নির্বাচন চায় ভারত; এবং তারা চায়, নির্বাচনের আগে এবং পরে বাংলাদেশে যাতে কোনো ক্রমেই সহিংসতা না হয়।’
এটি হলো, ক্ষমতাসীনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাওয়াই।

জি এম কাদের বলেন, ‘তারা (ভারত) প্রত্যাশা করেন, আমরা সবাই মিলে ওই ধরনের একটি পরিবেশ সৃষ্টি করি।’

এটি হলো, নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগকে বৈতরণী পার হতে সহায়তা করার ব্যবস্থাপত্র।
রাজনৈতিক দলগুলোর মতদ্বৈধতা প্রসঙ্গে জি এম কাদের : ‘ভারত বলেছে, আমরা চাই, নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এটার সুরাহা করবেন। তারা বলেছেন, জাতীয় পার্টি সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে, সবাইকে একসঙ্গে করে, সুন্দর একটা নির্বাচন করতে পারলে তারা খুশি হবেন।’ এ ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্মকর্তারা জাতীয় পার্টিকে উদ্যোগী ভূমিকা নেয়ার কথাও বলেছেন।
দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্ট থেকে যেটুকু উল্লেখ করা হলো তাতে মি. জি এম কাদেরকে দেয়া ভারতের অ্যাসাইনমেন্ট বোঝার কিছু কি বাকি থাকছে?

তবে জি এম কাদের দেশের প্রথম রাজনীতিক যিনি বিদেশ সফরে কার কার সাথে দেখা বা কথা হলো তা প্রকাশ করেননি। এটি শুধু প্রচলিত রীতি-প্রথার বরখেলাফ নয়, জি এম কাদেরের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলি, এটি রীতিমতো সন্দেহজনক। এটি তার ব্যক্তিগত ভাবমর্যাদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একজন রাজনীতিক বিদেশ সফরে গিয়ে কী করলেন, কার সাথে, কী কথা বললেন দেশবাসীর জানার অধিকার আছে। জানানোটাই রাজনীতিকের দায় ও দায়িত্ব। তিনি কোনো ষড়যন্ত্রে জড়িত নন এ বিষয়ে জনগণের কাছে স্বচ্ছ থাকতে হবে। আগরতলার গল্প আমাদের সবার জানা। সফরটি যদি গোপন হতো সেটি ভিন্ন কথা।

সারা বিশ্বে এবং এই বাঙ্গাল মুলুকে চীন-মার্কিন দ্বৈরথ যখন তীব্র তখন আমরা দেশে মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট দেখতে চাই না।
mujta42@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/773486