৩০ আগস্ট ২০২৩, বুধবার, ১০:১০

জামায়াতের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও দুর্গম পথে তার অগ্রযাত্রা

ড. মো. নূরুল আমিন

॥ দুই ॥
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জামায়াত অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে এবং ধৈর্য সহকারে কিছুকাল তৎকালীন শাসক দলের নীতি পলিসি পর্যবেক্ষণ করে। দলটির আচার আচরণ ও কর্মধারা থেকে এটা পরিষ্কার ধরা পড়ে যে তারা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের প্রতিশ্রুতি কিছুতেই রক্ষা করবে না। এই অবস্থায় জামায়াত সরকারের কাছে রাষ্ট্রের ইসলামী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলী ঘোষণার জন্য চার দফা একটি দাবিনামা পেশ করে। এই দাবিগুলো গ্রহণের লক্ষ্যে আইনপরিষদের উপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে দলটি একটি আন্দোলন গড়ে তোলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই দাবিনামা পেশের দুঃসাহস দেখানোর জন্য জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলসহ বেশ কিছু নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়। আন্দোলনের উপর তারা অত্যাচারের স্টীমরোলার চালায়। তবে আইনপরিষদের কিছু সংখ্যক সদস্যসহ দেশের ইসলামী দলগুলো এই দাবিনামার সপক্ষে অবস্থান নেন এবং এর পক্ষে সমর্থন বৃদ্ধি পেতে থাকে। অবশেষে আইন পরিষদ ‘অবজেক্টিভস রিজুলিউশন’ নাম নিয়ে এই দাবিগুলোকে বৈধতা প্রদান করে একটি সিদ্ধান্তকারী প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবে জামায়াতের সব দাবিগুলোই স্থান পায়।
আন্দোলনের এই পর্যায়ে জামায়াত পূর্ববর্তী পর্যায়ে গৃহিত কর্মসূচিসমূহ বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখে। তবে অবজেক্টিভ রিজুলিউশন গৃহিত হবার ফলে যে অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে জামায়াত কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং চারদফা আদায়ের কর্মসূচির সাথে ইসলামী শাগণতন্ত্র বাস্তবায়ন এবং জনগণের অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ আদায়ের আন্দোলনকে আরো শানিত করে। এই পর্যায়ে জামায়াতের আন্দোলন ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক গণতন্ত্র হত্যা এবং সামরিক শাসনকারীর মধ্য দিয়ে আর অগ্রসর হতে পারেনি।

পাকিস্তানের সামরিক জান্তা অন্যান্য দলের সাথে এই সময়ে জামায়াতকেও বেআইনি ঘোষণা করে এবং ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। সামরিক শাসনামলে জামায়াত নি¤েœাক্ত কার্যাবলি সম্পাদন করে।

ক। রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনায় ইসলামী মূলনীতির বাস্তব প্রয়োগসহ ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণ বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে স্বচ্ছ ধারণা প্রদান।

খ। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মী বাহিনীর নেতৃত্বে জনগণকে ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তব দিক ও সুবিধাবলি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য সংগঠিত করা।
গ। বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে জামায়াতের কর্মী বাহিনীকে নিয়োজিত করা।
ঘ। অগণতান্ত্রিক ও অনৈসলামিক শক্তিকে মোকাবেলার জন্য রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রচারাভিযান পরিচলানা করা।
ঙ। জনগণ ও সরকারকে পরামর্শ এবং দিকদর্শন দেয়ার জন্য প্রত্যেকটি ইস্যুতে ইসলামের আলোকে মতামত প্রদান।
চ। আরবী ও ইংরেজীর নায় বিদেশী ভাষাসহ পাকিস্তানের প্রত্যেকটি জাতীয় ও আঞ্চলিক ভাষায় ব্যাপক আকারে ইসলামী সাহিত্য প্রকাশ।
ছ। দেশে সত্যিকার অর্থে ইসলামিক ও গণতান্ত্রিক শাগণতন্ত্র প্রনয়নের উপযোগী একটি পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য ব্যাপক ও নিবিড় পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করা।

১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ছিল জামায়াত কর্মকান্ডের তৃতীয় পর্যায়। এই অধ্যায়টি ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অধ্যায় যা ১৯৬২ সালের জুলাই মাসে শুরু হয় এবং ঐ বছরই সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর জামায়াত পুনরুজ্জীবিত হয়।

