২৯ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ৮:৪১

হাওরে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা করার ‘দায়িত্বে’ আ. লীগ নেতারাও!

অসময়ের বন্যায় ব্যাপক ফসলহানির শিকার হাওরাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে পুরনো পথেই হাঁটছে প্রশাসন। সাধারণত ইউনিয়ন পর্যায়ে বরাদ্দের তালিকা করেন চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা। চেয়ারম্যানরা বরাদ্দের একটি বড় অংশ নিয়ে তাঁদের পছন্দের লোকজনের মধ্যে বিতরণ করেন। মেম্বাররা পান তার চেয়েও কম। এবার ঘটেছে ব্যতিক্রম। চেয়ারম্যানদের পাশাপাশি নামের তালিকা প্রণয়নের ‘দায়িত্ব’ পালন করছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারাও। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাওরের প্রত্যন্ত বহু এলাকায় এখনো ত্রাণের চাল বা টাকা পৌঁছেনি। প্রথম দফায় ক্ষতিগ্রস্তদের একাংশের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হলেও পরিবারপিছু ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকার জন্য তালিকা প্রণয়নের কাজ এখনো শেষ হয়নি। বরাদ্দও এসেছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের যথাযথ তালিকা প্রণয়ন ও তাদের হাতে ত্রাণ পৌঁছানোর ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরা। তাঁরা বলছেন, প্রথমত ত্রাণ অপর্যাপ্ত। মোট কৃষক পরিবারের মধ্যে মাত্র আট ভাগের এক ভাগ তথা তিন লাখ ৩০ হাজার কৃষক পরিবারের তালিকা করা হচ্ছে। তারপর এ জাতীয় দুর্যোগে দুর্বৃত্তদের অনৈতিক ব্যবসা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা না গেলে সরকারের ত্রাণ কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আজিম উদ্দিন বিশ্বাস জানান, সম্মিলিত সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে। প্রয়োজনের তুলনায় সরকারের বরাদ্দ কম—এ কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে। প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চলে ত্রাণ সহায়তা যাচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা বরাদ্দের তালিকা করছেন চেয়ারম্যান-মেম্বাররাই। এলাকার কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তি বা সুধীসমাজের লোকজন চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সহায়তায় এগিয়ে এলে তাঁদের বক্তব্য আমলে নিতেই হবে। ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাহীনের কোনো বিষয় নেই। ’
কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের ঘাগড়া ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছেন চেয়ারম্যান, মেম্বার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। জানা গেছে, ঘাগড়ায় খানার সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এর মধ্যে কৃষক পরিবারের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। প্রথম দফায় ১০ মেট্রিক টন চাল দেওয়া হয়েছে। ১০ কেজি করে প্রায় এক হাজার কৃষক পরিবারের মধ্যে এ চাল বিতরণ করা হয়েছে। এ ইউনিয়নের জন্য আরো পাঁচ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘাগড়ার ৯৫ শতাংশ কৃষক ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার ঘাগড়া, খলাপাড়া, ভরা, মালিউন্দ, চমকপুরসহ সাত-আটটি গ্রামের কৃষক। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবার ১০ কেজি করে চাল পেলেও এ চালে তাদের দুই-তিন দিনের খাদ্যেরও জোগান হয়নি। এমন বহু পরিবার রয়েছে, এক দিনেই যাদের ১০ কেজি চাল প্রয়োজন। সে তুলনায় ত্রাণ একেবারেই অপ্রতুল বলে চেয়ারম্যান নিজেই স্বীকার করেছেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে ঘাগড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ মো. মুসলেহউদ্দিন বলেন, তাঁর ইউনিয়নে ‘গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পরামর্শে’ মেম্বাররাই ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারের তালিকা করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের মাধ্যমে তালিকা প্রণয়নের অভিযোগ অস্বীকার না করে তিনি বলেন, ‘এখানে চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের, মেম্বারদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের এবং এমপিও আওয়ামী লীগেরই। স্বাভাবিক কারণেই আওয়ামী লীগ এ প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। ’