সামরিক শাসনজারীর পূর্বে জামায়াত দেশের অন্য কোনো ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির সাথে জোটবদ্ধ আন্দোলনের চিন্তা করেনি। জামায়াতের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র হচ্ছে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত। এ প্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালের জুলাই মাসের পর জামায়াত দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠানকে অপরিহার্য্য বলে গণ্য করে এ প্রেক্ষিতে দলটি সংসদ ও সংসদের বাইরে সকল গণতান্ত্রিক দল একত্রিত হয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতেরই সক্রিয় উদ্যোগে আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নেজামে ইসলাম পার্টি প্রভৃতিকে নিয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল বা Combined Opposition Party (COP) গঠিত হয়।

বলাবহুল্য পাকিস্তানের সামরিক সরকার ১৯৬২ সালে একটি শাগণতন্ত্র প্রনয়ন করেছিল যা প্রকৃতি এবং উপাদান উভয় দিক থেকেই অগণতান্ত্রিক এবং অনৈসলামিক ছিল। সারাদেশ থেকে এই শাগণতন্ত্র বাতিলের দাবি উঠেছিল। বড় আকারে রাজনৈতিক সংকট এড়ানোর জন্য জামায়াত সংশোধনীর মাধ্যমে শাগণতন্ত্র গণতন্ত্রীকরণের পক্ষে ছিল, কেননা নতুন করে শাগণতন্ত্র প্রনয়ন ছিল ঐ সময় অত্যন্ত কঠিন কাজ এবং এতে নানা সমস্যা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা ছিল।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন প্রদান প্রভৃতি দাবি আদায়ে দলবদ্ধভাবে কর্মরত অন্যান্য দলগুলোকে জামায়াত শাগণতন্ত্র সংশোধনের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে রাজী করাতে সক্ষম হন। পাশাপাশি দলটি নিজস্ব স্থায়ী কর্মসূচি ও নীতিমালার ভিত্তিতে রাজনীতির ইসলামীকরণ এবং কুরআন সুন্নাহর শিক্ষার আলোকে মানবসম্পদ উন্নয়নের নিজস্ব কর্মসূচিও বাস্তবায়ন করে। জামায়াতের সক্রিয় অংশগ্রহণে দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলন তুঙ্গে উঠে এবং স্বৈরাচারী সরকার ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে ভিত্তিহীন অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনী ঘোষণা করে।

জামায়াতও আইনের আশ্রয় নেয় এবং সরকার জামায়াতের বিরুদ্ধে আনীত তার অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে ঢাকা হাইকোর্ট এবং একই সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট জামায়াতকে বে আইনী ঘোষণা করে সরকার প্রদত্ত আদেশ বে আইনী এবং কর্তৃত্ব বহির্ভূত বলে রায় দেন। এরপর জামায়াতের গঠনতন্ত্রে বিবৃত চারদফা স্থায়ী কর্মসূচির ভিত্তিতে ১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রণীত একটি পাঁচশালা পরিকল্পনা অনুযায়ী জামায়াত তার কর্মকা- অব্যাহত রাখে। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রাজনৈতিক বিভেদ থাকা সত্ত্বেও জামায়াত সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করে। কেননা পাকিস্তানের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরক্ষার বিষয়টি তার কাছে অধিকতর মূল্যবান ছিল। যুদ্ধে পাকিস্তান জয়ী হয়। স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অবসান এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সমস্যা পুরো ষাটের দশকব্যাপী জাতির কাছে একটি অলংঘনীয় সমস্যা ছিল। জামায়াত কায়মনোচিত্তে বিশ্বাস করতো যে গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমূহের অনুপস্থিতিতে অর্থ ও ব্যাংক ব্যবস্থা, অর্থনীতি রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাসহ কিছুতেই জ্ঞানের ইসলামীকরণ সম্ভবপর নয়। এই অবস্থায় জামায়াত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন অব্যাহত রাখা, আঞ্চলিক, স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা, সম্পন্ন ও সেবা বন্টনে ইনসাফ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা প্রভৃতির উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে। তারা এই দাবিসমূহ আদায়ে অন্যান্য দলের সাথে হাত মিলিয়ে সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে তুলতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ সালে দেশের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন (Pakistan Democratic Movement PDM) নামে একটি জোট গঠন করে। তারা জেনারেল আইয়ুব খানের স্বৈরাচারি সরকারের বিরুদ্ধে ৮ দফা দাবি সম্বলিত একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই জোট গঠন ও পরিচালনায় জামায়াতে ইসলামী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তান আওয়ামী লীগও এই জোটের অংশ ছিল এবং জামায়াতের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেক্রেটারি অধ্যাপক গোলাম আজম একাধিকবার পিডিএম এর পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারি ছিলেন, ১৯৬৯ সালে পিডিএম ভুক্ত ৫টি দল সংশোধিত আট দফার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে আরো জোরদার করার জন্য আরো তিনটি দল নিয়ে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি বা Democriatic Action Committee নামে একটি নতুন ফোরাম গঠন করে।

https://www.dailysangram.info/post/534040