জানা গেছে, নিকলীর দামপাড়া ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দুই-তিনটি করে নাম অন্তর্ভুক্তির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গুরুই ইউনিয়নের জন্য ৩০০ কার্ড দেওয়া হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে অজ্ঞাত কারণে ৫০টি কার্ড ফেরত চাওয়া হয়। চেয়ারম্যান আবু তাহের বলেন, ‘মেম্বাররা ইউএনওকে বলেছেন যে তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের মেম্বার। পরে ইউএনও কার্ড ফেরত নেননি। ’
হাওরের মাঝখানে অবস্থিত নিকলীর ছাতিরচর ইউনিয়ন। একটিমাত্র গ্রাম নিয়ে গড়া এ ইউনিয়নটির কয়েক হাজার পরিবার ঘোড়াউত্রা নদীর ভাঙনের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত। এ গ্রামের ৯০ শতাংশ কৃষকই এবারের অকালবন্যায় ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। কৃষকরা জানায়, দুই দফায় মাত্র ১৯০ জন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ঘরে চাল বিরতণ করা হয়েছে। ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকার সহায়তার জন্য ৩০০ নামের তালিকা করছে প্রশাসন। জানা গেছে, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারাও তালিকা প্রণয়নের কাজ করছেন।
ছাতিরচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইয়ার খান চৌধুরী জানান, ৩০০ নামের মধ্যে চেয়ারম্যান ২০০ নামের তালিকা করছেন। বাকি ১০০ নাম তালিকাভুক্ত করতে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁর এলাকায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরাই তালিকাভুক্ত হচ্ছে।
বাজিতপুর উপজেলার দীঘিরপাড় ইউনিয়নের অন্তত দেড় হাজার কৃষক পরিবার অকালবন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে তিন দফায় মাত্র ৩১৫টি পরিবারকে ৩০ কেজি করে চাল ও নগদ ৫০০ করে টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রথমবার ৭৫, দ্বিতীয়বার ১৫০ ও তৃতীয়বার ৯০টি পরিবারকে এ ত্রাণ দেওয়া হয়। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিন মোহাম্মদ ফারুক বলেন, এ ত্রাণে ক্ষতিগ্রস্তদের একটি অংশ হয়তো কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে কিন্তু অধিকাংশ ফসলহারা পরিবারেই এখনো ত্রাণ পৌঁছেনি।
কিশোরগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সিদ্দিকুর রহমান জানান, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত জেলার ক্ষতিগ্রস্ত এক লাখ ৩৮ হাজার পরিবারের মধ্যে ৫০ হাজার পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বাকি আরো এক লাখ বিশেষ ভিজিএফ কার্ডের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
তালিকা প্রণয়নে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অংশগ্রহণের অভিযোগ সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য, প্রতিটি উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের কঠোর মনোভাব নিয়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে রাজনৈতিক নেতারা এসব ক্ষেত্রে ঝামেলা করে থাকেন বলে তিনি স্বীকার করেন। তবে তিনি আরো বলেন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসারসহ ট্যাগ অফিসারদের তত্ত্বাবধানে ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে ত্রাণের চাল ও নগদ টাকা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ত্রাণ তৎপরতা সরাসরি মনিটরিং করছে। যে কারণে ত্রাণ নিয়ে নয়ছয়ের সুযোগ নেই। এ ধরনের অভিযোগও এখন পর্যন্ত পাননি তাঁরা।
হাওরের মহাবিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন নাগরিকরা ও হাওরের সাত জেলার সংগঠন হাওর অঞ্চলবাসীর সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ূম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২৪ লাখ কৃষক পরিবারের দুই-তৃতীয়াংশ ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র তিন লাখ ৩০ হাজার পরিবারের মধ্যে বিশেষ ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে একটা বড় অংশই এ সুবিধার বাইরে থেকে যাবে। এ ছাড়া এ ধরনের দুর্যোগ-দুর্বিপাকে একশ্রেণির দুর্বৃত্তের অনৈতিক ব্যবসা বাড়ে। ’
তাঁর মতে, কৃষকের এ মহাসংকট কাটাতে ত্রাণের বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই। একই সঙ্গে ত্রাণ কার্যক্রমের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিরপেক্ষতাও বজায় রাখতে হবে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/04/29/491958